×

অর্থনীতি

খেলাপি আদায় কোন পথে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

খেলাপি আদায় কোন পথে

বাংলাদেশ ব্যাংক। ফাইল ছবি

দেশের আর্থিক খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এ নিয়ে নানা মহলে বারবার আলোচনায় উঠে আসছে। সরকারও এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানের কথা জানাচ্ছে। কিন্তু এরপরেও খেলাপি ঋণের উৎকণ্ঠা বাড়ছে বৈ কমছে না। গত বছরের সেপ্টেম্বরে গণছাড়ের আওতায় পুনঃতফসিল, স্বল্প সুদের ঋণের ব্যবস্থাসহ বিশেষ সুবিধা দেয়া হয় ঋণখেলাপিদের। এসব ছাড় নিয়ে অর্ধ লাখ কোটি টাকার বেশি খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়। এতে করে বছর শেষে অর্থমন্ত্রীর কথার কিছুটা রক্ষা হয়েছে। তবে তা কাগজে-কলমে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, নকলভাবে আদায় না দেখিয়ে সত্যিকারভাবেই খেলাপি আদায়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। প্রয়োজনে ঋণখেলাপিদের সামাজিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত করার পরামর্শ দেন তারা। দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ আদায়ে কঠোর হওয়ার বিষয়ে অনেক কঠোর বাক্য ঝেড়েছেন। গত বছর বেসিক ব্যাংকে পরিদর্শনে গিয়ে বলেছিলেন, বেসিক ব্যাংকে অনেক ঠিকানাবিহীন ঋণ আছে। আগামীতে কোনো ঋণ ঠিকানাবিহীন থাকবে না। খুঁজে বের করে প্রত্যেকের পেছনে একজন করে এজেন্সির লোক নিয়োগ দেয়া হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেব। কিন্তু বাস্তবে ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নেয়ার কোনো উদাহরণ দেখছেন না অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। তিনি বলেন, কাগজে কলমে দেখালেও খেলাপি ঋণ একেবারেই কমেনি। খেলাপি ঋণ এখন কারপেটের নিচে ময়লার মতো জমে আছে। বরং দেখানো হলে যা হতো, তার চেয়েও এখন বেশি খারাপ অবস্থা। তিনি বলেন, নকলভাবে আদায় না দেখিয়ে সত্যিকারভাবেই খেলাপি আদায়ে ব্যবস্থা নেয়া দরকার। কিন্তু বর্তমান সরকার বিশেষ করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল খেলাপিবান্ধব হওয়ায় পরিস্থিতি আওতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এজন্য আমার মতামত হচ্ছে, সঠিক পথে ফিরে এসে সারা বিশ্বে যে পন্থায় খেলাপি আদায় করা হয়, আমাদের দেশেও সে রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা ঋণখেলাপি তাদের প্রত্যেকের পাসপোর্ট জব্দ করা হোক এবং বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের কাছ থেকে টাকা আদায় করতে হবে। এ পদ্ধতি ছাড়া খেলাপি ঋণের অভিশাপ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। এছাড়া সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া খেলাপি ঋণ কমানো সম্ভব নয়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের ‘নো কম্প্রোমাইজ’ নীতির কথা প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও এমপিরা বারবার বললেও ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে তা অপ্রতুল বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ। তার মতে, খেলাপি আদায়ে ত্রিমাত্রিক ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রথমত, যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি হয়েছে তাদের খুঁজে বের করে ঋণ আদায়ে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যারা অনিচ্ছাকৃত খেলাপি আছে তাদের ‘কেস বাই কেস’ ধরে ধরে কিভাবে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব, তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে কিছু ছাড়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত হচ্ছে, খেলাপি আদায়ে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত, খেলাপি ঋণ আদায়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে একটি টার্গেট বেঁধে দেয়া। যেসব ব্যাংক এ টার্গেট পূরণে ব্যর্থ হবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি বলেন, সরকারের নতুন কৌশলে খেলাপি ঋণ আদায়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। ২ শতাংশ ঋণ পরিশোধের যে ঢালাওভাবে সুবিধা দেয়া হচ্ছে এটা ঠিক না। বিশেষ ব্যবস্থার ফলে ব্যাংকিং খাতের ঋণখেলাপি কমবে না, বরং বেড়ে যেতে পারে। একপর্যায়ে খেলাপি ঋণের উসুল অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। দেখা যাবে এতে করে খেলাপি সংস্কৃতি মানুষের মাথার মধ্যে ঢুকে যাবে। আর যারা ইচ্ছাকৃত খেলাপি তারা দেখা যাবে এই ২ শতাংশ ঋণ দিয়ে বাকি ঋণ আর পরিশোধ করবে না। খেলাপি আদায়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব না। তবে আদায়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে থাকে। এমনকি পুনঃতফসিল করার জন্যও নীতিমালা আছে। এছাড়া অন্যান্য আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তো প্রত্যেক ব্যাংকের নিজস্ব নিয়ম রয়েছে। তিনি বলেন, ঋণ আদায় করার সমস্ত দায় দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের। ঋণগুলো যদি তারা আদায় না করে সে ক্ষেত্রে ওই ঋণগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তার বিপরীতে প্রভিশন রাখার জন্য নির্দেশনা দিয়ে থাকে। সুতরাং আমাদের ঋণের যে সমস্ত মাস্টার সার্কুলার আছে সেগুলো মেনে ঋণগুলো বিতরণ বা আদায়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো যদি পরিপালন করে তবে ঋণখেলাপি কমবে। এক প্রশ্নের জবাবে সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজতে ও খেলাপি ঋণ কমাতে গত বছরের জুনের প্রথম সপ্তাহে একটি কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া কয়েকটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। তবে ঋণ আদায়ে সাম্প্রতিক সময়ে কোনো খেলাপির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, এমন উদাহরণ দিতে পারেননি এ মুখপাত্র। বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, দেশের ব্যাংকিং খাতে দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যা বিরাজ করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে উচ্চ খেলাপি ঋণ। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, খেলাপি ঋণ শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতেই ঝুঁকিপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করছে। মাত্রাতিরিক্ত খেলাপির প্রভাব পড়ছে ঋণ ব্যবস্থাপনায়। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন, বিগত ১০ বছরে দেশে যেমন খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তেমনি ঋণ দেয়ার পরিমাণও বেড়েছে। তবে খেলাপি আদায়ে বর্তমান সরকার নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন যা দেশের অর্থনীতিতে আগামীতে প্রভাব ফেলবে। তিনি বলেন, একদিনে যেমন খেলাপি ৯৩ হাজার কোটি টাকা হয়নি, তেমনি এ ঋণ একদিনে আদায়ও হবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App