×

মুক্তচিন্তা

করোনা আতঙ্ক, সামাজিক মনস্তত্ত্ব ও রেণুকা রপ্তান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২০, ০৭:৩৪ পিএম

গত ৫০ বছরে একের পর এক নানা রোগ ও মহামারি দুনিয়াময় সংকট তৈরি করছে যা একেবারে নির্মূল না হয়ে বারবার নানারূপে নানাভাবে নানা অঞ্চলে ফিরে আসছে। এসব রোগ ও মহামারি নির্মূলে এখনো কোনো কার্যকর বৈশ্বিক সমন্বয় ঘটেনি। এমনকি এসব রোগ ও বিপদ নানা সমাজে নানাভাবে যে গুজব ও আতঙ্ক তৈরি করে তার কোনো বিশ্লেষণ কী করণীয় আমাদের বৈশ্বিক কর্মপন্থা হিসেবে ঠিক হয়নি। কিন্তু এটি করা জরুরি।

ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, আগুন, ধূলিদূষণ কী বিষাক্ত বায়ু একের পর এক বিছিয়ে যাচ্ছে আতঙ্ক আর অস্থিরতার জাল। শতসহ¯্র অস্থিরতার ভেতর আবার তৈরি হয়েছে করোনা আতঙ্ক। করোনার ঘটনা এমন পর্যায়ে গেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বৈশ্বিক সতকর্তা জারি করতে বাধ্য হয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে করোনার উপসর্গ গোপন বা ভুল তথ্যকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে চীন, এমনকি এর জন্য মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। করোনা নিয়ে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক রোধ করতে বাংলাদেশ সরকারও সতর্ক করেছে। কিন্তু আতঙ্ক কি কমছে? নাকি নিদারুণ অস্থিরতা আমাদের মগজ ও ধমনী থেঁতলে দিচ্ছে। কোনো রোগ ঘিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার এই সামাজিক মনস্তত্ত¡ কী? কেন এমন ঘটেই চলেছে। চিকুনগুনিয়া থেকে শুরু করে ডেঙ্গু কী এই করোনার কালে কেন মানুষ রাষ্ট্রকে বিশ্বাস করতে পারছে না? অস্থির, আতঙ্কিত ও বিষণ্ন হয়ে উঠছে? চলতি আলাপ করোনা ঘিরে তৈরি আতঙ্কের সামাজিক মনস্তত্ত্ব টি বুঝতে চায়। আর এই প্রশ্নের ফায়সালা না করে কোনোভাবেই একের পর এক নতুন রোগের আতঙ্ক সামাল দেয়া সম্ভব নয়। দুই. করোনা সংকটের শুরু থেকেই দেশের নানাপ্রান্তে নানা বয়সী নানা পেশার মানুষের সঙ্গে আলাপের সুযোগ হয়েছে। গ্রাম থেকে মফস্বল, রেলস্টেশন থেকে কারখানা কী বাজার, গলির মোড় থেকে নগরবস্তি করোনা আতঙ্কের নিম্নবর্গীয় গুঞ্জরণ বোঝার চেষ্টা করেছি। করোনা নিয়ে যেমন গুজব রটেছে, ছড়িয়েছে বর্ণবাদী আওয়াজ। করোনা ভাইরাস ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের লেখালেখি, মন্তব্য কী ভিডিওতে তুমুলভাবে এক তীব্র বর্ণবাদ উসকে উঠেছে। বিশেষত ‘চীনারা কী খায়’ এটিই এই পরিবেশনার কেন্দ্রীয় বিষোদগার। বাদুড়ের স্যুপ খাওয়ার এক ভুল ভিডিও এক্ষেত্রে ভাইরাল হয়ে যায়। পরে জানা যায় এটি ২০১৬ সালে করা ব্লগার ও পর্যটক শিল্পী মেনগিয়ান ওয়াং পালাওয়ের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সয়লাব হয়ে যায় পোকামাকড় আর নানা বন্যপ্রাণী খাওয়ার ভিডিও ও বর্ণবাদী বিবরণে। এই ধরনের পরিবেশনার একটি উদ্দেশ্য হয়তো ভাইরাসের উৎস খুঁজে বের করা, কিন্তু এসব পরিবেশনা আপাদমস্তক বৈষম্যমূলক বর্ণবাদী এবং জাল তথ্যে ভরপুর। কিন্তু গ্রামগঞ্জের মানুষ এসব পরিবেশনাকে কীভাবে নিচ্ছে? তথ্যের জাল কী সত্য বা উপস্থাপনার ক্ষমতার ময়দানে যারা বসত করে না তাদের কাছে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ‘চীনারা যা ইচ্ছে তাই খায়, পোকামাকড় সাপ-ব্যাঙ সবকিছু আর এ কারণেই তাদের করোনা ভাইরাস হয়েছে’। কারণ বাদুড় থেকে নিপাহ ভাইরাস, পরিযায়ী পাখি থেকে ফ্লু এবং মশা থেকে ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গু ছড়ানোর তথ্য এখন প্রতিষ্ঠিত। বাংলাতে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা ঘিরে ‘চীনাদের খাদ্যাভ্যাসকে’ আছড়ে ফেলেছেন তাদের মন্তব্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এসব মন্তব্য বন্যপ্রাণের ওপর প্রবল নাগরিক ভোগকে প্রশ্ন করে না। বরং তা কোনো দেশ ও জনগোষ্ঠীর খাদ্য-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে বর্ণবাদী আচরণকে প্রকট করে তোলে। আর এই প্রকট বর্ণবাদ কোনো নতুন কথা নয়, এটি ঐতিহাসিক এবং ঔপনিবেশিক। এখনো যারা রটাচ্ছেন বা বিশ্বাস করছেন ‘চীনারা যা ইচ্ছা তাই খায়’ তারা শৈশব পার করেছেন এই শোনে যে, চীনারা কুকুর, সাপ, ব্যাঙ যা পায় তাই খায়। একটি প্রচলিত গল্প হলো, যেখানে চীনারা যায় কোনো নির্মাণকাজে সেখানে কুকুরের বংশ শেষ হয়ে যায়। তো, চীনা খাদ্য-সংস্কৃতি ঘিরে এই বর্ণবাদী ময়দানে বড় হওয়া দেশের একটা বড় অংশ কেন অবিশ্বাস করবে চীনাদের বাদুড়ের স্যুপ খেয়ে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার জাল ভিডিওকে? কারণ এসব বর্ণবাদী বিশ্বাসের ভিতই তো তার ভেতর মজবুত করছে এই ব্যবস্থা। আশঙ্কার কথা হলো এই খাদ্য-খিস্তি চীনা থেকে দেশের ‘মঙ্গোলয়েড আদিবাসীদের’ ঘাড়েও এসে পড়েছে। তিন. খাবারের সঙ্গেই করোনা সংকটকে বিশ্লেষণে সামাজিক মাধ্যমের পাবলিক মনস্তত্ত¡ হলো ‘উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীনের প্রশ্নহীন আচরণের ফলাফল এই রোগ’। এর সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে চীনের অবস্থাকেও টেনে আনছেন অনেকে। সামাজিক মাধ্যম থেকে এই প্রবল চীনবিদ্বেষ চায়ের ঝুপড়িতেও শুনতে পেয়েছি। উইঘুর ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে চীনের অন্যায় আচরণ কী এভাবে কোনো রোগের সংক্রমণ ঘটাতে পারে? অনেকে উল্টো প্রশ্ন করেছেন তাহলে সৌদি আরবে উট থেকে মার্স এবং বাংলাদেশে মশা থেকে কেন ডেঙ্গু ছড়াল আর এত প্রাণ গেল? গুজব আর চীনা বিদ্বেষের পাশাপাশি আছে জীবাণু অস্ত্রসহ নানা গভীর ষড়যন্ত্র তত্তে¡র আলাপ। আরিচা ফেরিঘাটে এও শুনেছি চীন কমিউনিস্ট বলে, আর কমিউনিস্টরা নাস্তিক বলে এই ভয়াবহ বিপদে তারা মরতে বসেছে। চীন বিদ্বেষের মতো করেই একই ব্যাকরণে তীব্র ভারতবিরোধিতাও নানাভাবে উচ্চারিত হয়েছে কোথাও কোথাও। আমি কেবল ঘর থেকে বাহির, মাঠ থেকে ময়দান চারধারে চীন আর ভারতের বাজার দেখি। চীনা পণ্যের মাস্তানি দেখি। করোনা সংকটের কারণে দেশের বাণিজ্য থেকে উৎপাদন, অর্থনীতি থেকে প্রবৃদ্ধি সব নাকি রুদ্ধ হয়ে আছে। সামনে হয়তো এক অনিশ্চিত বাজারের নয়া মেরুকরণ। এর ভেতরেই হয়তো কেউ চীন হয়ে উঠবে? কিন্তু এভাবে কি দুম করে চীন হয়ে ওঠা যায়? চলতি আলাপ এদিকটাতে যাচ্ছে না। চার. যদি প্রশ্ন করা হয়, এ পর্যন্ত বাংলাদেশের কতজন করোনা সংকটের কারণে মরেছে? এর উত্তর না হবে। কিন্তু সাতক্ষীরার শ্যামনগরের পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাতাখালি গ্রামের রতন রপ্তানের পরিবারে এর কী জবাব হবে? রতন রপ্তান ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। গত ১০ ফেব্রুয়ারি দেশে ফেরার সময় ভোমরা স্থলবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় তার গায়ে জ্বর ও সর্দি-কাশি দেখা যায়। তাকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। তারপর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। হাসপাতাল থেকে আবার শ্যামনগরে তার খোঁজখবর নিতে বলা হয়। আবার বাড়ি থেকে তাকে সরকারি হাসপাতালে আনা হয়। এর ভেতর এলাকায় ‘গুজব’ রটে রতনের করোনা ভাইরাস হয়েছে, এখন পুলিশ তাকে গুলি করে মেরে ফেলবে (গণমাধ্যমে এ ভাষ্যটিই বেশি প্রকাশিত হয়েছে) এবং ইনজেকশন দিয়ে মেরে ফেলবে (শ্যামনগর স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকতার ভাষ্য)। এই গুজব শুনে রতনের মা রেণুকা রপ্তান (৫৬) একই রাতে আতঙ্কে মারা যান। তিনি অসুস্থও ছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, কেন রেণুকা রপ্তানরা এখনো এই গুজবকে বিশ্বাস করেন? এই প্রশ্ন আমাদের গভীর থেকে করা জরুরি। কথাসাহিত্যিক শিবব্রত বর্মণ ২০১৯ সালে বানিয়ালুলু গল্পে এক আজব বানোয়াট দেশের বিবরণ দিয়েছেন। যে দেশের গবেষণায় এক নিখোঁজ সাংবাদিক র‌্যাট স্মেলার হন্যে হয়েছিল। কিন্তু পাঠকরা তো এই বানোয়াট দেশকে বিশ্বাস করেনি। কিংবা যদি এখন কেউ গুজব রটায় আগামী তিন দিনের ভেতর বাংলাদেশ গিলে খাবে একদল রাক্ষস ও নিয়ানডার্থাল যুগের ডাইনোসার, কেউ কি এই গুজব বিশ্বাস করবে? কিন্তু করোনা বা এমন কোনো রোগ হলে পুলিশ কাউকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে এমন বানোয়াট গুজব কেন রেণুকা রপ্তান বিশ্বাস করলেন? এর কী কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই? দেশের নি¤œবর্গ কলেরা, কালাজ্বর কী বসন্তের মতো নির্দয় মহামারি পাড়ি দিয়েছে। রোগ ঘিরে নানা দুঃসহ স্মৃতি কী ‘পুলিশি আচরণের নানা পাবলিক ব্যাখা’ সবকিছু মিলিয়ে করোনা আতঙ্কের ‘গুজব’ কি আর গুজব থাকে? দেশের মানুষের মনের গহিনে জমা হতে থাকা দুঃসহ সব অবিশ্বাস আজ করোনার কালে তাকে আরো আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলছে। চিকুনগুনিয়া কী ডেঙ্গুর সময় আমরা দেখেছি সিটি করপোরেশন কত নিশ্চুপ, বাজার কত নির্লজ্জ। একের পর এক আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, এলিয়ে পড়ছে জীবন কিন্তু দরদর করে বাড়ল মশক নিবারণী নানা উপকরণের দাম। মশারি থেকে ক্রিম সব বন্দি হলো ধনীদের জিম্মায়। করোনার সংক্রমণ ছড়ানোর শুরুতেই বাংলাদেশে শুরু হলো মাস্কের আকাল। দাম বাড়ল অস্বাভাবিক। একই সঙ্গে বাড়ছে মশা, স্থবির মশকনিধন কর্মসূচি। তাহলে মানুষ বিশ্বাস রাখবে কিসে? কার ওপর? কেন মানুষ আতঙ্কিত হবে না? কেন গুজব রটবে না? গত ৫০ বছরে একের পর এক নানা রোগ ও মহামারি দুনিয়াময় সংকট তৈরি করছে যা একেবারে নির্মূল না হয়ে বারবার নানারূপে নানাভাবে নানা অঞ্চলে ফিরে আসছে। এসব রোগ ও মহামারি নির্মূলে এখনো কোনো কার্যকর বৈশ্বিক সমন্বয় ঘটেনি। এমনকি এসব রোগ ও বিপদ নানা সমাজে নানাভাবে যে গুজব ও আতঙ্ক তৈরি করে তার কোনো বিশ্লেষণ কী করণীয় আমাদের বৈশ্বিক কর্মপন্থা হিসেবে ঠিক হয়নি। কিন্তু এটি করা জরুরি। গবেষক ও লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App