×

মুক্তচিন্তা

ভোটতলায় বিএনপির অক্সিজেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২০, ০৬:২০ পিএম

সাদা চোখে এ অবস্থায় বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা। হয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর হতাশায় আরো মুষড়ে গিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া। নইলে দলকে গুছিয়ে জনবান্ধব কর্মসূচি দিয়ে আবার রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হওয়া; গোড়ালি শক্ত করে টিকে থাকা। সরকারি দল সব সময় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে সেটি পেয়ে চলছে। সেটির সদ্ব্যবহারের চেয়ে অসদ্ব্যবহার তারা বেশি করছে। সমালোচিতও হচ্ছে।

নির্বাচনবিষয়ক সব অভিজ্ঞতার আলোকে এখন ভোটের মাঠেই থাকতে চায় বিএনপি। কর্মীদের জন্যও তা স্বস্তিদায়ক-নিরাপদ। ভোটে যাওয়া, না যাওয়া, গিয়ে ফিরে আসা বা বয়কট, ফলাফল প্রত্যাখ্যান কোনো অভিজ্ঞতাই বাদ যায়নি তাদের। সেই অভিজ্ঞতা ও লাভালাভের হিসাবে বিএনপি স্থির হয়েছে জাতীয়, স্থানীয়, উপসহ সব নির্বাচনের মাঠে থাকার সিদ্ধান্তে। মন্দের ভালো হিসেবে এটি কৌশলও তাদের। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না, নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় জালিয়াতি করে জয় ছিনিয়ে নেবে সরকারি দল- এমনটি নিশ্চিতের পরও চট্টগ্রাম সিটি, ঢাকা-১০সহ উপনির্বাচনী মাঠ দাবড়াচ্ছে বিএনপি। কেন এমন স্ববিরোধিতা দলটির? পরাজয় জেনেও কেন বয়কট বা প্রত্যাখ্যান না করে বারবার ভোটে আসা? ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনেও বিএনপি এ কাণ্ডই করেছে। কী তাদের উদ্দেশ্য? বলা হচ্ছে- হারিয়ে দেয়া হবে জেনেও গণতন্ত্র ও বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনের মাঠে থাকার এ সিদ্ধান্ত তাদের। বিষয়টা কি আসলে এত সিম্পল? ভোটতলায় বারবার মাথা ফাটিয়ে, নাকানি-চুবানি খাওয়া অব্যাহত রাখলে দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি কি নিশ্চিত?

গতবার গাজীপুর, রাজশাহী, সিলেট, কুমিল্লা, খুলনায় এর আগে জেতার পর বিএনপির মেয়ররা উল্টো নাজেহালের শিকার হয়েছেন। সিটি করপোরেশন চালাতে পারেননি। চেয়ারেও বসতে পারেননি ঠিকমতো। মামলার পর মামলায় দফায় দফায় জেল খেটেছেন। এমন জেল খাটার চেয়ে ফেল করা ভালো ছিল বলে অনেকের রসিকতাপূর্ণ মন্তব্য। এমন দুর্গতির বিনিময়েও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীরা দম নিঃশ্বাস নিতে পারছে ভোটের মাঠে থাকার সুবাদে। গত জাতীয় নির্বাচনে গোহারার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, তারা সংসদে যাবেন না। পরে গেছেন। তবে তিনি নিজে ছাড়া। বগুড়ার পাস করা আসনটি ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এর পেছনে নিশ্চয়ই কোনো হিসাব ছিল-আছে। সংসদে গেলে নির্বাচনের ফলাফলকে বৈধতা দেয়া হয়, এটি তারা জানেন। সংসদে না গেলে তারা বাইরে থেকে ‘অবৈধ সংসদের’ নিন্দা-সমালোচনা চালিয়ে যেতে পারবেন সেটাও তারা জানেন।

বাংলায় প্রবাদ আছে ন্যাড়ায় বারবার বটতলায় যায় না। বেলতলায় গেলে কী হয়-ন্যাড়া সেটা একবারেই বুঝে ফেলে। ন্যাড়া বলতে ভোলাভালা ধরনের নিরীহকে বোঝায়। যেখানে দেশের মানুষও ন্যাড়া হয়ে এখন ভোটবিমুখ। ২০০৯ সালের জানুয়ারির পর জাতীয় বা আঞ্চলিক সব নির্বাচনেই প্রার্থী কম, ভোটার কম, ভোটও কম। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসল-নকল মিলিয়ে ভোট পড়েছিল ৪০ শতাংশ। এর বেশি দেখাতে পারেনি তখনকার নির্বাচন কমিশন। তাতে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৪৬ জনের বিনা চ্যালেঞ্জে বিজয়ী হতে কোনো অসুবিধা হয়নি। সেবার ক্ষমতাসীন দলের ২৬৫ জন বিজয়ী বলে ঘোষিত হন। ২০১৮ সালের শেষের নির্বাচনে আরো কম ভোটার হলেও এক দলের সর্বাধিক প্রার্থী-২৯২ জন জয়ী হন। এমন নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যেও কেন বারবার স্থানীয় বা জাতীয় নির্বাচনে যায় বিএনপি?- ছোট, কিন্তু মোটাদাগের প্রশ্ন।

বিএনপি মোটেই ন্যাড়া বা ভোলাভালা নয়। জনপ্রিয়-বিশাল দল। তাহলে গোলমাল বা ব্যতিক্রমটা কোথায়? ২০১৪ সালে না গেলেও পরে কেন বারবার তাদের এই ভোটতলায় যাওয়া? ভোটগাছের নিচে গিয়ে তারা কষ্ট পায়। নির্বাচন কমিশনের চাতুরি দেখে। এর প্রতিবাদে আন্দোলনের হুঙ্কার দেয়। নেতারা মামলা-হামলায় পড়েন। জেল খাটাসহ নানা আজাব ভোগেন নেতা, কর্মী, সমর্থক সবাই। এর বাইরে যাওয়ার উপায়ও যেন নেই দলটির। বলা হয়ে থাকে, বিএনপি গত নির্বাচনে গিয়েছিল দলের নিবন্ধন বাঁচাতে। পরপর দুবার নির্বাচন না করলে দলের নিবন্ধন থাকে না, সেই আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বিএনপিকে বাদ দিয়ে আওয়ামী বিএনপি দাঁড় করত সরকার। কারো কারো মতে, বর্তমানে বিএনপি সরকারি ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে নয়। একটু ভিন্ন ধাঁচে জাতীয় পার্টির মতো আওয়ামী লীগের মিস্ট্রেসে পরিণত হতে যাচ্ছে। এ কারণে ‘যা হয়েছে তা ভালো হয়েছে, যা হচ্ছে তাও ভালো হচ্ছে এবং যা হবে তাও ভালোই হবে।’ এমন একটা অপেক্ষায় আল্লাহর কাছে বিচার দেয়া ছাড়া তাদের আর গতিও অবশিষ্ট নেই।

আরেকটা গতি হচ্ছে- বারবার ভোটতলায় গিয়ে নাক-কানসহ মাথা ফাটিয়ে সরকারের যাত্রা ভঙ্গ করতে। ভোটগাছের যন্ত্রণাদায়ক কাঁটায় বিদ্ধ হয়ে কাতরাতে কাতরাতে সরকারের ভোট ডাকাতি-জালিয়াতির কাণ্ড জনগণকে নিয়মিত দেখাতে। কিন্তু তাতে সরকারের যাত্রা ভঙ্গ হয় না। শত্রু কুপোকাতের আনন্দে সরকার ডেম কেয়ারেই এগিয়ে যাচ্ছে বীরদর্পে। টানা এক যুগেরও বেশি ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি না নির্বাচনে, না মাঠে, না কৌশলে- কোনোভাবেই প্রতিপক্ষের সঙ্গে কুলাতে পারছে না। তারপরও ভোটের মাঠে থাকা লাভজনক বিএনপির জন্য।

মাঠে থাকতে পারাও এক ধরনের বিজয়। চিপা মাইর থেকে বাঁচতে পারছে দলের অ্যাকটিভ কর্মীরা। নানা অভিমান থাকলেও তারা দল কর্মসূচি দিলে শেষ পর্যন্ত তাতে শামিল না হয়ে পারে না। এ ধরনের কর্মীরা মার খেতে খেতে অব্যক্ত যন্ত্রণায় কাহিল। যে মারে রক্ত বের হওয়া ছাড়া বাকি প্রায় সবই হয়। জয়েন্টে-পয়েন্টে, গিরায়-শিরায় খবর হয়ে যাওয়ার চিপা মার থেকে তারা রক্ষা পাচ্ছে ভোটের উছিলায়। প্রার্থীদের আগে-পিছে থেকে মুভ করতে পারছে।

বিএনপির ভোটতলায় আসা ও থাকার এ সুফলভোগী কর্মীরা সম্প্রতি বেশ উৎফুল্ল। তাদের কাছে ভোট এখন একটা অনুভ‚তির নাম। মাঠে থাকতে পারার সময়ের নাম। ভোট পাওয়া বা দেয়া-নেয়ার বিষয় নয়। প্রার্থীর হারা-জেতার চেয়ে নিজেদের কয়েকটা দিন মাঠে থাকতে পারার আনন্দ অনেক বেশি। আবার প্রার্থীসহ নেতারাও ধন্য। ঢাকা সিটি নির্বাচনের উছিলায় মাঠ দাবড়িয়েছে। বাসা-বাড়িতে থেকেছে। পুলিশের তাড়া খায়নি। যা মাস কয়েক আগে ভাবাও যায়নি। তখন লুকিয়ে থাকার জায়গাও জুটেনি দলটির নেতাকর্মীদের অনেকের নসিবে। সেই দুঃসহ যন্ত্রণা জয় হয়েছে বিএনপির। রাজনৈতিক বিশাল এ জয়ের ফলে বিএনপি লাভবান। বিশেষ করে বিএনপির দুই প্রার্থী ইশরাক হোসেন ও তাবিথ আওয়াল নির্বাচনের আগেই ঢাকা সিটির রাজনীতিতে তারকা বনে গেছেন। আগামী দিনের রাজনীতিতে তারা আরো সুফল পাবেন নিশ্চিত। মাঠে বিচরণের পাশাপাশি ক‚টনীতিকদের সঙ্গে বেশি করে ওঠাবসার সুযোগও হয়। ক‚টনীতিকরা প্রার্থীর বাসা পর্যন্ত চলে আসেন। ঢাকা সিটি নির্বাচনে একজন প্রার্থীর বাসায় এক পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতের ছুটে যাওয়ায় অনেকে অবাক হয়েছেন। প্রার্থী ধন্য হয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, নিষ্ঠুর বাস্তবতায় পদে পদে বিএনপির পথ কণ্টকাকীর্ণ। অনেকটা বন্দি বা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও টিকে থাকা। সেটাও মন্দের ভালো। নিঃশ্বাস নিতে পারার প্রশ্নে লাভজনক।

সাদা চোখে এ অবস্থায় বিএনপির সামনে দুটি পথ খোলা। হয় নির্বাচনে পরাজয়ের পর হতাশায় আরো মুষড়ে গিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া। নইলে দলকে গুছিয়ে জনবান্ধব কর্মসূচি দিয়ে আবার রাজনীতির ময়দানে সক্রিয় হওয়া; গোড়ালি শক্ত করে টিকে থাকা। সরকারি দল সব সময় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহারের সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগ নিরবচ্ছিন্নভাবে সেটি পেয়ে চলছে। সেটির সদ্ব্যবহারের চেয়ে অসদ্ব্যবহার তারা বেশি করছে। সমালোচিতও হচ্ছে। বিএনপি সেই সুফল নিজেদের আমলনামায় নিতে পারছে না। ক্ষমতার সুযোগ বিএনপিও পেয়েছে। ব্যবহারও করেছে। কিন্তু টিকতে পারেনি। আওয়ামী লীগ পারছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App