নাম বললেই ফোনে রিচার্জ পাঠান অন্ধ মিজান!
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২০, ০৬:৪৪ পিএম
বাবা-মার সঙ্গে অন্ধ মিজানুর রহমান
অন্ধ মিজানুর রহমানের দোকান। ছবি: মাসুদ পারভেজ
নাম তার মিজানুর রহমান। জন্ম থেকেই সে অন্ধ। বর্তমানে তার বয়স ২৫ বছর। কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত টাঙ্গারিপাড়া গ্রামে তার জন্ম। বাবার নাম মোনতাজ আলী। মায়ের নাম মোমেনা খাতুন। দুই ভাই বোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোট বোন মরিয়মের বিয়ে দেয়া হয়েছে। প্রবল আত্মবিশ্বাস ও স্মরণশক্তির মাধ্যমে উপজেলার টাপুরচর বাজারে মোবাইলে টাকা রিচার্জ, বিকাশে টাকা আদান-প্রদানের ব্যবসা করেন। তা করেই জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড লাগে টাকা রিচার্জ করতে। দীর্ঘদিন ধরে এ কাজ করলেও একবারও ভুল করেনি। মোবাইল নম্বর লেখে রাখার প্রয়োজন হয় না। পরিচিত মানুষের প্রায় পাঁচ হাজার মোবাইল ফোন নম্বর মুখস্থ তার। ওই এলাকার অধিকাংশ লোকজন জন্মান্ধ মিজানুরের কাছেই মোবাইলে টাকা রিচার্জ করেন। রিচার্জ করতে গেলে নম্বর না বলে ব্যক্তির নাম বললেই টাকা চলে যায় মোবাইলে ফোনে।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম নেয়া মিজানের পড়ালেখার ইচ্ছা থাকলেও পড়াশোনা করতে পারেননি। এ দুঃখ তাকে ক্ষতবিক্ষত করে। তাই বাধ্য হয়ে টাকা উপার্জনের পথে নামে। শুরুর দিকে তাকে নানা ধরনের অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তিনি অসম্ভবকে জয় করতে পেরেছেন। চোখে না দেখে মোবাইল ফোনে টাকা লেনদেন করা হয় কীভাবে?
এ বিষয় জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, কোন বাটনে কোন সংখ্যা এটা মোবাইল সেটের উপর হাত রেখে বলে দিতে পারি। ব্যবহার করতে করতে আমার সব জানা হয়ে গেছে। রিচার্জ করার ক্ষেত্রে মোবাইলে কোন বাটন টিপতে হবে, কোন অপশনে যেতে হবে সেটাও আমার জানা আছে । বর্তমানে আমি ইউনম্যাক্র, ওয়ালটন ও নোকিয়া কোম্পানির সেট ব্যবহার করছি। এতে আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
বিকাশে (ব্র্যাক ব্যাংক, মোবাইল ব্যাংকিং) বা রকেটে (ডাচবাংলা মোবাইল ব্যাংকিং) টাকা পাঠাতে কোনো সমস্যা হয়না। শুধু ইনকামিংয়ের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির হট লাইনে কথা বলে নিশ্চিত অথবা অন্য কারো সহযোগিতা নিতে হয়।
[caption id="attachment_206216" align="aligncenter" width="700"] বাবা-মার সঙ্গে অন্ধ মিজানুর রহমান। ছবি: মাসুদ পারভেজ[/caption]পার্শ্ববর্তী দোকানদার জিহাদ আহমেদ বলেন, সাধারণ ব্যবসায়ীদের মতোই মিজান কাজ করছে। গ্রাহকদের সঙ্গে টাকা লেনদেনে কোনো ঝামেলার ঘটনা ঘটেনি।
ঘর মালিক চাঁন মিয়ার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি যখন জানতে পারি অন্ধ মিজান মোবাইলে টাকা রিচার্জ করতে পারে, তখন আমার একটি দোকানঘর তাকে ব্যবসা করার জন্য দেই। সে যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তার কাছে ঘরভাড়া বাবদ কোনো টাকা নিব না।
মিজানের বাবা মোনতাজ আলী বলেন, সে জন্ম থেকেই অন্ধ। চিকিৎসার জন্য তাকে উলিপুর, রংপুর ও দিনাজপুর চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে গেছি। চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার চোখের অপারেশন করতে চেয়েছিল, কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে মিজানের অপারেশন করা সম্ভব হয়নি। অভিযোগ করে বলেন, মেম্বার ও চেয়ারম্যানের কাছে কয়েক বার গিয়েছিলাম তারা আমার ছেলেটাকে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে কোনো সাহায্য করেনি। বর্তমানে সে টাকা উপার্জন করে পরিবারকে সাহায্য করছে।
বন্দবেড় ইউনিয়নের ইউপি চেয়ারম্যান কবীর হোসেন জানান, এ বিষয় আমি জানি না, তবে খোঁজ-খবর নিয়ে আমার পরিষদ থেকে যতটুকু সাহায্য সহযোগিতা করার প্রয়োজন আমি তা করবো।
উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহমুদা আকতার স্মৃতি বলেন, অন্ধ মিজানুরের বিষয় নিয়ে আমার কাছে কেউ আসেনি। সরেজমিনে গিয়ে সত্যতা পেলে অবশ্যই তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, মিজানুর আসলেই জন্মন্ধ, ইতোমধ্যে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে দেয়া হয়েছে।