×

জাতীয়

ঝুঁকিতে সাইবার নিরাপত্তা

Icon

nakib

প্রকাশ: ০২ মার্চ ২০২০, ০৯:৪২ এএম

তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে দ্রুত ছুটে চলা বাংলাদেশের সামনে সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে সাইবার অপরাধের কারণে। দেখা দিচ্ছে নানা সংকট। ২০২১ সালে এ ক্ষতি বছরে ৫১০ লাখ কোটি টাকায় ঠেকতে পারে। যে কারণে উন্নত দেশগুলো সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রতি বছরই তাদের বাজেট, গবেষণা ও সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। তবে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ডিজিটাল থ্রেট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘রিস্কআইকিউ’-এর ২০১৯ সালের ১৫ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সাইবার অপরাধের কারণে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ২ দশমিক ৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (৮৫ টাকা প্রতি ডলার হিসাবে ধরে প্রায় ২৪ কোটি ৬৫ লাখ টাকা) আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, যা বছরের হিসাবে ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন বা দেড় লাখ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে বিশে^র শীর্ষ সাইবার নিরাপত্তা-সংক্রান্ত পরামর্শদাতা প্রতিষ্ঠান হারজাভেক গ্রুপের ২০১৯ সালের বার্ষিক সাইবার ক্রাইম রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৫ সালে এ কারণে বিশ্বে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা ও ইন্টারনেট পরিচালিত যন্ত্রপাতির ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ঝুঁকিও বাড়ছে ব্যাপকভাবে। ২০২১ সালে এ ক্ষতির পরিমাণ ৬ ট্রিলিয়ন বা ৬ লাখ কোটি মার্কিন ডলার হতে পারে। টাকার অঙ্কে যা ৫১০ লাখ কোটি টাকায় দাঁড়ায়।

সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপরেখা বাস্তবায়নের ফলে ইন্টারনেট, অটোমোশন, আইওটি প্রভৃতির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে মানুষের। এখন শুধু ব্যাংক-বিমা নয়, ছোটখাটো অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের লেনদেনও হয় ইন্টারনেটে। হাতে হাতে থাকা মোবাইল ফোনে করা যায় অনেক কিছু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবাধ বিচরণ শহর থেকে গ্রামের মানুষের। আর এসবের সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকিও বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যৎ যুদ্ধের একটা বড় অংশ হবে সাইবার জগৎজুড়ে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ বিস্তারের চেষ্টাও হবে এই মাধ্যমে। ৯০-এর দশকে ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার আক্রমণকে অনেকে উদহারণ হিসেবে দিয়ে থাকেন। তখন ইরানে মাটির হাজার ফুট নিচে আণবিক গবেষণাগারের ক্ষতি করা হয়েছিল কোনো বোমা ফেলে নয়, ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাস দিয়ে ইউরেনিয়াম আলাদা করার সেন্ট্রিফিউজ তৈরির যন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এইটিএইট ইনোভেশনসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জোবায়ের কবির বলেন, বিভিন্নভাবে সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। মনে করি, কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে এক সপ্তাহের জন্য কক্সবাজার বেড়াতে গেলেন। এতে সেখানে তাকে টার্গেট করা শত্রুদের জন্য সহজ হতে পারে। কিংবা বাড়ি না থাকার নিশ্চিত খবরে পাশের বাড়ির বখে যাওয়া ছেলেটা সব চুরি করে নিয়ে যেতে পারে। অন্যদিকে নিরাপদভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার না করার কারণে হ্যাকারদের হাতে চলে

যেতে পারে পাসওয়ার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, যা দিয়ে আর্থিক ও সামাজিকভাবে কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যায়। তিনি বলেন, সাইবার অপারাধীদের কারণে আমাদের গোপনীয়তা, তথ্য ও অর্থের ক্ষতি হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। সন্ত্রাসীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। বিশ্বজুড়েই এসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তবে আমাদের দেশে গুজব প্রতিরোধে সরকার যতটা সচেষ্ট, অন্যান্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ততটা তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। ডিজিটাল থ্রেট মোকাবিলায় আমাদের সচেতনা ও রিসোর্সের অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

একই ধরনের অভিমত দেন আরেক বিশেষজ্ঞ, সফটওয়্যার কোম্পানি ফিন ইঞ্জিনের চিফ টেকনোলজি অফিসার আবদুল জলিল। তিনি বলেন, আমাদের দেশে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই উপেক্ষিত। প্রায় শতভাগ ব্যবহারকারীই পাইরেটেড বা বিনামূল্যে অখ্যাত কোম্পানির সফটওয়্যার করে থাকেন। আর ৫০ ভাগ প্রতিষ্ঠানেই ফায়ারওয়াল ব্যবহার করা হয় না। ৮০ শতাংশ ব্যাংক-বিমাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে সচেতন। তবে সেখানেও নিরাপত্তার ত্রুটি রয়েছে। নইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটত না।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) গবেষণা থেকে জানা যায়, দেশের মোট ব্যাংকের ৫০ ভাগ সাইবার নিরাপত্তায় নেক্সট জেনারেশন ফায়ারওয়াল (এনজিএফডব্লিউ) সফটওয়্যার পুরোপুরি স্থাপন করতে পারেনি। সাইবার অপরাধীদের ধরতে আরো শক্তিশালী সাইবার পুলিশিংয়ের ওপরও জোড় দেন তিনি। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, অপরাধীরা এখন অনেক বেশি কৌশলী। তাদের প্রতিরোধ করতে আমাদের আরো দক্ষ হতে হবে। নীতি সহায়তা দিতে হবে। তিনি বলেন, সাইবার পুলিশকে অনেক যন্ত্রপাতি দেয়া হলেও প্রায়ই এসবের স্মার্ট ব্যবহার দেখা যায় না।

তবে শুধু গুজব প্রতিরোধে নয়, সাইবার অপরাধ মোকাবিলায়ও সরকার যথেষ্ট তৎপর বলে মনে করেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার। তিনি বলেন, নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রথমে আমরা শূন্যে বসবাস করতাম। সেখান থেকে এখন আমরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছি। ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সি তৈরি করা হয়েছে। আইনের সঙ্গে আইনগত অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো যথেষ্ট সচেতন রয়েছে। তবে বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সাইবার নিরাপত্তায় সোশ্যাল মিডিয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন তিনি। সাইবার অপরাধ মোকাবিলায় বাংলাদেশের কারিগরি দুর্বলতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এটি গোড়া থেকেই ছিল। আমরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এ বিষয়ে সতর্কও করেছি। আশা করি, নিজেদের স্বার্থেই সবাই এ বিষয়ে সচেতন হবে। তবে সরকার মূলত আইনগত ও অন্যান্য অবকাঠামোগত সুবিধা ও সচেতনতা তৈরি করে এ বিষয়ে ভূমিকা রাখছে। সাইবার পুলিশিংয়েও দেশ অনেক এগিয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

এদিকে সাইবার অপরাধ ঠেকাতে শুধু পুলিশের তৎপরতা যথেষ্ট নয় বলে মনে করেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে এখন শিশু জন্মের হারের চেয়ে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলার হার বেশি। এখন দেশে ১০ কোটির বেশি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা দরজা-জানাল খুলে দিয়েছি ঠিকই কিন্তু এর ফলে আলো যেমনি প্রবেশ করেছে, তেমনি কিছু জীবাণুও এসেছে। সেটা হলো সাইবার ক্রাইম। তিনি বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার করে যেন সাইবার বুলিং, উগ্রবাদ, ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো না যায় সে বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে সাইবার ক্রাইমের বিস্তার রোধে পারিবারিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকা জরুরি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App