×

মুক্তচিন্তা

দিল্লিতে অশান্তির আগুন লাগাল কে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:২৪ পিএম

কলকাতার মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে কলকাতার দাঙ্গা। সেসব দিনের স্মৃতি, অনুভব, মনে ছাপ-পড়া ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণাকে যা অনেকটাই প্রভাবিত করছে। কিন্তু সামগ্রিক স্মৃতি যেভাবে দানা বাঁধে, তা ত্রুটিমুক্ত নয়। কীভাবে বাংলার দুই সম্প্রদায়কে আজ প্রস্তুত করা হচ্ছে, তা এক বহুমাত্রিক প্রশ্ন, যা বহুমাত্রিক উত্তর দাবি করে
দিল্লিতে বাড়ছে মৃত্যু মিছিল। নাগরিক জীবন বিড়ম্বিত। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৪৩। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে উত্তাল উত্তর-পূর্ব দিল্লি। পক্ষে ও বিপক্ষের বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ, গোলাগুলিতে দেড়শরও বেশি মানুষ জখম হয়েছেন। পরিস্থিতি ক্রমে খারাপ হয়েছে দেশের রাজধানী দিল্লিতে। প্রশ্ন উঠছে, প্রশ্ন উঠছে ভারতজুড়ে। দিল্লিতে অশান্তির আগুন লাগাল কে? কেন ৭২ ঘণ্টা পরও উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিস্তীর্ণ অংশে ছড়িয়ে পড়া অশান্তির আগুন নেভাতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ দিল্লি পুলিশ? কেন পুলিশের চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে দফায় দফায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ? কেন সংঘর্ষের খবর করতে গিয়ে দিনের আলোতে মার খাচ্ছেন কর্তব্যরত সাংবাদিকরা? কীভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর সামনেই জ্বালিয়ে দেয়া হলো পেট্রল পাম্প, দোকানপাট, আগুন লাগিয়ে দেয়া হলো অগুনতি বাড়িতে? কীভাবে পুলিশের সামনেই প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি চালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতরা? কেন হামলার আগাম গোয়েন্দা সতর্কতা থাকা সত্তে¡ও মার্কিন প্রেসিডেন্টের দিল্লি সফরের সময়ে রাজধানীর জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করল না কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক? আম-জনতার মনে তৈরি হওয়া প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেউ। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি একবার মোদিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন, শাসকের ধর্ম কী। কিন্তু সেই শিক্ষায় বাকিরা যে শিক্ষিত হননি তা আজ স্পষ্ট। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মিরের মতো একটি সন্ত্রাস বিপন্ন অঞ্চলকে ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে ফেললেন আর মার্কিন প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের মধ্যে এ ধরনের হাঙ্গামা হলে তার দপ্তরকেই তো মানুষ দায়ী করবে। এ ঘটনায় বিজেপির অন্দরেও প্রবল ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বিজেপি বিধায়ক কপিল মিশ্রের ভ‚মিকা নিয়ে। রবিবার উত্তর-পূর্ব দিল্লির জাফরাবাদ এলাকায় সিএএ-বিরোধী ধরনা সমাবেশে গিয়ে ধরনা প্রত্যাহারের জন্য এলাকার লোকদের রীতিমতো হুমকি দিয়েছিলেন কপিল মিশ্র তিন দিনের মধ্যে ধরনা তোলা না হলে, ফল ভুগতে হবে। কপিল মিশ্রের হুঁশিয়ারির পরে ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই শুরু হয় গোষ্ঠী সংঘর্ষ। মঙ্গলবার খোলাখুলিই নিজের ক্ষোভ ব্যক্ত করেছেন পূর্ব দিল্লির বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীর। তার কথায়, ‘দিল্লির এই অশান্তি মানা যায় না। যেই এই অশান্তি সৃষ্টি করে থাকুক, তার কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। কংগ্রেস-বিজেপি বা আপ, এটা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে খাপ খায় না। কপিল মিশ্রের বক্তব্যকে সমর্থন করছি না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। লাগাতার ৭০ দিন ধরে চলা শাহিনবাগের সিএএ-বিরোধী ধরনা বা দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় যে ক্ষতি করতে পারেনি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজধানীতে থাকাকালীন উত্তর-পূর্ব দিল্লির অশান্তি সেই ক্ষতিই করেছে দল ও কেন্দ্রীয় সরকারের। তাই চুনোপুঁটি কপিল মিশ্রকে বলির পাঁঠা করে পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইছে শাসক দল। কিন্তু দিল্লি নির্বাচনের প্রচারপর্বে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ শাহিনবাগের প্রতিবাদীদের ধাক্কা দেয়ার কথা যেভাবে জোর গলায় বলেছিলেন, হিন্দুত্ববাদী জনতা যে তাকে মুসলমান-নিগ্রহের আহ্বান হিসেবে এবং মুসলমানরা পাল্টা ছবক শেখানোর উসকানি হিসেবে যে গ্রহণ করেনি তা জোর গলায় কে-ই বা বলতে পারে। যদি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজধর্ম বিচ্যুত হন তাহলে তো প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপই বিধেয়। নাগরিকদের প্রতি সমদর্শী হওয়ার রাজধর্ম থেকে বিচ্যুতির বিষফল এমনই ভয়ানক হতে পারে তা প্রধানমন্ত্রীর আগেই আন্দাজ করা উচিত ছিল। কারণ তিনি বলেন যে দল নয়, দেশ আগে। তাহলে ‘দেশ’ ধারণাটির মধ্যে যে মুসলিমদের ঠাঁই অবশ্যম্ভাবী এই কথাটি কি তার অভিধানে লেখা নেই? এর ফলশ্রুতি কী ঘটেছে? দিল্লি পুলিশ নিরপেক্ষতার ভড়ংটুকুও বিসর্জন দিয়ে গুণ্ডাদের নৃশংসতা চলাকালীন তারা নিষ্ক্রিয় থেকেছে। পুলিশের নাকের ডগায় বন্দুকবাজের গুলি চালনা প্রতিটি ঘটনাই দিল্লি পুলিশের পক্ষপাতকে স্পষ্ট করছে প্রতি মুহূর্তে। ক্রমে যে পরিস্থিতির দিকে আমরা এগোচ্ছি তা স্বাধীনতার আগে ও পরের দাঙ্গা পরিস্থিতির দিকে। মনে করুন ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার দাঙ্গা, মনে করুন ১৯৪৬ সালের ১০ অক্টোবরে শুরু হওয়া নোয়াখালীর দাঙ্গা, ১৯৪৬ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া বিহারের দাঙ্গা, ১৯৫০, ১৯৬৪ সালে বরিশালে মুসলিম-হিন্দু ধর্মীয় দাঙ্গা, ১৯৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি কাশ্মিরে রাসুলুল্লার (সা.) রক্ষিত একটি চুল অপহরণ গুজবে বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ দাঙ্গা, ১৯৯২-এ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে সংঘটিত ভয়াবহ দাঙ্গা। কী পেয়েছি আমরা এই দাঙ্গা থেকে? পাইনি কিছুই। বরং হারিয়েছি পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও মানুষের প্রতি বিশ্বাস, ভালোবাসা ও দায়বোধ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এই দাঙ্গা সংঘটিত হওয়ার মূল কারণ পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা ও পক্ষাবলম্বন। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে লালবাজারে পুলিশ হেড কোয়ার্টারে বসেও পুলিশকে সক্রিয় করতে পারেননি। যে কোনো দাঙ্গার প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা গেছে রাজনৈতিক নেতাদের অসহিষ্ণু ও উসকানিমূলক কথা এই পরিস্থিতি উদ্ভবের মূল কারণ। রবীন্দ্রনাথ একদা হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শনি তো ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই।’ সেই অমোঘ সত্যকথন আজো ভারতবর্ষকে তাড়া করে চলেছে। কলকাতার মানুষের সামগ্রিক স্মৃতিতে গভীরভাবে গেঁথে গিয়েছে কলকাতার দাঙ্গা। সেসব দিনের স্মৃতি, অনুভব, মনে ছাপ-পড়া ছবি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বয়ে চলেছে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের ধারণাকে যা অনেকটাই প্রভাবিত করছে। কিন্তু সামগ্রিক স্মৃতি যেভাবে দানা বাঁধে, তা ত্রুটিমুক্ত নয়। তাই প্রায়ই দেখা যায় অনেক জটিল, বহুমাত্রিক ঘটনার একটা সহজ, একমাত্রিক কারণ খাড়া হয়ে গিয়েছে। উসকানিতে উত্তেজিত হওয়ার জন্য মানুষকে প্রস্তুত করতে হয়। কীভাবে বাংলার দুই সম্প্রদায়কে আজ প্রস্তুত করা হচ্ছে, তা এক বহুমাত্রিক প্রশ্ন, যা বহুমাত্রিক উত্তর দাবি করে। কিন্তু একটা বিষয় বোঝা খুবই সহজ যতভাবেই এই উপমহাদেশে হিন্দু ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন আসুক না কেন, জাত-ধর্ম নির্বিশেষে ক্ষতি বরাবর এই উপমহাদেশের সাধারণ মানুষেরই হয়েছে। দাঙ্গা, রক্তপাত, ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হওয়া, স্বজন হারানো এসবই ভারতবর্ষ বিভাজনের ফলাফল। ২০০৬ সালে নিজের প্রকাশিত বই ‘ওফবহঃরঃু ধহফ ঠরড়ষবহপব’ নিয়ে আলোচনার সময় নিউইয়র্ক পোস্টে দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে অমর্ত্য সেন বলেন, ‘কোনো একক পরিচয়ের ভিত্তিতে করা যে কোনো শ্রেণিবিভাগ একটি নির্দিষ্ট উপায়ে মানুষের মেরুকরণ করে। কিন্তু আমরা যদি মাথায় রাখি যে ধর্ম ছাড়াও আমাদের ভাষা, পেশা, ব্যবসা, রাজনীতি, শ্রেণি ও দারিদ্র্য ছাড়াও আরো বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন রকম পরিচয় রয়েছে, তাহলে একজনের মেরুকরণ আরো বৃহত্তর চিত্র দ্বারা প্রতিহত করা সম্ভব।’ তিনি আরো বলেন, আমার মনে পড়ে ১৯৪০-এর হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় আমি যখন শিশু, তখন আমি বাংলায় (সেন তখন ঢাকায় ছিলেন) ছিলাম। দাঙ্গার শিকার যারা হতো, তারা প্রায়ই একটা অভিন্ন শ্রেণি পরিচয় বহন করত। যারা মারা পড়ত, তারা হয় মুসলিম গরিব, নয়তো হিন্দু গরিব হতো। তারা আরো একটা ধর্মহীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করত সেটি হলো বাংলা ভাষা। আর তাই এটি মোটেও আশ্চর্যজনক নয় যে ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলাদেশে বেশি জরুরি হয়ে পড়ল। তাই আজ আমরা সিঁদুরে মেঘ দেখছি। এই সংঘর্ষ যদি দাঙ্গায় রূপ নেয় তা কিন্তু হবে ভয়ঙ্কর। সেই আগুন থেকে শুধু ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও অগ্নিসংযোগ হতে পারে। ছড়িয়ে পড়তে পারে বাংলাদেশে, যার ফলে চ‚ড়ান্ত অস্থিরতা এবং একে প্রতিহত করতে হবে আমাদেরই। তাই দিল্লির আগুন দিল্লিতেই নিভে যাক, ছড়িয়ে না পড়ে যেন। অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App