×

সাময়িকী

সৃষ্টির অঙ্কুরোদ্গমে বসন্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৩:১৬ পিএম

সৃষ্টির অঙ্কুরোদ্গমে বসন্ত

বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ বলা হয় কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি অনেক। কিন্তু তার মনোপূত উত্তর কি পেয়েছি কারো কাছে? স্বয়ং শ্রী রবীন্দ্রনাথ, যিনি নানা বৈচিত্র্যে চিত্রিত করেছেন বসন্তকে তাঁর অবিনাশী গানে, কথাসাহিত্যে ও কবিতায়; তাতেই কি ‘ঋতুরাজ’ প্রশ্নের মীমাংসায় পৌঁছাতে পেরেছি? বসন্ত ঋতুতে আমাদের প্রকৃতিতে অনেক ফুল ফোটে; বিশেষত শিমুল, পলাশ, অশোক এসব উজ্জ্বলবর্ণ ফুল আমাদের প্রকৃতিকে রাঙিয়ে দেয়। বনে বনে সবুজের সমারোহে আবীরবরণ পলাশ, পথের দুপাশে রক্তবর্ণ শিমুল আর অশোককাননে বর্ণিল ফুলের উপস্থিতি রাঙিয়ে দিয়ে যায় সংবেদনশীল সৃজনপ্রয়াশী মানুষের অন্তর। ভাঁটফুল, বনটগরের বর্ণিল উপস্থিতি গাঢ় সবুজ গ্রামবাংলাকে তারকাখচিত করে তোলে অনিন্দ্য সৌন্দর্যে। ফুলের এই সমারোহই কি বসন্তকে ‘ঋতুরাজ’ অভিধায় অভিসিক্ত করেছে? বসন্তের তুলনায় আমাদের অন্যান্য ঋতুতেও কম ফুল ফোটে না, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা বেশিই ফোটে; তবে অন্য ঋতুর ফুলেরা বসন্তফুলের মতো ততটা প্রগাঢ়-উজ্জ্বল নয়। কিন্তু কেবল ফুলবাহারে বসন্তকে ঋতুরাজ ডাকাকে কিছুতেই যৌক্তিক মনে হয়নি; আমি বরং বসন্তের স্বাতন্ত্র্য খুঁজেছি বসন্তরোদে, বসন্তের নিজস্বতা খুঁজেছি বসন্তবাতাসে, বিষণ্ণ-সুগন্ধ আমের বোলে, প্রকৃতির আনমনা চারিত্র্যে, নিজস্বতা খুঁজেছি ‘মধুর মিলনে’ আর ‘রোদনে’।

কবিতার জন্ম যেমন বার্তা দিয়ে আসে না, কবির জন্মই তাই; তবু কবির জন্মকাল বসন্তে। বসন্তকে চিত্রিত করতে রবীন্দ্রনাথ যেমন লেখেন- ‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/ মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে...’(মায়ার খেলা), তেমনি লিখেন, ‘রোদনভরা এ বসন্ত সখী, কখনো আসেনি বুঝি আগে...’(চিত্রঙ্গদা)। ঋতুচক্রে বঙ্গাব্দের শেষপ্রান্তে আসে বসন্তকাল। রবীন্দ্রনাথ বসন্তকে আবাহন করে লিখেছেন, “এস’ এস’ বসন্ত, ধরাতলে।/ আন’ মুহু মুহু নব তান, আন’ নব প্রাণ নব গান্/ আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ।/ আন’ বিশ্বের অন্তরে নিবিড় চেতনা।/ আন’ নব উল্লাসহিল্লোল।/ আন’ আন’ আনন্দছন্দের হিন্দোলা ধরাতলে।/ ভাঙ’ ভাঙ’ বন্ধনশৃঙ্খল।/ আন’ আন’ উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা ধরাতলে।/ এস’ থরথরকম্পিত মর্মমুখরিত নবপল্লবপুলকিত/ ফুল- আকুল মালতীবল্লিবিতানে- সুখছায়ে, মধুবায়ে।/ এস’ বিকশিত উন্মুখ, এস’ চির-উৎসুক নন্দনপথচিরযাত্রী।/.......এস’ নগরে প্রান্তরে বনে।/ এস’ কর্মে বচনে মনে। এস’ এস’।/ এস’ মঞ্জরীগুঞ্জর চরণে।/ এস’ গীতমুখর কলকণ্ঠে।/ এস’ মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে।/ এস’ কোমল কিশলয়বসনে।/ এস’ সুন্দর, যৌবনবেগে।/ এস’ দৃপ্ত বীর, নবতেজে।/ ওহে দুর্মদ, কর জয়যাত্রা,/ চল’ জরাপরাভব সমরে/ পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,/ চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে \” (গীতবিতান)

প্রকৃতির আনমনা আবহের সাথে বসন্তে আকুলকণ্ঠে গেয়ে ওঠে কোকিল, পাখিরা নীড় রচনা করে বসন্তে এবং মিলনে আকুল হয়; সন্ধ্যায় জোনাকের বাতি জ্বলে ওঠা গ্রামে গ্রামে- অরণ্য-জঙ্গলে; সব মিলিয়ে যেন ঋতুবতী হয়ে ওঠে প্রকৃতি। প্রকৃতি ঋতুবতী হবার সাথে সাথে যা-কিছু প্রাকৃতিক সবাই চঞ্চল হয়ে ওঠে; প্রত্যেকেই খুঁজে নিতে চায় আপন প্রেয়সীর মন, প্রেয়সী প্রকৃতিও আকুল মিলনাকাক্সক্ষায়। মিলন থেকেই তো সৃষ্টির অঙ্কুরোদ্গম। কবিচিত্তের সেই মিলনাকাক্সক্ষার আর্তিই হয়তো উচ্চারিত হয়েছে রবীন্দ্রগীতে। বসন্তের এই উতলা করার সামর্থ্য, উন্মনা করার শক্তি আর সাথে আছে বসন্তের নাতিশীতোষ্ণ আবহ; বসন্তের এই ঋতুবতীরূপ, নীলাকাশের পটভূমিতে উজ্জ্বল বর্ণিল ফুলের সমারোহ; কোকিলের আকুল করা সুর, জোনাকের আলো ঝলমল সন্ধ্যা, পাখিদের ডাকাডাকি আর পত্রপল্লবহীনতার হাহাকার থেকে নতুন পাতার আগমনী; সব মিলিয়েই বসন্ত হয়ে উঠেছে অনন্য সৌন্দর্যমণ্ডিত এক সময়কাল। ঋতুবতী বসন্তের সমস্ত আড়াল ভেঙে মিলন প্রত্যাশায় কবি খুঁজে নিতে চান দৃশ্যের অধিক।

দৃশ্যের অধিক যিনি দেখেন, তিনিই কবি। সাদা চোখে একজন মানুষ যা দেখেন কবি তারচেয়েও বেশি দেখেন; সরল অর্থে কথাটি নিশ্চয়ই সর্বাংশে সত্য নয়; কিন্তু কবির কবিতায় যখন কোনো দৃশ্যকল্পে স্বতন্ত্র ব্যঞ্জনার স্বাদ আস্বাদন করেন পাঠক, তখনই কবিদৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য সম্পর্ক পাঠকের চিন্তার বাঁক বদলে যায়। কবির উপস্থাপনশৈলীতে মুগ্ধ হন পাঠক, কবির কবিতা পড়ে চমৎকৃত হন, বারবার পড়ে কবিতাকে হৃদয়ঙ্গম করে নিতে সচেষ্ট হন। এটি ঘটে কবির পর্যবেক্ষণ গুণের কারণে। উন্মনা বসন্তের ঔদাসিন্যের পর্দা খুলে কবি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে পঙ্ক্তি নির্মাণ করেন, যে পঙ্ক্তি পাঠ করে পাঠক বুঝে নিতে চান, কবি তার কথাটিই অনিন্দ্য সুষমায় উচ্চারণ করেছেন। এভাবেই বসন্ত হয়ে ওঠে কবিতার নিজস্ব ঋতু। কবিতার পঙ্ক্তিতে কবি হৃদয়াকুতিকে মেলে ধরেন তার আকাক্সক্ষার কথা। কবিতার মোড়কে আড়াল করে বসন্তের কথা বলা হলো বটে, কিন্তু বসন্তের উদাস বাতাস আর হৃদয়সিঞ্চনী আবহ কেবল কবির হৃদয়ই নয়, বরং সাধারণের মনও তোলপাড় করে; তখন সে চঞ্চল হয়ে অনুসন্ধান করে নিজের ভেতরে কেন এত চঞ্চলতা, কেনো অস্থিরতা? কেউ হয়তো খুঁজে পায়, কেউ পায় না; কিন্তু কিছুতেই সে অগ্রাহ্য করতে পারে না বসন্তের মন উচাটন করা শক্তিকে; অগত্যা আত্মসমর্পণ করে বসন্তের কাছেই।

বসন্ত ঋতুর প্রভাববিষয়ক এ আলোচনায় আরও একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করে আলোচনার ইতি টানতে চাই; কবির প্রত্যাশা কল্যাণের পক্ষে, শুদ্ধতা ও সুন্দরের পক্ষে; মানবজীবনের গূঢ় সত্যের উন্মোচনে সাহিত্যের যে লক্ষ্যের কথা উচ্চারিত হয়েছে বারবার; সে গূঢ় সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে পাঠকের নানাবিধ প্রত্যাশা পূরণের পাশাপাশি মানবহিতের বিষয়টিকে নিশ্চিত করার কাজে ব্রতী কবিকুল বসন্তের আকুলতা থেকে নির্মাণ করেন কবিতার পঙ্ক্তি। সত্যের সাথে জ্ঞানের মিথষ্ক্রিয়ায় অধঃপতিতদের বোধোদয় প্রর্থনা করেন; আমাদের কল্পনার গভীরে তন্দ্রাচ্ছন্ন সৃষ্টিপ্রবণ শক্তির মুক্তি ঘটুক; গঠনমূলক সমালোচনায় সোচ্চার হোক বিদগ্ধ প্রাজ্ঞজনেরা; বিজ্ঞানমনষ্ক আধুনিক আবহে কূপমণ্ডুকতা-ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তি পাক সুশীল সমাজ। প্রতিটি কবিতা হোক প্রত্যেক কবির স্বপ্নের সমান বিস্তৃত। কবিপ্রাণে এ সত্য উন্মোচিত হয় তার কবিজন্মের মধ্য দিয়ে। যে জন্ম হয় তার বসন্তে।

বসন্ত ঋতুর প্রভাব নিয়ে কবি ও কবিতাবিষয়ক অকিঞ্চন এ আলোচনার পরও, উপসংহারে বলি- কবিতা যত্ন চায়, কবিতা দহন চায়- গ্রহণ চায়, মগ্ন হতে বলে কবিতা। কবিতা ক্ষরণ চায়, নিবেদন চায়, প্রণয়-নৈবেদ্য চায় প্রতিদিন-সারাক্ষণ। কবিতা মুগ্ধতা চায়, অভিনিবেশন প্রার্থনা করে, সতর্কতা চায় কবিতা। কবিতা প্রত্যয় চায়, আত্মবিশ্বাস চায়; আত্মপরিচয় চায়, স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল থাকতে চায় প্রতিদিন। কবিতা জীবনের গান গায়, হাঙরের মুখ থেকেও যেন ফিরে আসে প্রতিটি জীবন। কবিতা জীবনের সপক্ষে দাঁড়ায়। কবিতা সংগ্রাম চায়, উজান গাঙে গুন টেনে নিতে বলে কবিতার নাও। কবিতা ধৈর্য চায়-সহিষ্ণুতা চায়, কবিতা সংযম চায়, পরিমিতি চায়। অস্থিরতায় কবিতা ক্লিশে হয়ে পড়ে, ক্ষীণ-রুগ্ণ হয় পড়ে। কবিতাবৃক্ষকে বেড়ে ওঠার অবসর দিতে হবে। এক মাসেই ফলবতী হবে কবিতাবৃক্ষ তেমনটি প্রত্যাশা করলে রক্তশূন্যতায় কবিতার অকাল মৃত্যু হবে। পূর্ণ ফল পেতে চাইলে কবিতাবৃক্ষকে ঋতুবতী হবার সুযোগ দিতে হবে।

পৃথিবী ঋতুবতী হলেই তো সৃষ্টির অঙ্কুরোদ্গম; পৃথিবীর ঋতুকাল বসন্তেই তাই প্রত্যেক কবির জন্ম হয় নিজের চৈতন্যের গভীরে। কাঙালের প্রতি পক্ষপাত নেই কবিতার, বিত্ত-বেসাতের কাছেও নেই নগ্ন আনুগত্য। করুণায় কবির ঘৃণা। কবিতা স্বপ্ন-স্বয়ম্বরা অযত্নে কবিতা বাহারী-বর্ণিল হলেও মরা; প্রত্যাখ্যাত কবিতা মৃত প্রজাপতি হয়ে পড়ে থাকে পথের ধুলায়। কবিতা নিজস্ব সবুজ খুঁজে পেতে চায় কবির প্রতিটি পঙ্ক্তির ভিতর। কবিতাচারিত্র্য হঠকারিতায় বিপন্ন না হয়, কবিতা তাই প্রত্যাশা করে একজন সৎ কবির কাছে। আসুন আমরা সবাই কবিতার প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হই! বসন্ত কীভাবে ধরা দেয় কবির চেতনায় সে কথাটি একটি কবিতা উদ্ধৃত করে বুঝে নেয়ার পাশাপাশি কবিজন্মের সত্যটাকে আবিষ্কার করতে চাই।

কৈশোরে বসন্ত আসে কোকিলেরা গানে গলা সাধে দখিনা বাতাস শিরীষের বীজাধারে নূপুরের ধ্বনি কাঁদে দরোজায় কড়া নেড়েছিলো গোলাপ বিদায়ী শীতের সকাল উদাস দুপুর ডেকেছিলো বনে যেতে আমলকির পত্রশূন্য ডাল বহেরার শাখা হাহাকার করেছিলো নতুন পত্রপল্লব চেয়ে উদাস ব্যাকুল বাউল হারিয়ে গিয়েছিলো বিরহের গান গেয়ে; মেহগিনি সড়ক কেবল ডেকেছিলো বিরহিনী বালুচর যখন ফুটেছে কুঁড়ি শিমুলের ডালে জন্মেছিলে তুমি প্রিয় কবিবর।

সব্জি-আনাজের টালে পোকার প্রকোপ বসন্ত এসেছে বলে খরগোশ পালায় নিরাপদে-কৌশলে ঝোপের তলে বসন্তে এমন উচাটন মন রোদনের মায়ামন্ত্রধ্বনি হৃদয়তন্ত্রীতে বাজে সারাক্ষণ অজানা সিম্ফোনি বসন্ত সেজেছে রিক্ত নিরাশ্রয় ভিখারিণী সাজ কোনো দেবতার বরে না জানি সে হয়ে ওঠে নিঃস্ব ঋতুরাজ। (বসন্ত আবাহন/ ফরিদ আহমদ দুলাল)

তাই বলি, সৃষ্টির অঙ্কুরোদ্গম অব্যাহত রাখতে প্রকৃতির উদাসকরা পুষ্পময় ঋতুর পরিচর্যা চাই; আমাদের অপরিণামদর্শিতা যেন কিছুতেই প্রকৃতির স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে ব্যাহত না করে, সে বিষয়ে আমরা সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে সচেতন থাকি। বসন্তের সৃষ্টিশীলতা বছরের অন্যান্য ঋতুতেও যেন প্রবাহিত হয় প্রবল ধারায়। বসন্ত শেষেই তো আমরা গাই- তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক এসো এসো...

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App