×

সাময়িকী

মহাদেশের মতো এক দেশে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০২:৪৬ পিএম

মহাদেশের মতো এক দেশে

চারপাশে নীল সমুদ্র, নীল ঊর্মিমালার নিরন্তর ধুয়ে দেওয়া অসংখ্য সৈকত, তার মাঝে টেবিলের মতো উঁচু একটি দেশ, তার নাম অস্ট্রেলিয়া। এতটাই বড়ো যে সে নিজেই একটি মহাদেশের গৌরব আদায় করে নিয়েছে। বালক বয়সে যখন প্রথম ভ‚গোলক দেখি, তাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কত যে দেখেছি, বিষুবরেখায় আড়াআড়ি বিভক্ত দুটি গোলার্ধের দক্ষিণটিতে অনেকটা নিচুতে বলে তাকে দেখতে হতো ঘাড় বাঁকা করে। সে-ই যখন গ্রহটির সর্বদক্ষিণ বসবাসযোগ্য ভূখণ্ড, যেখানে দক্ষিণ মেরু থেকে উড়ে আসে পেঙ্গুইন পাখি, বরফশীতল জলে খেলা করে সি-লায়ন, নোনা বাতাসে উড়ে বেড়ায় সি-গাল, যার ভ‚মির উপর দিয়ে দৌড়ায় পৃথিবীর এক বিরল প্রাণী, পেটের থলেতে শিশু নিয়ে লাফানো ক্যাঙারু, হেঁটে বেড়ায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পাখি উটপাখি, পাখি হয়েও যে উড়তে পারে না। রয়েছে মধ্যিখানের বিপুল মরুভ‚মিময় না-বৃক্ষ, না-সবুজ অঞ্চলকে চারদিকের সকল প্রান্ত জুড়ে সবুজ বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে রাখার নিসর্গ। অমন মহাদেশে ভ্রমণের আকাক্সক্ষা কার না হয়, হোক না মহাসমুদ্রের বাধা, আকাশউড়ালপথ পৃথিবীর সকল প্রান্তকে নিকটবর্তী করে তুলেছে প্রায় অতিলৌকিক দ্রুততায়।

তাই ব্রিসবেন থেকে আমার ঢাকা মেডিকেল কলেজ জীবনের সহপাঠী, চিকিৎসক বন্ধু পারভেজ খান যখন লং ডিসট্যান্স কলে আহবান জানাল সে দেশ ভ্রমণের, মন আমার নেচে উঠল ইবনে বতুতার মতো সমুদ্রযাত্রার আনন্দে। বেড়াবার জন্য আমার দুপা সর্বদাই প্রস্তুত, ডানা থাকলে বলতাম, পাখা উড্ডয়ন আকাক্সক্ষায় উদগ্রীব। পারভেজকে বললাম, আমি তো দু’ডানা মেলেই আছি, সীমাবদ্ধতা হলো- বড়ো স্বপ্নের খরচাপাতিও বড়ো।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের কে-৩৭ ব্যাচের বন্ধুদের অস্ট্রেলিয়ায় আন্তর্জাতিক গেট-টুগেদার আয়োজনের এই পরিকল্পনা এককভাবে পারভেজেরই। প্রাথমিক উদযোগও তারই। ইতালির মিলানে কে-৩৭ ব্যাচের প্রথম আন্তর্জাতিক মিলনমেলাটি সফলতা ও আনন্দের সঙ্গে সমাপ্ত হলে তা দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিল পারভেজ। ‘ডযধঃ ধনড়ঁঃ অঁংঃৎধষরধ?’ সে জিগ্যেস করেছিল। অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের ব্যাচের ছয়জন চিকিৎসকবন্ধু স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। সুতরাং তাদের সম্মিলিত উদযোগে দ্বিতীয় আন্তঃমহাদেশিয় গেট-টুগেদার সফল করা কঠিন হলেও অসম্ভব হবে না।

কারও কারও নিরুৎসাহী কথা শুনে পারভেজ বিষণ্ণ বোধ করে। তাকে উজ্জীবিত করে তোলে বাংলাদেশ থেকে আসা বৃহত্তম দলটি। ইউরোপ যখন দ্বিধান্বিত, এশিয়া তখন এগিয়ে আসছে; ইউরোপীয় ঘোলাটে আবহাওয়ায় এশিয়া প্রখর রৌদ্রের উজ্জ্বলতা নিয়ে এলো, পারভেজের মুখও উজ্জ্বল হলো।

যারা অস্ট্রেলিয়ায় গেট-টুগেদারের ব্যাপারে দ্বিধান্বিত ছিল, তাদের দুটি যুক্তির প্রধানটি হলো বাংলাদেশিদের অস্ট্রেলীয় ভিসা পাবার স্বল্প সম্ভাবনা। দ্বিতীয় কারণ, বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় টাকা ট্রানান্সফারের জটিলতা। পারভেজ ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, স্বপ্ন বাস্তবায়নে সকল বাঁধা ডিঙ্গাতে প্রস্তুত। ভিসা পাবার অনিশ্চয়তা পারভেজ ভিন্ন অস্ট্রেলিয়ার অন্যদেরও সংশয়ের ভেতর ফেলে দেয়। পৃথিবীর ভ‚গোলের মৌলিক পাঠ যারা নিয়েছেন তারা জানেন উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে ঋতুচক্রটি ঠিক বিপরীত। উত্তরে যখন শীত, দক্ষিণে তখন বসন্ত বা গ্রীস্ম। পারভেজ চাইল সম্মিলনটি ডিসেম্বরে হোক যখন প্রকৃতি রৌদ্রকরোজ্জ্বল, দিন প্রলম্বিত, বাতাস মৃদু শীতস্পর্শের অনুভ‚তি জাগানিয়া, বাগান পুষ্পসৌন্দর্যে নয়নকাড়া, মানুষ উষ্ণ হৃদয়, মানবীরা সকল বাহুল্য ছেড়ে স্বর্গাদপিগরিয়সী।

বিলেতের বন্ধুদের কেউ কেউ প্রস্তাব পাঠাল, ডিসেম্বরের পরিবর্তে জুলাইয়ে, বিলেতে যখন উষ্ণ ঋতু তখন অস্ট্রেলীয় শীতশিবিরে মাথা গুঁজে দেবার বাসনা সংবলিত প্রস্তাবনা। বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট, যারা দলে ভারী, পারভেজের ডিসেম্বর পরিকল্পনার প্রতি তাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করল। এর প্রধান কারণ, ডিসেম্বরেই তাদের ছানাপোনাদের বিদ্যাপীঠগুলোতে শীতকালীন ছুটি থাকে। জুলাই না ডিসেম্বর- এ নিয়ে শেষাবধি ভোটাভুটি হলো যাতে বিপুল ভোটে ডিসেম্বর জিতে গেল, জুলাইয়ের জামানত বাজেয়াপ্ত হবার উপক্রম।

পারভেজ যখন পুনরপি বিমর্ষ, স্রোতের বিরুদ্ধে রণক্লান্ত, তখন বাংলাদেশ দল তার পেছনে এসে দাঁড়াল। তারা সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নিল (না, পরিবার পরিকল্পনার বিপরীতে পরিবার স¤প্রসারণের মাধ্যমে নয়), আগে যারা তালিকায় ছিল না, তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ইউরোপ যে আশঙ্কা, ব্যক্ত করেছিল, তাই যেন সত্যি হতে চলল। ভিসা প্রক্রিয়া যাতে সহজ হয়, সকলে একসঙ্গে ভিসা নামক পুলসিরাতটি একত্রে পার হতে পারে, সেজন্য সে একজন ভিসা এজেন্ট নিয়োগ করে। সব কিছু চলছিল ভালোই, ভ্রমণেচ্ছুরা তাদের কাগজপত্র পাঠাতে শুরু করল, পারভেজ তার সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে ভিসা এজেন্টের কাছে দিচ্ছিল। তিনি সেগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলেন।

বিপত্তি বাঁধল, বা বলা যায় প্রথম সুনামি, প্রথমে জমা দেওয়া মোট ২০টি ভিসা এপ্লিকেশনের ১৭টিই বাতিল হয়ে গেল, পার পেল তিন নারী (বোঝা যাচ্ছে, ষধফরবং ভরৎংঃ নিয়মটি স্বর্গেও বহাল থাকবে।) পারভেজ অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় এমপির মাধ্যমে, অভিবাসন মন্ত্রীর সঙ্গে, সাক্ষাৎ করে তাকে পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে বললে মন্ত্রী আশ্বস্ত হন এরা কেউ জাহাজের খোলের ভেতর লুকিয়ে সাগর পাড়ি দেয়া বাংলাদেশি অভিবাসী প্রত্যাশী নয়, এরা এমন গরিবও নয় যে কাজের খোঁজে অস্ট্রেলিয়ায় থেকে যাবে। তিনি দিল্লির ভিসা অফিসকে কড়াভাবে বলে দিলেন চিকিৎসকদের এই দলটিকে ভিসা দেবার জন্য।

ভিসা প্রাপ্তির এই অনিশ্চয়তা মূল সংগঠক পারভেজ খানকে আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিল, কেননা ব্রিসবেনে হিলটন হোটেল, গোল্ডকোস্ট ও সিডনির হোটেল, কেয়ার্ন্সে সমুদ্র ভ্রমণের জাহাজ, ব্রিসবেন থেকে কেয়ার্ন্স, কেয়ার্ন্স থেকে ব্রিসবেন এবং গোল্ডকোস্ট থেকে সিডনি ওড়ার বিমান- সবকিছুই অগ্রিম বুক করে রাখতে হচ্ছিল। অগ্রিম বুকিংয়ের সুবিধা হলো কম মূল্যে টিকেট বা রুম পাওয়া যায়।

ডিসেম্বরে ভ্রমণঋতু যখন পয়মন্ত, যখন সকল বন্দরেই উপচে পড়া যাত্রী থাকবে, তখন জায়গা পাবার অনিশ্চয়তা যেমন অধিক, তেমনি অধিক সকল টিকেটের মূল্য। যেহেতু বড়ো একটি দল যাচ্ছে (তখন অনুমিত সংখ্যা ছিল ১৫০ জন), গ্রুপ ডিসকাউন্টও পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু গ্রুপ বুকিংয়ের একটি শর্ত হলো ন্যূনতম একটি সংখ্যার টিকেট আংশিক কেটে রাখা, যার অনেকটাই, যাত্রা বাতিল হলেও, ফেরৎ পাওয়া যায় না। ব্রিসবেন থেকে শুরু করে কেয়ার্ন্স, গোল্ডকোস্ট ও সিডনিতে থাকার হোটেল বুকিং, তিনটি ফ্লাইটের বুকিং মানি পারভেজকে দিতে হলো অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণে ইচ্ছুকদের পাঠানো টাকা থেকে, কিছুটা নিজের পকেট থেকে। সুতরাং যখন অনেকেই নাম প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করল, ভিসা প্রাপ্তি হয়ে উঠল অনিশ্চিত, তখন পারভেজ পড়ে গেল মহাসংকটে, তার দৃঢ় ইচ্ছার পালেও লাগল ঝড়ো হাওয়া। ভিসা নিয়ে অভিবাসন মন্ত্রীর আশ্বাসের পরেও মেঘ কাটল না। পারভেজ তার ভিসা এজেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল প্রথম আবেদনে বাতিল হওয়া প্রার্থীদের জন্য পুনঃআবেদন করবে।

সকলের যাত্রা নিজ খরচে হলেও আমি চাচ্ছিলাম আমার খরচটি আয়োজকরা বহন করুক। প্রথমত, আমার সামর্থ্য ছিল না প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় করে মহাদেশ সফরে যাওয়ার, দ্বিতীয়ত, আমার জমজ পুত্রদ্বয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর দায়িত্ব ছিল। তৃতীয়ত, আমি ভেবেছিলাম আয়োজকরা নিজ অনুপ্রেরণায় এটা করবে কেননা তাদের উদ্যোগ ও ভ্রমণবৃত্তান্ত লিপিবদ্ধ করার আগ্রহ থাকার কথা। পারভেজের তা পুরোমাত্রায় ছিল, কিন্তু অন্যদের কাছ থেকে সে কোনো সাড়া পায়নি।

তখন পারভেজ আমাকে বলল, ‘কামরুল’, আমার একার পক্ষে তো তোমার পুরো খরচ বহন করা সম্ভব নয়, তুমি বিমান ভাড়াটা জোগাড় করো, অস্ট্রেলিয়া ট্যুরের ১৪০০ অস্ট্রেলিয়ান ডলার আমি দিয়ে দেব। আমার বিলেত সফর নিয়ে লিখিত ‘বিলেতের দিনলিপি’ তাকে উদ্দীপ্ত করে থাকবে, সে কায়োমনোবাক্যে চেয়েছে আমি যেন সফরে যোগ দেই এবং ‘অস্ট্রেলিয়ার দিনলিপি’ লিখি। বিমানভাড়াও প্রায় লক্ষ ছুঁই টাকার অঙ্ক, আমার পক্ষে সেটা জোগাড় করাও কঠিন। তখন কতিপয় বাংলাদেশি বন্ধুকে বলি এক লক্ষের এক-পঞ্চমাংশ করে দিতে, এরূপ পাঁচজন দিলেই টাকাটা জোগাড় হয়ে যায়। দুজন- ডা. বিকাশ ও ডা. জাকির- রাজি হয়, এবং দুজন কুড়ি কুড়ি করে চল্লিশ হাজার টাকা পাঠিয়েও দেয়। বাকি তিনজন আর মেলে না, কেউ কেউ অপারগতা জানায়, কেউ কেউ নীরবতার পথ অবলম্বন করে। নীরব থাকাদের দলে এমন দুজন আছেন যারা এক বিবাহবাসরে আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, এমন ব্যয়ভার বহন তাদের জন্য কোনো বিষয়ই নয়, এবং তারা সানন্দেই তা করবে। প্রকৃত প্রয়োজনের সময়ে এই দুজনের নীরবতা আমাকে অন্যদের চেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছে, কেননা তারা কথা দিয়েছিল।

পারভেজ জানাল বাতিল হয়ে যাওয়া ভিসাদলে আমিও আছি। আমি পুনর্বার আবেদন করব কিনা। পথে নেমে ফিরে যাওয়ার অর্থ নেই বিধায় আমি বলি, আমি পুনঃআবেদনে আগ্রহী। তখন পারভেজের অনুরোধে ভিসা ফির জন্য ১৫ হাজার টাকা ডা. তপনকে দিয়ে আসি, কেননা বাংলাদেশ চাপ্টারের অগ্রিম অর্থ তপনের মাধ্যমেই সংগৃহীত হয়ে পারভেজের কাছে যাচ্ছিল। প্রথমবারের ভিসা ফি পারভেজই দিয়েছিল, এমনকি ভিসা এজেন্ট ফিও। কেবল কেয়ার্ন্সে জাহাজ ভাড়ার অগ্রিম ১৫ হাজার টাকা আমার হয়ে ফোরামের সভাপতি ডা. মুজিবর রহমান দিয়েছিল। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চলছিল আমার ভ্রমণস্বপ্ন বাস্তবায়নের কাঁথা বুনন।

প্রথমবার ভিসা আবেদনের সময় কোনো কাগজপত্র দাখিল করতে হয়নি, দ্বিতীয়বার রাজ্যের সব কাগজপত্র চাইল অস্ট্রেলীয় ইমিগ্রেশন বিভাগ। প্রথমবার ভিসা জমা দিয়ে সপ্তাহ গুনছিলাম, প্রথম সপ্তাহে না হোক, দ্বিতীয় সপ্তাহে ভিসা পাব। যখন তৃতীয়, চতুর্থ হয়ে আমাদের অপেক্ষা পঞ্চম, ষষ্ঠ সপ্তাহে গড়াচ্ছিল, তখন পেলাম সেই দুঃসংবাদ। ভিসা আবেদন বাতিল হয়ে গেছে।

যাহোক, দ্বিতীয়বার ভিসার জন্য দাঁড়ালাম। প্রথমবার আমার সঙ্গে নজরুল ও তার স্ত্রী ছিল, দ্বিতীয়বার আমি একা। এমনি অনেকেই, এমনকি যারা ইউরোপ, আমেরিকা হরহামেশা যায়, তাদেরও পুনঃআবেদন করতে হচ্ছিল।

চলবে

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App