×

সাময়িকী

ভিন চোখে ‘আমার দেখা নয়াচীন’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০২:৫৫ পিএম

ভিন চোখে ‘আমার দেখা নয়াচীন’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত ‘আমার দেখা নয়াচীন’ এক বসায় পড়ে শেষ করলাম। বইটির খাতা পরিচিতি, ভূমিকা, মূল প্রতিপাদ্য, ‘আমার দেখা নয়াচীন খাতার নোটস’, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন-পঞ্জি, ১৯৫২, ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালের আলোকচিত্র, টীকা ও নির্ঘণ্ট সব মিলিয়ে পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৯৯। মনোজ বসুর বইয়ের তুলনায় বইটি নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্রাকৃতির। কিন্তু মনোজ বাবু ছিলেন জাত সাহিত্যিক আর শেখ মুজিব ছিলেন জাত রাজনীতিবিদ। তাই গাছের সাথে মাছের তুলনা না করাটাই প্রাসঙ্গিক।

বইটির ভূমিকা লিখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। আকর্ষণীয়ভাবে উত্থাপিত এই ভ‚মিকাটিতে আছে জাতির পিতার চীন ভ্রমণের পটভূমি, তাঁর সংগ্রামী জীবনের সামান্য কলমচিত্র এবং তারপরেই ২৫ দিনের চীন ভ্রমণের নাতিদীর্ঘ প্রসঙ্গ। তিনি দেখলেন চীনের মহান নেতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে নয়াচীনের জনগণ দীর্ঘ সংগ্রাম ও যুদ্ধ বিজয়ের মধ্য দিয়ে উন্নত ও শোষণহীন জীবনের সুযোগ পেয়েছে। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা মৌলিক চাহিদাগুলো মিটাবার জন্যে চীন সরকার বিপ্লবের পর কীভাবে উন্নতি লাভ করেছে এবং পরিবর্তন এনেছে আচরণে, সেসবও জানা যায় এ ভ্রমণ কাহিনী থেকে। এই ভ্রমণ কাহিনী অতি প্রাঞ্জল বর্ণনা দিয়ে তিনি পাঠকের কাছে উপভোগ্য করেছেন; প্রতিটি শব্দ, বাক্য, রচনায় যে পারদর্শিতা দেখি তাতে মুগ্ধ হয়ে যাই।’

বইটির ভূমিকাটিকে তার ‘গেইটওয়ে’ বলা যায়। সত্যিই তা পরবর্তী পাঠক-লেখক মিথস্ক্রিয়ার দরজা খুলে দিয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর খাতাগুলো কীভাবে রক্ষা পেয়েছে বা কীভাবে ভ‚মিকায় লেখক তা খুঁজে পেয়েছেন তার বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ না করলেও সংক্ষেপে উল্লেখিত হলে বইটির পাঠক গ্রাহ্যতা আরো বাড়তো। এমনকি অনভ্যাস বা নির্লিপ্ততার কারণে যারা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’র ধার ধারবে না তারাও সংক্ষিপ্ত পরিসরে তা জানতে পারতো। বইটির সাথে সংশ্লিষ্ট তারেক সুজাতসহ সকলকে তিনি যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন।

বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন সাচ্চা মুসলমান, তাই কমিউনিস্ট বিরোধী কিন্তু সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন যুবকাবস্থায়। তিনি মনে করতেন চীনের সমাজতন্ত্র যেভাবে ভাত-কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা গণমানুষের কাছে এনেছে, সর্বজনীন বেকারত্ব কমিয়ে এনেছে, ডাকাতির টুঁটি চেপে ধরেছে, দুর্নীতির মূলে আঘাত হেনেছে, বেশ্যাবৃত্তিতে কুঠারাঘাত করেছে। তিনি দেখেছেন, শুধু আইন বা প্রয়োজনে কণ্ঠরোধ করে পরিবর্তন সূচনা ও কাম্য আচরণ আনা; যা আবার আইনের নির্মোহ প্রয়োগ ও ব্যক্তির সততায় কাম্য লক্ষ্যেও উপনীতের পথ সুগম করে দিতে পারে। তিনি দেখেছেন এবং অনেকটা আশ্বস্ত হয়েছেন যে, বেকারত্ব নির্মূল সম্ভব এবং তা করলে দুর্নীতি, অভাব, অনটন, ভিক্ষাবৃত্তি, শোষণ-বঞ্চনা ও বেশ্যাবৃত্তি রোধ সম্ভব। আর এই বেকারত্বের অন্যতম প্রতিষেধক হিসেবে কুটির শিল্পের সর্বজনীন বিকাশ উচিত, আর কুটির শিল্প বলতে শুধু তাঁতশিল্প বা হ্যান্ডলুমকে ছাড়া অনেক কিছু বুঝায়। তাতে ভিক্ষাবৃত্তি কমে এবং ওয়ার্ক হাউস চালু করে ভিক্ষাবৃত্তি ও বেকারত্ব দূর সম্ভব। এছাড়া অন্ধ-আতুর ও প্রতিবন্ধীর জন্য বিনামূল্যে অন্ন, বস্ত্র, চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়। তিনি দেখেছেন ১৯৪৩ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব ওয়ার্ক হাউজ প্রবর্তন করে এই বাংলাদেশেই ভিক্ষাবৃত্তি রোধ ও দুর্ভিক্ষ মোকাবিলা করেছিলেন এবং প্রতিটি ওয়ার্ক হাউজকে লাভজনক কেন্দ্রে পরিণত করেছিলেন। চীনে আফিমখোরদের কীভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে, তার বর্ণনা তিনি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে গণআন্দোলন ব্যাপক ভ‚মিকা রেখেছে। ডাকাতিও জনসম্পৃক্ততায় বন্ধ হয়েছে, তবে শুধু জুলুম করে ও আইন করে ডাকাতি, বেশ্যাবৃত্তি, চুরি, খুনাখুনি, বিনা টিকেটে রেল ভ্রমণ জাতীয় অন্যায় কাজ বন্ধ করা যায় না, এর সাথে সুষ্ঠু কর্মপন্থারও প্রয়োজন।

চিয়াং কাইলেকের আমলে চীনে জমির মালিক জমিদাররাই ছিল। চাষির জমির ওপর কোনো অধিকার ছিল না। ক্ষেত মজুর বা বর্গাচাষি হিসেবে যে সামান্যতম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতো, তাও যখন-তখন কেড়ে নেয়া হতো। ভ‚মি ব্যবস্থাপনায় আইন বলে কোনো জিনিস ছিল না। জমিদাররা গ্রাম ছেড়ে শহরে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতো। মদ ও মেয়ে নিয়ে তাদের দিন কাটতো। জমি অনাবাদি রাখতো। জমির খাজনার বিনিময়ে কৃষক বা ক্ষেত মজুরের সুন্দরী কন্যাদের ভোগের সামগ্রী বানাতো। নয়াচীন সরকার কায়েম হওয়ার পর তারা প্রথম কাজ শুরু করলেন ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই নীতির প্রয়োগ। বড় বড় জমিদারদের অতিরিক্ত জমি বাজেয়াপ্ত করে গরিব ভ‚মিহীন কৃষকদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। সত্যিকারের কৃষক জমির মালিক হওয়াতে তার উৎপাদিকা বাড়লে সব অনাবাদি জমি চাষের আওতায় নিয়ে আসা হলো। তাতে বেকারত্ব দূর হলো। দুর্ভিক্ষের অবসান হলো। চুরি, ডাকাতি কমে গেল।

জমির ভাগ নারীরাও পেল এবং অনেকটা সমান সমান হারে। জীবন ও সমাজের অন্যত্র নারী-পুরুষে প্রায় সমতা নিশ্চিত করা হলো। বেতন ও মজুরির ব্যাপারেও এক ধরনের সমতার নিয়ম করা হলো। উচ্চ পর্যায়ের সাথে নিম্ন পর্যায়ের বেতনের ব্যবধান ১০ গুণে বেঁধে দেয়া হলো। কৃষকের পণ্যের দাম শিল্পের পণ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারিত হলো। তাই জমির আয় দিয়ে ভালো মানের জীবনযাপন সম্ভব হলো। একদিন যে চীনে খাদ্যাভাব লেগেই ছিল, আজ সে চীন খাদ্যে উদ্বৃত্ত ও রপ্তানিতে সক্ষম হলো। অধিক উৎপাদনক্ষম চাষিদের পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হলো। গ্রামে গ্রামে একে অন্যকে সাহায্যের জন্য মিউচুয়াল এইড সোসাইটি গড়ে উঠলো।

সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে গিয়ে তারা ধর্মীয় ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িকতার টুঁটি চেপে ধরেছে। অতীতে ধর্মীয় এক সম্প্রদায় অপর সম্প্রদায়কে শুধুমাত্র সংখ্যা গুনে শাসন করেছে, শোষণ করেছে। ভ‚মি সংস্কারের কারণে লাখো লাখো লোক কাজ পেয়েছে। কুটির শিল্প ও বৃহৎ শিল্পেও বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এই কর্মের অভাব বেশ্যাবৃত্তিতে উৎসাহিত করতো তখন। বিয়েতে যৌতুকপ্রথা ও বেশ্যাবৃত্তিতে সম্প্রসারিত করতো। দিনে দিনে সেসব বিলীন হচ্ছে। নারী-পুরুষের সমান অধিকার কায়েম হওয়ায় মেয়েদের ওপর যে অসম্ভব রকমের অত্যাচার পূর্বে হতো, তা চীনে আজ বাদ হয়ে গেছে। নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কলকারখানায়, সেনাবাহিনী এমনকি সরকারের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে। এখন তারা যাকে ইচ্ছে তাকে যৌতুক ছাড়াই বিয়ে করতে পারছে। নারী-পুরুষ প্রায় সমতা আনার কারণেই যৌতুকপ্রথা বিলুপ্তির পথে। সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মূল করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ৮০ ভাগ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি অন্যরাও জীবন-জীবিকায় সমনাধিকার পেয়েছে। জনগণের সাহায্য নিয়ে হোয়াংহো নদী বা চীনের দুঃখ ঘুচানো হয়েছে। নয়াচীনে দুর্নীতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা ঘুষ-দুর্নীতি দমনে বদ্ধপরিকর। তারা পরিবারের সদস্য ও নিকটাত্মীয়দের দুর্নীতির ব্যাপারে সহনশীল বা উদাসীন নয়। চীনে উপরি আয় বা বিনা টাকায় ব্যবসায়ের কোনো সুযোগ নেই। পারমিটের ব্যবস্থা বা মন্ত্রীর দালালি করে উপার্জনের উপায় নেই। গণচীনে ধর্মীয় রাজনৈতিক ব্যবহার উঠে গেছে। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা বিরাজ করছে। ধর্মনিরপেক্ষতা সমাজে ও রাষ্ট্রের সদিচ্ছায় চীনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা বন্ধ হয়েছে। ধর্মভিত্তিক বৈষম্য বিলুপ্তির পর সরকার সকল সম্প্রদায়ের সমর্থন পেয়েছেন।

ধর্মনিরপেক্ষতা তিনি অবলোকন করেছেন। সেখানের ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। ধর্ম যার যার দেশ সবার। এমনকি মুসলমানরাও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যসহ ও দল এবং দেশের উচ্চ পদে আসীন। ধর্ম নিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুসন্ধিৎসু মনের পরিচয় আমরা পেয়েছি। তিনি খাঁটি মুসলিম হয়েও নিজ ধর্মের বিশেষত ধর্মান্ধ ও কাঠ-মোল্লাদের ধর্মান্ধ ও ধর্ম বিরোধী, সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করেছেন। সমালোচনা করেছেন খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মের আচ্ছাদনে অপকর্মের, ফতোয়াবাজরা যে অর্থ নিয়ে ফতোয়া দিয়ে থাকে তা বলতেও তিনি ছাড়েননি। নয়াচীনের অনেক কিছুই বঙ্গবন্ধুর ভালো লেগেছিল। ব্যতিক্রম শুধু কমিউনিস্ট মতবাদ। নয়াচীন সরকার কমিউনিস্ট মতবাদ ছাড়া অন্য কোনো মতবাদের লোকদের রাজনীতি করতে দেয় না। অন্য কোনো আদর্শের দল সৃষ্টি করার অধিকার কারো নাই।

এই জীবনবোধ থেকেই হয়তো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে তিনি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্রের পথ ধরেছিলেন। তিন বছরের নিরীক্ষায় ব্যর্থ হয়ে তিনি এক দলীয় বাকশাল ধরেছিলেন। এ ব্যবস্থা করতে পারলে তো আমাদের বাংলাদেশে আশির দশকেই আজকের বাংলাদেশের দেখা মিলতো। কিন্তু কুচক্রী মহল, সা¤্রাজ্যবাদের দালাল, কায়েমী স্বার্থবাদীরা তাঁকে বাঁচতে দিলো না। চীন সফরে গিয়ে তিনি চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের মাত্রাতিরিক্ত নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। মাও সে তুংয়ের মতো এত জনপ্রিয় নেতাকে শেষ করার মতো দেশে-বিদেশের কুচক্রীদের অভাব নেই বলে জাতীয় স্বার্থেও চেয়ারম্যানকে এত নিরাপত্তা দেয়া হয়েছিল। স্থানিক আইনশৃঙ্খলা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় চীনের পঞ্চায়েত ব্যবহারে তিনি সমর্থক ছিলেন। এমনকি সকল পর্যায়ে জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে অর্পণের পক্ষপাতীও ছিলেন।

তিনি দেখেছেন চীনের সরকারের কাজের একটা কায়দা আছে। তারা সকল কাজেই জনগণের সাহায্য চায়। জনসম্পৃক্ততা দিয়ে ভ‚মি সংস্কার, শিল্প উৎপাদন, অনেকটা দুঃসাধ্য কাজও স্বেচ্ছাশ্রমে সম্পাদন করে চলেছে। এই কৌশলেই তারা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এনে উদ্বৃত্ত রপ্তানিও করেছে। অপরাপর কৌশলে আবাস, শিক্ষা, খাদ্য ও চিকিৎসা নিশ্চিত করেছে চীনের সরকার ও সরকারি কর্মচারীরা এসব ব্যবস্থা করতে বাধ্য, ব্যর্থতায় শাস্তিরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বইটির উপসংহারে তিনি বলেছেন, ‘ভাত কাপড় পাবার ও আদায় করে নেবার অধিকার মানুষের থাকবে, সাথে সাথে নিজের মতবাদ প্রচার করার অধিকারও মানুষের জানা প্রয়োজন চাই। তা না হলে মানুষের জীবনবোধ হবে পাথরের মতো শক্ত। এই দর্শন থেকেই তিনি তার শাসনামলের বিরাট অংশ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সহাবস্থান নিশ্চিত করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যর্থতার যোগসূত্র ধরে তিনি বাকশাল ব্যবহার প্রবর্তন করেছিলেন। তদানীন্তন দেশজ বা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বেকারত্ব নির্মূল, দুর্নীতি দমন ও ত্বরিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নিয়ামক হিসেবে সেটাই ছিল যথার্থ। সুযোগটা নিয়েছিলেন, সময়টা ছিল বৈরী তবে এ ব্যবস্থা কার্যকর করা গেলে ৮০ দশকের প্রথমার্ধে বাংলাদেশ বর্তমান মাত্রার নয়নভরা উন্নয়ন ও অগ্রগতি সাধন করতো।

দৈহিকভাবে তাকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হলেও তিনি আছেন নিরন্তর। তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্যক্রমের মধ্যে বর্তমান সময়োপযোগী কার্যক্রম আমরা দেখেছি। তবে কষ্ট হয় তার অসময়ে চলে যাওয়াতে। বইটির এক জায়গায় চীনের চেয়ারম্যান মাও সে তুংয়ের নিরাপত্তার কারণ উদঘাটন করেও তিনি নিজের নিরাপত্তার সামান্যতম ব্যবস্থা রাখেননি। তিনি তো মাও সে তুংয়ের চেয়ে কম জনপ্রিয় ছিলেন না। দেশে-বিদেশে তাঁর শত্রু ছিল। তাঁকে নির্মূল করে বাংলাদেশে যে দুরবস্থার সৃষ্টি হবে তাও জানতেন, কিন্তু নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদাসীন থেকে তিনি আমাদের এতিম করে গেলেও প্রায় ২১ বছর পর আমরা সাবালকত্ব অর্জন করেছি।

এই বইটি পড়ে আবার মনে হলো বাঙালি জাত হিসেবে কিংবা ব্যক্তি হিসেবে কতটা পরশ্রীকাতর। আমরা যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছি তখন প্রতিপক্ষের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ইলিটারেট গ্র্যাজুয়েট। আর কত গাল-গল্পের সমাহারে তাকে চিত্রায়িত করা হতো কিঞ্চিৎকর। আমরা মুখের জোর দিয়ে তার প্রতিবাদ বা অপবাদ ঘটানোর চেষ্টা করতাম। আফসোস হয় সময়মতো বঙ্গবন্ধুর ‘আমার দেখা নয়াচীন কিংবা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশিত হলে আমাদের মনোবেদনার উপশম হতো কিংবা বাঙালি রাজনীতিবিদদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বিকশিত হতো। তাঁকে নিয়ে, তাঁর পরিবার নিয়ে, শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কিংবা জীবনে তাঁর উত্তরণ নিয়ে অন্তহীন গাল গল্প আমাদের পীড়া দিলেও আশা করি নবপ্রজন্ম তাকে তার স্ব-অবস্থানে প্রতিস্থাপন করবেই। আর একটি বিষয় আমাকে পীড়িত করে। বইটির ১৪১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে উল্লেখ আছে। আমার স্পষ্ট ধারণা তাকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলাটা একটি বিভ্রান্তির বীজ বোনার শামিল। ২০০৪ সালে বিবিসির পরিচালিত জরিপে তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলেই সংস্থাপন করেছে। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাকে ঐ অভিধায় অবহিত করলেও তার বহু সহকর্মী, অনুরাগী ও অনুসারী একই মঞ্চ থেকে কিংবা পৃথক মঞ্চ থেকে বঙ্গবন্ধুকে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি বা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে অভিহিত করেন। এই জাতীয় উচ্চারণ ইতিহাস বিকৃতির অনুক‚লতা সৃষ্টি করে। এই বিষয়ে আমি বহুবার লিখেছি। কিন্তু তারা এ সম্পর্কে কখনো চোখ মেলেছেন বলে তো মনে হয় না। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বইটিতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিধাটি ব্যবহার সঙ্গত ছিল। কেউ কেউ সংশোধিত আকারে বঙ্গবন্ধুকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠের পরিবর্তে শুধু শ্রেষ্ঠ বাঙালি লিখে থাকেন। ব্যাকরণের দিক থেকে তা সঠিক হলেও ইতিহাসিক সত্যতার খাতিরে নিষ্প্রয়োজন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শব্দত্রয় ব্যবহারই সঙ্গত বলে আমি মনে করি।

আমার দেখা ‘নয়াচীন খাতার নোটস’ দেখে প্রতীয়মান হয় এই ভ্রমণ কাহিনীর কলেবর বৃদ্ধিতে চীনের অতীত ও বর্তমান ইতিহাসকে টানা যেত, ঋড়ৎনরফফবহ ঈরঃু বা নিষিদ্ধ নগরীর বর্ণনা, এধঃব ড়ভ যবধাবহষু ঢ়ষধপব, চীনের মুদ্রাস্ফীতি বা ইনক্লেশনের বর্ণনা, চীনের প্রাচীর, সাদা চুলের মেয়ে, ঞবসঢ়ষব ড়ভ ঐবধাবহ ইত্যাদিকে আনা যেত। কলেবর বৃদ্ধি হলেও কিন্তু ভ্রমণ কাহিনীর স্বকীয়তা, সাবলীলতা ও মৌলিকতা অক্ষুণ্ন থাকতো না। অপূর্ব ও অনন্য এই লেখাটি থেকে মনে হয় রাজনীতি ছেড়ে সাহিত্যের প্রতি মনোযোগী হলে বঙ্গবন্ধু বহু রথী-মহারথীকে ছাড়িয়ে যেতেন। তবে সেক্ষেত্রে তিনি বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা কিংবা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলেও অভিষিক্ত হতেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App