×

মুক্তচিন্তা

গরিবের আয়-আয়ু : ঢাকার বায়ু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:২৩ পিএম

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে এখন ৭২.৩। এর মধ্যে পুরুষের আয়ু ৭০.৮ বছর। নারীর ৭৩.৮ বছর। আয়ু বা হায়াতকে বলা হয় ঐশ্বরিক। আর আয় জাগতিক। অর্থাৎ হায়াত-মওতে বান্দার হাত নেই। পুরোটাই উপরওলার এখতিয়ারে। তবে আয়ের চাবিকাঠি বান্দার হাতে। এ নিয়ে বিতর্ক ও ব্যাখ্যা প্রচুর। নানা বিতর্কের মধ্যেও মানুষের সতর্কতা, সরকারগুলোর টেকসই-যুগসই পদক্ষেপে দেশে দেশে মানুষের আয় বাড়ছে। কোথাও কোথাও বাড়ছে আয়ুও। জিডিপি প্রবৃদ্ধিসহ বাংলাদেশের নানা অর্থনৈতিক সূচকে ধারাবাহিক উন্নয়ন হচ্ছে। আয়-আয়ু বাড়ছে। কিন্তু সেটাতেও বৈষম্য। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপও বলছে, দেশে গরিব কমছে। তাদের আয়ও কমছে। ধনী বাড়ছে। তাদের আয়ও বাড়ছে। এ অবস্থার মাঝে জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থার (ইউএনডিপি) জরিপটি বেশ তাৎপর্যবহ। সংস্থাটি বলছে, নিম্ন আয়ের মানুষ উচ্চ আয়ের মানুষের তুলনায় গড় আয়ুতে পিছিয়ে। নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া একটি শিশুর গড় আয়ু ৫৯ বছর। আর উচ্চ আয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুর গড় আয়ু হয় ৭৮ বছর। উচ্চ ও নিম্ন আয়ের পরিবারে জন্ম নেয়া মানুষের গড় আয়ুর পার্থক্য ১৯ বছর। তথ্য হিসেবে চাঞ্চল্যকর। পিলে চমকানোর মতো। আয়-আয়ু নিয়ে জরিপকর্মগুলো বেশ ইন্টারেস্টিং। আরেক জরিপের ফলাফলে দেখা যায় গত দুই দশক ধরেই ইংল্যান্ডের ধনী-গরিবের মধ্যে গড় আয়ুর বৈষম্য বেড়েছে। স্টকটনে ধনীদের আয়ু বাড়ছে। তারা সুস্থতার পাশাপাশি পাচ্ছেন দীর্ঘ জীবন। এর বিপরীতে গরিবদের আয়ু তেমন বাড়ছে না। তাদের বেশিরভাগই মারা যাচ্ছেন অল্প বয়সে। এই বিভক্তি ও বৈষম্য যুক্তরাজ্যের একটি জাতীয় সমস্যা। এই গবেষণার তথ্য বলছে, আয়ুর ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও মূল কারণ আয়-বৈষম্য। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের নানাদিক উঠে এসেছে ইউএনডিপির প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্বে অসংখ্য মানুষ খাদ্যাভাব, ব্যাধি এবং দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়ে ন্যূনতম জীবনধারণে সক্ষম হয়েছে। প্রত্যাশিত আয়ের ক্ষেত্রে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাসের অসাধারণ উন্নতি এই উন্নয়ন সূচক নির্দেশ করে। বাংলাদেশে ধনী-গরিবের বৈষম্যের রেকর্ড বিশ্বব্যাংকেরও পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা এক হিসাবে দেখিয়েছে, বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ আড়াই কোটির ঘরে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারীর আয় দৈনিক ১.৯ ডলার (দেড়শ টাকা) কম। পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৪.২ শতাংশ। যা ২০১৬-১৭ সালে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আরেক তথ্য বলছে, বর্তমানে গ্রামে দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ, আর শহরে এ হার ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। এসব পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য সরকারের নানা প্রকল্প এগোচ্ছে। নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ওয়েলথ-এক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশের অবস্থান হবে বিশ্বে তৃতীয়। যাদের কাছে এক থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলার আছে তাদের ধনী হিসেবে ধরা হচ্ছে। ‘হাই নেটওয়ার্ক হ্যান্ডবুক-২০১৯’ নামে প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল সময়ে দেশের সমন্বিত বার্ষিক জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়বে শতকরা ১১.৪ ভাগ। ধনী মানুষের সংখ্যার দিক থেকে আর মাত্র চারটি দেশের জাতীয় প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কে পৌঁছাবে। তালিকার শীর্ষে রয়েছে নাইজেরিয়া, সেখানে এ হার শতকরা ১৬.৩ ভাগ। এরপরই রয়েছে মিসর, সেখানে এ হার শতকরা ১২.৫ ভাগ। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। বাংলাদেশ দুর্বল অর্থনীতি থেকে দ্রুত টেকসই অর্থনীতির দিকে যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে সম্পদের বণ্টন নিয়ে। অবৈধ-অনৈতিক উপায়ে শটকাটে ধনী হওয়ার প্রবণতাটাও বেশি। অর্থনৈতিক সাফল্যের নজির গাণিতিক-জ্যামিতিক সব মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সাফল্যের এ পাত্র-পাত্রীরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের মাধ্যমে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বৈষম্য কমিয়ে আনতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সেই অনুযায়ী চেষ্টাও কম নয়। ২০২১ সাল নাগাদ আর্থ-সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন ও ২০৩০ সাল নাগাদ দারিদ্র্য বিমোচনের টার্গেট রয়েছে সরকারের। কিন্তু জবাবদিহিতা ও সুশাসন না থাকলে লক্ষ্য পূরণ অসম্ভব। সেই হওয়া পর্যন্ত এই চক্রকে চাইলেও কি দাবিয়ে রাখা যাবে? ভারতের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে বলেছেন, চটকদার প্রকল্পে আয় বৈষম্য কমবে না। আয়ুর সঙ্গে আয়ের সম্পর্ক রয়েছে। দেশের জাতীয় অর্থনীতির জন্য আয়-আয়ু একটি ফ্যাক্টর। গরিবের হাতে বেশি টাকা তুলে না দিলে বাজারে কেনাকাটা বাড়বে না। ভারতের অর্থনীতির জন্য তার এ পরামর্শ বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। এর মধ্যে সব চেয়ে প্রাসঙ্গিক বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকলেই না আয় এবং আয়ুর ভাবনা। আর বেঁচে থাকা বা আয়ুর জন্য সবার আগে দরকার বায়ু। সেই বায়ুতেও গোলমাল চরমে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকার বায়ু দিনকে দিন আয়ুর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা মহলের তথ্য ভয়ঙ্কর। তারা বলছেন, ঢাকা শহরের বাতাসে দূষিত বস্তুকণার পরিমাণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ গুণ বেশি। এলাকাভেদে দূষণেরও রকমফের আছে। ৪ বছর ধরে সবচেয়ে দূষিত এলাকা হিসেবে ফার্মগেটকে টপকিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়েছে লালবাগ। ফার্মগেট নেমে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। এরপরেই পুরান ঢাকার ইংলিশ রোড, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডির শংকর, নয়াপল্টন ও হাজারীবাগের পজিশন। বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতির ওপর গত বছর কয়েকের রিপোর্টগুলো শনির সংকেত দিচ্ছে। বায়ুতে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। এতদিন এই উপাদান সবচেয়ে বেশি নির্গত করত চীন। গত ২ বছরে চীনকে টপকে ওই দূষণকারী স্থানটি দখল করে নিয়েছে ভারত। চীন ও ভারতের পরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে ফার্স্ট-সেকেন্ড পজিশনে ভারতের দিল্লি ও বাংলাদেশের ঢাকাই থাকছে ঘুরে-ফিরে। এর পরেই পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিংয়ের অবস্থান। ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। এতদিন ইটভাটাকে বায়ুদূষণের জন্য এক নম্বরে দায়ী করা হতো। কিন্তু বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো বিশ্লেষণে ধারণা পাল্টে গেছে। বাংলাদেশের বায়ুদূষণ নিয়ে এক যুগ কাজ করা অধ্যাপক আবদুস সালামের হিসাব অনুযায়ী মূলত যান্ত্রিক উৎস থেকে সৃষ্টি হওয়া ধোঁয়া ও ধুলা থেকে বাতাসে ক্ষুদ্র কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে। কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর কণার সৃষ্টি হয়। ইটভাটা, শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের ধোঁয়া এবং সড়ক ও ভবন নির্মাণসামগ্রী থেকে তৈরি ধুলায় এগুলো সৃষ্টি হয়। না বললেই নয়, ইটভাটাগুলো শুধু নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত প্রায় ১০০ দিন চালু থাকে। কিন্তু ঢাকার বায়ু বছরে ৩০০ দিন খারাপ বা অস্বাস্থ্যকর থেকে খুবই অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় থাকছে। এখন মনে করা হয়, বিপুল পরিমাণে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও সীমান্ত পেরিয়ে আসা দূষিত বায়ু ঢাকার বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে। ঢাকা মহানগরীতে ঘর বা বাসার ভেতরও বায়ুদূষণমুক্ত থাকার অবস্থা নেই। ঘরের মধ্যে বাতাসে সূ² বস্তুকণা ও গ্যাসীয় পদার্থের দূষণ বিষয়ে ভিন্ন একটি গবেষণায় ঢাকার মিরপুর, খিলক্ষেত, রামপুরা, দোলাইরপাড় ও টঙ্গী এই পাঁচটি আবাসিক এলাকার একতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত ভবনের ভেতরে বায়ুতে ভাসমান ক্ষতিকর সূ² বস্তুকণার ঘনত্ব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাইরের দূষিত বায়ুর ৪২ শতাংশ চলে আসে ঘরে। এছাড়া ঘরে থাকা ময়লা-আবর্জনা, ডিটারজেন্ট, রান্না ও টয়লেট থেকেও দূষিত পদার্থ বাতাসে যুক্ত হয়। ফলে ঘরের ভেতরের বাতাসেও বাড়ছে দূষণের মাত্রা। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও লেখক; বার্তা সম্পাদক বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App