×

মুক্তচিন্তা

সৌদিতে বাঙালি নারীর কান্না শুনতে পাচ্ছেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:৪৯ পিএম

প্রথমত, সৌদি আরবে অদক্ষ নারী শ্রমিক, নারী গৃহকর্মী পাঠানো, প্রয়োজনে আইন করে বন্ধ করা হোক, যাতে তাদের জীবন নষ্ট না হয়। দ্বিতীয়ত, যারা সৌদিতে আটকা পড়ে আছেন তাদের কান্না বন্ধ করতে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হোক, কথিত ‘মিনি পতিতালয়’ গড়ার নেপথ্য নায়কদের শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হোক। সর্বোপরি কর্মী রপ্তানি এজেন্সিগুলোতে বিরাজমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, সেখানকার নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে।

সৌদি আরব বাঙালি মুসলমানের চোখে ধর্মীয় পবিত্র ভূমি। এটাই শেষ কথা নয়। একালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক শক্তি মজবুত করার ক্ষেত্রে বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি নাগরিকদের (নর-নারী নির্বিশেষে) পাঠানো (রেমিট্যান্স) বৈদেশিক মুদ্রার সে ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা। আর এই কর্মক্ষেত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় অবস্থান সৌদি আরবের। বোধগম্য কারণে কর্ম অন্বেষায় সৌদি আরবে যাওয়ার অপরিসীম স্বপ্ন বাংলাদেশিদের এবং তা নর-নারী নির্বিশেষে।

নানা ধারায় শিক্ষিত শ্রেণির (চিকিৎসক, প্রকৌশলী) জন্য সৌদি আরবে কর্মসংস্থান ও অবস্থান সমস্যা সংকুল নয়। এমনকি নয়, নিম্নবর্গীয় দক্ষ কারিগরদের শ্রেণির জন্য, যারা নির্দিষ্ট এজেন্সির মাধ্যমে বৈধপথে কর্মরত। কিন্তু সমস্যা অদক্ষদের নিয়ে, সমস্যা যারা অসৎ দালালদের ধরে সুনির্দিষ্ট কাজ নিশ্চিত না করে পাড়ি জমায়।

বিশেষ করে নারী গৃহকর্মী। এই অশিক্ষিত নিম্নবর্গীয়দের বিশ্বাস, ওই পবিত্র ভ‚মির সমৃদ্ধ আবহে বাতাসে সোনা ঝরে। কুড়োতে পারলেই হয়। কাজ ও পরিস্থিতির বাস্তব চিত্র না জেনেই তাদের যাত্রা ওই স্বপ্নের দেশে। পরিণামে যথারীতি আগুনে ঝাঁপ দেয়ার মতো অবস্থা এবং মর্মভেদী কান্না।

বিভিন্ন সূত্রের সংবাদ মতে, ‘বাংলাদেশের একক বৃহত্তম বৈদেশিক শ্রমবাজার সৌদি আরব। সরকারি হিসাবেই দেশটিতে ১৫ লাখের মতো বাংলাদেশি কর্মরত। এর মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার নারী গৃহকর্মী।’ এ হিসাবের বাইরে নানাভাবে পূর্বোক্ত সূত্রে কাজের উপলক্ষে বড়সড় সংখ্যার বাংলাদেশি সেখানে কর্মরত বা কর্মের চেষ্টায় অবস্থান করছে। স্বভাবতই তারা বৈধ কাগজপত্র নিয়ে নানা রকম সংকটে দিন কাটাচ্ছে।

এটা মোটা দাগে সমস্যার চালচিত্র। আসল সমস্যা অন্যত্র। আর সেটা একাধিক। যেমন স্বপ্নের দেশে যাওয়ার তাগিদে চরম বেহিসেবীপনা, নির্দিষ্ট কাজ ঠিক না করে দালালচক্রের লোভনীয় আশ^াসে যাত্রা, তেমনি শ্রমশক্তি রপ্তানির এজেন্সিতে চরম বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, অসততা ও দুর্নীতির ব্যাপকতা। সেসঙ্গে সুনির্দিষ্ট নিয়ম-নীতির অভাব এবং কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা। দুই. বাংলাদেশে জনসংখ্যার বেহিসেবী স্ফীতি এ জাতীয় নৈরাজ্যের কারণ বলে ভাবা যেতে পারে, যেমন কর্ম অন্বেষকদের পক্ষে, তেমনি শ্রম রপ্তানিকারকদের ক্ষেত্রে, সর্বোপরি সরকার পক্ষে। পরিণামে ভোগান্তি কর্মীদের, ফলে ভর্তি হয় দালালচক্রের যারা মধুলোভীদের মিথ্যা প্রলোভনে সর্বনাশের উৎসে পৌঁছে দেয়।

এই সাধারণ সংকটের একটি চিত্র প্রকাশ পেয়েছে একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনামে- ‘সৌদিতে আকামার (কর্ম অনুমতিপত্র) মেয়াদ সংকটে লাখো শ্রমিক’। সরেজমিন অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তৈরি এ প্রতিবেদনে যে বাস্তব অবস্থার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা বড় করুণ এবং মর্মস্পর্শী।

এ অবস্থার প্রত্যক্ষ কারণ তথাকথিত নিয়োগদাতা এজেন্সির প্রতারণা, আর এ প্রতারণা বন্ধে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই কর্তৃপক্ষের। স্বভাবতই কর্মস্থলে পৌঁছে এক অসহায় পরিস্থিতির শিকার ওইসব কর্মী ও শ্রমিক। গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে দূতাবাসের দায়িত্ব এই অসহায়দের সুরক্ষায় সহায়তা দেয়া। কিন্তু ভুক্তভোগীদের পক্ষ থেকে অভিযোগ হলো- দূতাবাস কোনো খোঁজখবর নেয় না। এমনকি আবেদন-নিবেদনে বড় একটা কার্যকর সাড়া পাওয়া যায় না।

এ বিষয়ে বিশদ বিবরণে না গিয়ে প্রতিবেদকের ভাষ্যমাফিক বলা যায়, চরম সংকটের মুখে পড়ে অসহায় মানুষগুলো সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাসে ভিড় জমাচ্ছে- দূতাবাসের পক্ষে পরিস্থিতি সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মোটা টাকার বিনিময়ে ঢাকার রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের এ দুঃসহ অবস্থা সৃষ্টি করেছে। সংখ্যাটা অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য যে, গত দেড় মাসে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেছেন ৫ হাজার ৫০০ প্রবাসী কর্মী। সৌদি পুলিশের অভিযানের মুখে তারা ধরা পড়ে বা স্বেচ্ছায় ধরা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তাদের দেশে ফেরা।

বাংলাদেশ থেকে শ্রম ও শ্রমিক রপ্তানি নিয়ে, তাদের পাঠানো অর্থ নিয়ে অনেক কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মুদ্রার সাদা পিঠের তুলনায় কালো পিঠ নিয়ে কথা কমই বলা হয়েছে এতকাল। ইদানীং বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়েছে। সেটা বিশেষ করে নারী শ্রমিক বা নারী গৃহকর্মীর চরম নির্যাতন, লাগাতার যৌন লাঞ্ছনা বা ধর্ষণের অমানবিক কাহিনীর পরিপ্রেক্ষিতে।

অর্থনৈতিক সচ্ছলতার স্বপ্ন নিয়ে পবিত্র ভূমি সৌদি আরবে যেসব নারী পরম ভরসায় পাড়ি জমিয়েছিল, অকুস্থলে পৌঁছে তাদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ বিপরীত। কোথায় চকচকে সোনালি রং রিয়াল, আর কোথায় অর্ধাহারে-অনাহারের বীভৎস যৌন লালসার কাছে নিয়মিত নিজেকে সমর্পণ, মুক্তির কোনো পথ সামনে খোলা নেই। এ অবস্থায় নিঃস্ব হয়েও দেশে ফেরার চেষ্টা নারী গৃহকর্মীদের। একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম- ‘সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকদের (দেশে) ফেরার আকুতি’। এ আকুতির কারণ আর কিছু নয়। ‘রিয়াল’ নামক সোনালি মুদ্রা উপার্জনের স্বপ্ন, যা এখন তাদের মাথায় উঠেছে। এখন ক্ষতবিক্ষত দেহটিকে নিয়ে ঘরে ফিরতে পারলে তারা বাঁচে।

কিন্তু তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? ঘটনা তো ঠিকই জানাজানি হবে। বাংলাদেশের অধঃপতিত গ্রামীণ সমাজ সব ঘটনার জন্য দায়ী করবে ওই নির্যাতিত নারীকেই, পবিত্র ভ‚মির লম্পট অধিবাসী আরবকে নয়। অন্যদিকে পরিবার তাকে কী মূল্যে গ্রহণ করবে? বিশেষ করে বিবাহিতা তরুণীর ক্ষেত্রে তার স্বামী? পারিবারিক জীবন, দাম্পত্য জীবন কখনো কি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে? এ সম্পর্ক ভাঙনের দাম কে দেবে, এর দায় কে নেবে?

উল্লিখিত প্রতিবেদনে প্রকাশ- ‘গত ৪ বছরে অন্তত ৬ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এদের একটি বড় অংশ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার। ২০১১ সালে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ অনেক দেশ সৌদি আরবে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এর অন্যতম কারণ ছিল নারী শ্রমিকদের নির্যাতন।’ বলাবাহুল্য তা যৌন নির্যাতন। আশ্চর্য, চোখের সামনে জঘন্য উদাহরণ থাকা সত্তে¡ও বাংলাদেশ তার নারীদের সৌদি ভ‚মিতে নির্যাতিত হতে দিয়েছে নির্বিকার চিত্তে। নাগরিকদের প্রতি ন্যূনতম কর্তব্য পালন করেনি।

গত এক বছরে হাজারেরও বেশি নারী সৌদি আরব থেকে এ অবস্থায় ফিরেছেন, এর মধ্যে ১১৯ জন লাশ হয়ে। কী বীভৎস! একাধিক তথ্যসূত্রে কর্ম ও রেমিট্যান্সের যে চিত্র নারী গৃহকর্মীদের ক্ষেত্রে বেরিয়ে আসছে তা ভয়াবহ। পূর্বোক্ত প্রতিবেদন মতে নারী গৃহকর্মীদের নিয়ে ‘সৌদি আরবের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে মিনি পতিতালয় গড়ে তুলেছে ওই দেশের নিয়োগদাতা বিভিন্ন কোম্পানি। নারী শ্রমিকদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করা হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে।’

একই তথ্য মতে, ‘সম্প্রতি যারা দেশে ফিরে এসেছেন তাদের মধ্যে অনেকে যৌন নির্যাতনের কারণে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছেন। এছাড়া শারীরিক নির্যাতনের শিকারও হয়েছেন অনেকেই। গত ৪ বছরে ২ লাখেরও বেশি নারী শ্রমিক পাঠানো হয়েছে সৌদি আরবে।’ ঘটনার বিবরণ না বাড়িয়ে শুধু প্রশ্ন করতে হয়- আমরা কি সৌদি আরবে কর্মের নামে যৌনদাসী বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছি?

আর সেজন্যই সৌদি আরব থেকে নারী শ্রমিকদের দেশে ফেরার জন্য এত আর্তি লক্ষ করা যাচ্ছে দৈনিক পত্রিকাগুলোর খবরে। একটি খবর- ‘সৌদি আরব থেকে মেয়েকে ফেরাতে মায়ের আকুতি।’ তার কথা- ‘মেয়েকে ফিরে পেতে আমি প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য চাই।’ অসহায় যন্ত্রণাকাতর মায়ের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাদেরও আহ্বান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি-

প্রথমত, সৌদি আরবে অদক্ষ নারী শ্রমিক, নারী গৃহকর্মী পাঠানো, প্রয়োজনে আইন করে বন্ধ করা হোক, যাতে তাদের জীবন নষ্ট না হয়। দ্বিতীয়ত, যারা সৌদিতে আটকা পড়ে আছেন তাদের কান্না বন্ধ করতে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়া হোক, কথিত ‘মিনি পতিতালয়’ গড়ার নেপথ্য নায়কদের শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হোক। সর্বোপরি কর্মী রপ্তানি এজেন্সিগুলোতে বিরাজমান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে, সেখানকার নৈরাজ্য বন্ধ করতে হবে। নির্যাতিতাদের কান্না, তাদের মায়েদের কান্না বন্ধ করার সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। বাংলাদেশের মান-মর্যাদা ও ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে। দরকার নারী পাচারকারীদের কঠোর শাস্তির বিধান।

আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App