×

সাময়িকী

যে হারায় হারাবার ভয়ে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:২৮ পিএম

যে হারায় হারাবার ভয়ে

দারাজগাঁও গ্রাম। বেশ পরিচ্ছন্ন আর সবুজে মোড়ানো। ঠাকুরগাঁও জেলার দেবীপুর ইউনিয়নে এই গ্রাম। গ্রামের গভীরে যতই চোখ যায়, ততই চোখ জুড়ায়। কাঁচা রাস্তা, ভেজা রাস্তা চোখে পড়ে না সহজে। ঝকঝকে তকতকে রাস্তা। উন্নয়নের ছাপটা প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে গেছে যেন এই গ্রামে এরই মধ্যে। গ্রামের প্রতিটি ঘর পর্যন্ত পাকা রাস্তা। ভাবা যায় না। ঝকঝক করে ওঠে রোদে। মনে হয় রোদ যেন কাচের ওপর এসে জ্বলে উঠেছে। তার উজ্জ্বলতা পায়ে আছড়ে পড়ছে তরীর। হেঁটে চলার আনন্দ দ্বিগুণ হয়। ধুলোবালির বিন্দুমাত্র বিচরণ নেই সারিবদ্ধভাবে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের পাতায়। বেশ সবুজ ওরা। সদ্য ম্লান করে উঠেছে যেন। গাঢ় সবুজ হয়ে ওরা যেন স্নিগ্ধ অভ্যর্থনা জানায় আগতদের। অবাক হয়ে দেখে তরী, এঁকেবেঁকে যাওয়া পাকা রাস্তার দুপাশের গাছগুলোর মধ্যে কোনো আগাছা নেই। পরিচ্ছন্নতায় টইটুম্বর। চারপাশ এতো সবুজ দেখে তরীর মনটা সবুজ হয়ে ওঠে।

পাশাপাশি হেঁটে চলা এক তরুণ প্রাণ নির্বাক। পরীর মতন সেও বাকরুদ্ধ। প্রকৃতির এত ধবধবে, সতেজ রূপে বিমোহিত না হবার কোনো উপায় নেই। যেমন উপায় থাকে না তরীর থেকে মুখ ফেরানো। গ্রামের ঘরগুলো পাশাপাশি। অথচ দূরত্বটা লক্ষণীয়। নিজস্বতার সীমারেখা পরিষ্কার রেখেছে। এমন পরিবেশে পাশাপাশি হেঁটে চলা তরী আর প্রাণের মধ্যকার দূরত্ব ক্রমশ ফিঁকে হয়ে আসে। পরস্পরের নিঃশ্বাস শুনবার মতো। পরিবেশ যেন সম্পর্কের মহৌষধ। কেবল সুস্থতা দিতে চায়। তরীর পরনে ফতুয়া ও জিন্সের ট্রাউজার। ঘাড় পর্যন্ত ছুঁয়ে থাকা চুলে বেশ মানায়। প্রাণ বেশ ক’বার বলেছে সে কথা। ছেলেরা খুব সহজে মেয়েদের রূপের প্রশংসা করতে পারে। বিশেষণ মজুদ থাকে তাদের। তরী তার রূপের প্রশংসায় আহ্লাদিত হয়নি কখনো। বরং বলেছে,

সত্য ও মিথ্যের ঘনিষ্ঠতা বেশ। চিনতে ভুল হয় কখনো, সখনো। সত্যকে মনে হয় মিথ্যে। আবার মিথ্যেকে মনে হয় সত্য। মেয়েদের খুশি করার জন্য ছেলেরা অনেক সত্য যেমন বলে, তেমন বলে মিথ্যে। প্রাণকে হালকা করবার জন্য কথার পেছন হাসি জুড়ে দেয় তরী।

তরীকে ঘেরাও করেছে পুরো গ্রামবাসীর দৃষ্টি। পাঁচ, ছয়জন কিশোরী সাইকেল চালিয়ে তরীর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। পারে না। একপাশে দাঁড়িয়ে পেছন ফেরে। ঘনসবুজ ফ্রেমের মাঝে তরী। সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে তার রূপ। মুগ্ধতায় বিভোর কিশোরীর দল। কিছু দৃষ্টি চুম্বকের মতো কাছে টেনে নেয়। তেমন এক টানে তরী ওদের বেশ কাছে এসে দাঁড়ায়। বাহ! তোমরা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছো! বেশ লাগছে কিন্তু! কোথাও যাচ্ছো তোমরা? আমরা তো ছোট্টবেলা থেকেই সাইকেল চালাই। গর্ব করে কেউ একজন বলে ওঠে।

আর তিনদিন পর পহেলা বৈশাখ তো। স্কুলে গানের রিহার্সেল আছে। স্কুলে যাই। যাবেন? মুখ বাড়িয়ে চঞ্চল প্রকৃতির আর এক কিশোরী প্রস্তাব দিয়ে বসে। প্রাণ একটু দূরে দাঁড়িয়ে টপাটপ তরীর ছবি ক্যামেরায় বন্দি করতে শুরু করে। অন্য সময় হলে তরী পোজ দিত। এখন আর তেমন ইচ্ছে হয় না। কিশোরীদের ভেতরই তরীর কৌত‚হল। তোমরা সবাই গান গাইতে পারো! বেশ তো! ওদের মাঝখান থেকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর এলো, পহেলা বৈশাখের গান তো এ গ্রামের সবাই গাইতে পারে। কথাটার ভেতর বেশ জোর ছিল। অহঙ্কারও বটে। উত্তরের ভেতর সংশয় নেই। নেই কালক্ষেপণ। তরীকে বলতেই হয়, আমিও তো পারি গাইতে। তাহলে চলুন না, সবাই একসাথে গাই! গ্রামের সকলে ভালোবাসবে! চঞ্চলা কিশোরীর দল তরীর হাত ধরে সাইকেলে চড়াতে তৎপর হলো। অজানা আনন্দে ভেসে যাবার রোগ নতুন নয় তরীর। এমন রোগে ভুগতে ভালোই লাগে তরীর। প্রাণ পড়ে যায় বিপাকে। সে তো আর সাইকেলে চড়ে বসতে পারবে না। প্রাণকে ছেড়ে যায় কী করে তরী। আমি না হয় থাকি। তুই ঘুরে আয়। পাগল! তোকে ছেড়ে এই নির্মল আনন্দ উপভোগ করব? অজানায় হারাব! তুইও উঠ একটা সাইকেলে। আরে উঠ তো! প্রাণ আড়ষ্টতায় নিজেকে সপে দিয়েছে। কিছুতেই মুক্ত হতে পারছে না। তরী! ওদের পেছনে আমি কী করে উঠি? আশ্চর্য! তুই মুক্তমনা হবি না? গ্রামের সরল একজন কিশোরীর সাথে সাইকেলে চড়লে কী ক্ষতি তোর, বল তো? প্রাণ একটু আড়ালে টেনে আনে তরীকে। ফিসফিস করে, শহর থেকে আসা একজন পুরুষ। গ্রামের মানুষ ওদেরকে অন্যরকম ভাবতে পারে। অযথায় তুই পুরুষ! ব্যস! ব্যস! চুপ কর। তুই থাক তাহলে। আমি যাচ্ছি। কিশোরী দল ঠিক বুঝে নিয়ে সমবেত স্বরে বলে ওঠে, এখানে ছেলেরাও তো সাইকেল চালায়। আপনি কী নিজেই সাইকেল চালিয়ে যেতে চান? নিন না আমার সাইকেল! লজ্জায় অপ্রস্তুত প্রাণ। ঢাকা শহরের ছেলে সাইকেল চালাতে জানে না, এমন খবর নির্ঘাত হাস্যকর ঠেকবে ওদের কাছে। বাধ্য হয়ে প্রাণ পা রাখলো সাইকেলের প্যাডেলে। পেছন নয়, সামনে বসলো তরী। তারপর গ্রামের স্বচ্ছ পাকা রাস্তার ওপর দিয়ে ছুটছে সাইকেল। তরী হাত নেড়ে নেড়ে আনন্দ প্রকাশ করে ক্লাসিক্যাল নৃত্যের ভঙ্গিমায়। সাইকেলও নেচে ওঠে তরীর সাথে। ব্যালেন্স রাখতে হচ্ছে প্রাণকে সতর্কতার সাথে। তরীর চুল বাতাসে উড়ে এসে পড়ে প্রাণের চোখেমুখে, নাকে। উড়ে আসা চুলের ভেতর সুগন্ধি খুঁজে ফেরে প্রাণ। শিহরণ ছড়িয়ে যায় প্রাণের দেহমনে। শহরে এভাবে চলা হয়নি কখনো। এই কিশোরীর দল অনেক দিল প্রাণকে। প্রাণের বুকে সেই কথাই বাজে গুনগুনিয়ে। স্কুলঘর আকার আয়তনে যতটা বড়, তার বহুগুণ বড় সবুজ ঘাসে মোড়ানো মাঠ। মাঠের এককোণে একচিলতের মতো দাঁড়িয়ে স্কুল ঘর। সাইকেলের প্যাডেল থামে না প্রাণের। তরীকে নিয়ে প্রাণ মাঠের চারপাশ ঘোরে। এত সুখ আগে পায়নি। তারপর গতি স্থির হয়। সাইকেল দাঁড়িয়ে যায়। আনন্দরা জড়োসড়ো হয়। মনে হলো তরী প্রাণের ভেতর। বেরুবে না সহজে।

আহা! কী যে ভালোবাসার সময় রে! মুখে আটকে থাকলো না প্রাণের আবেগ। বরং বেশ দ্রুত তরীর কানে পৌঁছায়। অদ্ভুত শোনাল। কখনো শুনেছে কিনা, মনে পড়ে না। বিস্ময়ে ফিরে তাকাতে হলো প্রাণের দিকে। প্রাণের চোখ গোটা আকাশ জুড়ে। ধরা খেয়ে মানুষ এভাবেই বিশালতার মাঝে নিজেকে উধাও করে। রক্ষা করবার কৌশল প্রশ্নের কাছ থেকে নিজেকে। রোদে আকাশ আরো নীল হয়ে উঠেছে। ভাব এমন, তার খোঁজে মত্ত প্রাণ। ওর একটা হাত ধরে বেশ জোরে ঝাঁকুনি দেয় তরী, কখনো তো তোর মুখে ভালোলাগা ভালোবাসার কথা শুনিনি রে, প্রাণ! এই কিছু হয়নি তো তোর! সময় পেলাম কোথায় বলার। উত্তরটা ঠোঁটের আগায় ছিল। কিশোরীর দল এরই মধ্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রিহার্সেলে। তরীর দৃষ্টি প্রাণ থেকে সরে না। গভীর থেকে গভীরতর হয়। কী দেখছিস? কোনো সমস্যা? প্রশ্নকে অবলম্বন করে প্রসঙ্গ বদলে দেবার চেষ্টা প্রাণের। নাছোড়বান্দা তরী। তুই কখনো প্রেমের কবিতা পড়েছিস, প্রাণ? ধ্যাৎ! এসব কী কথা! চল রিহার্সেলে। তরী খপ করে প্রাণর হাত ধরে। বেশ শক্ত ধরা। নতুন নয়, তরী প্রাণের হাত ধরেছে বহুবার। কতবার তাতে স্পর্শ ছিল, বলা মুশকিল। সব ধরায় স্পর্শ থাকে না। কোথাও কোথাও বেশি সৌজন্যতা থাকে। কিছু মানুষের বুঝার ভুলটা হয়ে যায় এখানেই। কবিতা পড়েছি। প্রেমের ততটা নয়। ঝরাঝরা স্বরে বেশ স্পষ্ট উত্তর প্রাণের। কী! এই দাঁড়া দাঁড়া, তুই প্রাণ তো! মানে যে আমার সাথেই থাকে! মোটাসোটা দাবি আছে যার, আমার চাইতে কাছে নেই কেউ তার! সেই-ই জানলো না কখনো এমন এক প্রাণ তার সাথে ঘোরে, উড়ে! দম নিতে হলো তরীর। আবার শুরু কথাদের পথচলা। শোন, প্রাণ! পাক্কা পনেরো বছর তোর আর আমার -মানে তোর আর আমার পাশাপাশি হাঁটাহাঁটি, ঝগড়াঝাটি। আরও কত কী, তাই না? একটুও চিনলাম না তোকে! কথা শেষ হয় না। চিলের মতো উড়ে এলো এক কিশোরী। একসাথে গাইব না, নতুন দিনের গান? চলুন। সবাই অপেক্ষা করছে।

নতুন দিনের গান কথাটা বেশ মানিয়ে গেল তরী আর প্রাণের এই মুহূর্তের সময়ে। নতুন এক সম্পর্ক আবিষ্কৃত হলো, তেমনই মনে হলো। সবে চাকরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত তরী আর প্রাণ। একটা সোশ্যাল মার্কেটিং কোম্পানির প্রোডাক্ট এর ফিজিবিলিটি যাঁচাই করতে আসা। খেলাধুলা, পড়াশোনার পর এ জীবনেও পাশাপাশি। তরীর চাওয়াটা বেশি থাকে। বাচালের মতো আউড়িয়েছে সে কথা বহুবার। প্রাণের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। সে বিরতিহীন তরীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ থেকেছে। সবকিছু যেন এই দরাজগাঁও গ্রামে এসে প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে জেনে নেয়া চলে, কে কতটা এগিয়ে ছিল নীরবে। কে কতটা এগুতে চায় আরো। রাতের জোছনা যেন আরো কিছু বলতে শেখালো ওদের। নতুন নতুন কথা। যা আগে কখনো বলা হয়নি। বলবার পরিবেশ হয়নি। সুযোগও হয়তো না। মৃত্যু অবধি বোধহয় মানুষ অনেক কথা বলতে শেখে। কত কাছে ছিলাম, কেউ বলিনি। তরীর কথার শেষ টানে প্রাণ, প্রকৃতি সত্য বলায়। এতোদিন আমরা তাহলে মিথ্যেয় ছিলাম? তা কেন। সত্যতেই ছিলাম। এই গ্রামটা শুধু ছিল না, তাই। ফিরতে হবে। গ্রামেরা কিশোরীদের মন খারাপ। ওরা আপন করেছিল তরীকে। তরীর মনে জায়গা করে নেবার জন্য ঘরে দেবার মতো যা ছিল, তাই হাতে করে নিয়ে এলো। কেউ হাতের সেলাইয়ের রুমাল। কেউ মোয়া-মুড়ি। কেউবা চালের শুকনো পিঠা। কারোর হাতে শিউলি ফুল। মন ভরে যাওয়া সব আয়োজন। তরীর চোখ জলে ভরে ওঠে। এতোটা নির্মল পাওয়া শহরে মেলে না। শহর কাউকে আপন করতে শেখায় না। দারাজগাঁও গ্রাম কিশোরীদের ভালোবাসা দিয়েছে। প্রাণের ভেতরটা তরীকে পড়তে সহায়তা করেছে বেশ।

পঞ্চগড় থেকে দ্রুতযান এক্সপ্রেসের টিকেট কাটা। রাত আটটা তিরিশে ছাড়বে। ঠাকুরগাঁও থেকে পঞ্চগড়ে যাবার জন্য টয়োটা কার চলে এসেছে। প্রাণের জন্য অপেক্ষা তরীর। এই আসছি বলে গেছে। আসছে না। মোবাইল সুইচ অফ। কোথায় যেতে পারে, কোথায় নেটওয়ার্ক না থাকতে পারে, এমন ছোট ছোট চিন্তাগুলো বড় দুশ্চিন্তায় পরিণত হচ্ছে ক্রমশ। ট্রেন মিস করতে হবে নির্ঘাত। মিস করে থেকে যাবারও উপায় নেই। কাল অফিস করতে হবে। একটা পার্টির সাথে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হবে। বড় প্রজেক্ট। বস স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন বেশ ক’বার। কিন্তু প্রাণকে ছেড়ে যাবার কোনো ইচ্ছে একবারও মনে আসে না। কিশোরীরা খুঁজছে হন্ন হয়ে। সাইকেল চালিয়ে হাতে টর্চ নিয়ে। গাছের ফাঁক আর অন্ধকারের ভেতর দিয়ে ওদের প্রাণকে খুঁজে দেখাটা বেশ স্পষ্ট। মনটা কেমন করে উঠলো তরীর। প্রাণের প্রতি তার মায়া ছিল। কিন্তু আজ যেন সেই মায়া বটবৃক্ষের মতো অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। সহজে উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। প্রাণকে ছাড়াই রওনা হতে হলো। মনে মনে প্রার্থনা, দেরি করে ছাড়–ক ট্রেন আজ। ছোট্ট একটা স্টেশন। দ্রæতযান এক্সপ্রেস এসে পৌঁছায়নি। সৃষ্টিকর্তা তার প্রার্থনা শুনেছেন মনে হলো। কোলাহল তেমন নেই। চারপাশ বেশ নির্জন। চার পাঁচটে পাকা বেঞ্চ। অল্প বয়সের কিছু ছেলেমেয়ে বেঞ্চ দখল নিয়ে বসে গল্প করছে। সন্ধ্যারাতে ওদের মিলনমেলা বসেছে যেন। সবকিছু বেয়ে তরীর চোখ খুঁজে ফেরে প্রাণকে। কোনো বিপদ হয়নি তো প্রাণের, এমন আশঙ্কার আক্রমণ ঘনঘন হচ্ছে। এমন করে উধাও হবার সম্ভাব্য কারণও অনুসন্ধান করে তরী। পায় না। কোনো সূত্র হাতের মুঠোয় নেই। প্লাটফর্মে ব্যাগ রেখে তার ওপর বসে তরী। চোখ প্রায় বুঁজে আসে তরীর। অনুভবে খুঁজে পাওয়া যায় কিনা প্রাণকে। এই যে শুনছেন! মাঝবয়সী একজন লোক কিছু বলতে চাইছেন। উসকো, খুসকো চুল। চোখে বেশ পাওয়ারযুক্ত চশমা। পরনের কাপড় অনেকদিন বোধহয় পরিষ্কার হয়নি। কিছু শুনবার অধীর অপেক্ষা তরীর। আপনি কী দ্রুতযানে ঢাকায় যাবেন? জি। আমি কী আপনার সাথে যেতে পারি? প্রাণের টিকিট তরীর সাথে। একই টিকেটে দুটো সিট নম্বর। কিন্তু অপরিচিত মানুষটির আবদার রক্ষা করতে ইচ্ছে হলো না। প্রাণের জন্য অপেক্ষার সাথে কোনো কিছু যায় না। ক্ষীণ স্বরে তিনি বলেন, আমার অনেক শরীর খারাপ। ভীষণ অসুস্থ। তবে কি মানুষটি জেনে গেছে যে, তরীর কাছে দু’জনার টিকেট আছে। কী করে তা সম্ভব, প্রশ্নটা উঁকি দেয় মনে তরীর। কিছু ঘটনার সাথে কিছু ঘটনার বিস্ময়কর মিল মানুষের অজান্তে হয়। কিন্তু আমি কীভাবে আপনাকে ট্রেনে চড়াব, বলুন তো? আপনি ইচ্ছে করলে হবে। মানুষটির ধারণা বেশ স্পষ্ট। এমন বিশ্বাসের কারণ এই পঞ্চগড় কিংবা ঠাকুরগাঁও এ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা নয়, এটা নিশ্চিত। তরীর মন, চোখ খোঁজে প্রাণকে। যদি আচমকা দৌড়ে এসে বলতো প্রাণ, ইস! আরেকটু হলেই তোকে মিস করতাম! ভাগ্যিস পেয়ে গেলাম! দ্রæতযান এক্সপ্রেস এসে প্লাটফর্মে লাগে। প্রাণের সিটে লোকটি স্থান পেল। ট্রেন ছাড়বার মুহূর্তেও প্রাণকে কল দেয়া হলো। মোবাইল ক্যান নট বি রিচ এট দ্য মোমেন্ট। পেছন ফেলে পঞ্চগড়, দ্রুতযান ছুটে যাচ্ছে ঢাকাভিমুখে। যাত্রীদের অনেকেই ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ঘুমিয়েও পড়েছে। ঘুম বা ক্লান্তির অবসাদ নেই শুধু তরীর চোখে। সারারাত ট্রেন নিজের ভাষায় কথা বলে। ছুটে চলে। কারোর কোন কিছু শুনবার, বুঝবার সময় নেই তার। নিজের ভেতর এক প্রবল নিস্তব্ধতা কেবল তরীর। টনটনে ব্যথা জাগায়। কেন এমন হলো। দারাজগাঁও গ্রামের উচ্ছলতা নিমিষে উধাও হয়ে গেল। মনটা পোড়ে। মনে মনে বলে, স্থায়ী বলে কিছু নেই আসলে, যা মানুষ নিজের হাতে গড়ে। প্রাণকে পাবার আনন্দ ছিল সবুজের মাঝে। সবুজের মাঝ থেকেই কোথায় যে হারিয়ে গেল, খুঁজে পাওয়া গেল না। শুনছেন? ঘুমিয়ে পড়লেন বুঝি? পাশে বসতে দেয়া লোকটি কথা বলছেন। জি, বলুন। জেগে আছি। ছেলেটি আপনার কে হন? কার কথা জানতে চাইছেন লোকটি। প্রাণের কথা? প্রাণকে নিশ্চয়ই লোকটি চেনেন। অধীর হয়ে বেশ শব্দ করে তরী জানতে চাইলো, আপনি প্রাণকে দেখেছেন? বলুন প্লিজ! প্লিজ! লোকটি মাথা নাড়ে। দেখেনি। তাহলে কার কথা জানতে চাইছেন! তার কথাই। বললেন যে দেখেননি? ঠিক বলেছি। তবে শুনেছি। ছেলেটি আপনাকে ভালোবাসতো। হারাবার ভয় করতে চায়নি সে। তাই সে নিেেজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে! কী বলছেন? কোথায় হারিয়ে গেছে প্রাণ? ভীতু প্রকৃতির ছেলে। কাঁশি দিয়ে মোড়ানো কথা। খুক্ খুক্ করে কেশে চলছে লোকটা অনবরত। তরী চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। একটা ছোট্ট কাগজ তরীর হাতে গুঁজে দিল লোকটা। প্রাণের লেখা, পাওয়া জিনিস মানুষ হারায়। না পাওয়া জিনিস হারায় না। খুব ভয় হলো তোকে হারাবার, তরী! তাই নিজে হারিয়ে গেলাম। কেনো যে এত ভয় হলো রে। তোকে নিজের করে পেয়ে হারাবার ভয়টা দারাজগাঁও গ্রামেই হলো। তোকে কাছে পেয়েছি, তাই দূরে থাকা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারব না। যদি কোনোদিন দূরে থাকতে হয়, পারব না রে সহ্য করতে। চোখ বন্ধ করে কষ্টকে চাপা দিতে চেষ্টা করে তরী। ঠাকুরগাঁও এই ট্রেনের নিচে ছেলেটা প্রাণ দিল। চিঠিটা একজন কিশোরী আমার হাতে দিয়ে বললো, তোমাকে দিতে। ঢাকায় যাবার পয়সা ছিল না আমার। এই চিঠিটা আমার একটা ব্যবস্থা করে দিলো। এতোটা নিচু স্বরে কথাগুলো বললো যে লোকটা, তরী ছাড়া কারোর শোনার সুযোগ নেই। ট্রেন থেকে নেমে তরী কিছুতেই তার গন্তব্য মনে করতে পারলো না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App