×

মুক্তচিন্তা

নীরব ঘাতক ডায়াবেটিস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:২১ পিএম

ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্পর্কে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না।

নীরব ঘাতক স্বভাবের যে অসংক্রামক রোগটি দেহে বহু ব্যাধির আহ্বায়ক সেই ডায়াবেটিস রোগটির অব্যাহত অভিযাত্রায় শঙ্কিত সবাইকে এটি নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধে যথাসচেতন করে তুলতেই, তথা এ দেশে এই রোগে যে সমস্যা সৃষ্টি করবে, তার গুরুত্ব উপলব্ধি করে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মো. ইব্রাহিমসহ কয়েকজন বিশিষ্ট সমাজসেবক, প্রবীণ চিকিৎসক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন পেশার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উদ্যোগে ১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘ডায়াবেটিস সত্তে¡ও পরিপূর্ণ জীবনের’ নিশ্চয়তা প্রদানের লক্ষ্যে একটি ডায়াবেটিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করে ডায়াবেটিস রোগীকে ‘অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় এবং বেকার অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে দেয়া হবে না’- এ প্রতিজ্ঞায়, প্রত্যয় ও আদর্শে প্রাথমিকভাবে ১৯৫৭ সালে সেগুনবাগিচায় প্রায় ৩৮০ বর্গফুট জায়গায় অস্থায়ী একটি টিনের ঘরে ডায়াবেটিক চিকিৎসা কেন্দ্র শুরু হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার লক্ষ্যে খোলা এই ডায়াবেটিক বহির্বিভাগটিই (আউটডোর) পরবর্তীকালে শাহবাগ এলাকায় বারডেম (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন ইন ডায়াবেটিস, এন্ডোক্রাইন এন্ড মেটাবলিক ডিজঅর্ডার্স) নামে দেশের গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা-গবেষণা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বারডেম এশীয় প্রশান্ত অঞ্চলে ডায়াবেটিস চিকিৎসার মডেল বা সেরা কেন্দ্র এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮২ সাল থেকে এই প্রতিষ্ঠানটিকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্র¿ণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রে তাদের একান্ত সেরা সহযোগী সংস্থা হিসেবে স্বীকৃতি, সম্মান ও সমীহ করে আসছে।

কাল পরিক্রমায় ডায়াবেটিসের চিকিৎসা, নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা তথা এটিকে একটি আন্দোলনে রূপান্তরের প্রয়াসে সমিতি বারডেম ছাড়াও আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে। এদের মধ্যে রয়েছেÑ ন্যাশনাল হেলথ কেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন), হেলথ কেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এইচসিডিপি), জুরাইনে অবস্থিত রিহ্যাবিলিটেশন এন্ড ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টার (আরভিটিসি) ও ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হসপিটাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট। সমিতির রয়েছে ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রয়েছে ৫ বছরের এমবিবিএস কোর্স। স্নাতকোত্তর শিক্ষা ও উচ্চতর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মিরপুরের দারুস সালামে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস’ (বিআইএইচএস) নামে পৃথক একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগও রয়েছে। দেশের ৫৯টি জেলা সদরে রয়েছে সমিতির অধিভুক্ত ডায়াবেটিক সমিতির হাসপাতাল।

সমিতির প্রথম বছরে ১৯৫৬ সালে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৩৯ জন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকায় অবস্থিত সমিতির শুধু কেন্দ্রীয় গবেষণা ইনস্টিটিউট ‘বারডেমে’ কেন্দ্রীয়ভাবে নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৫ লাখের ওপর। সমিতির অন্যান্য প্রতিষ্ঠান পরিচালিত বিভিন্ন কেন্দ্র ও জেলা শহরে প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিক হাসপাতালগুলোতে আরো প্রায় ২ লাখ রোগী নিবন্ধিত হয়ে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। বারডেমে রেজিস্টার্ড ডায়াবেটিস রোগীদের চিকিৎসা ও নির্ধারিত কয়েকটি পরীক্ষা বিনামূল্যে করা হয়। ‘ক্রস ফিন্যান্সিং’ পদ্ধতির মাধ্যমে অর্থাৎ অন্যান্য রোগীর চিকিৎসা ও ডায়াগনস্টিক সেবা দেয়ার মাধ্যমে অর্জিত আয় ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় করা হয়। এটি সম্পূর্ণভাবেই একটি অলাভজনক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে বারডেমে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার রেজিস্টার্ড ডায়াবেটিস রোগীকে বিনামূল্যে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি পরিচালনার জন্য ব্যয়কৃত অর্থ সরকার ও জনগণের স্বতঃস্ফ‚র্ত অনুদান থেকে আসে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি এ দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যেখানে ডায়াবেটিস ও তৎসংক্রান্ত রোগের চিকিৎসা সম্পর্কীয় বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এর তহবিল জনসাধারণের ও ব্যক্তিবিশেষের অর্থে গড়ে উঠেছে। সুতরাং প্রদত্ত সেবার ফলাফল যাতে লাভজনক হয় সে সম্পর্কে সতর্ক দৃষ্টি থাকে।

সমিতির কর্মকাণ্ড দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক পরিচালিত হয়। উচ্চ কক্ষ হলো ৩২ সদস্যবিশিষ্ট ন্যাশনাল কাউন্সিল বা জাতীয় পরিষদ। সমিতির আজীবন সদস্যদের মধ্য থেকে ১৮ জন ও অধিভুক্ত সমিতির প্রতিনিধিদের মধ্য থেকে ৬ জন সদস্য সরাসরি নির্বাচিত হন ৩ বছর মেয়াদের জন্য। কার্যধারার মধ্যে ধারাবাহিকতা ও যোগসূত্র বজায় রাখার জন্য প্রতি বছর এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অবসরান্তে নির্বাচনের নিয়ম রয়েছে। এছাড়া দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, আর্থিক সংস্থার বরেণ্য ব্যক্তিত্ব, পেশাজীবী ও সমাজসেবকদের মধ্য থেকে সমিতির সভাপতি কর্তৃক ৫ জন মনোনীত সদস্য এবং সরকারের অর্থ, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের (যুগ্ম সচিব পর্যায়ের নিচে নয়) ৩ জন কর্মকর্তা সরকার কর্তৃক মনোনীত সদস্য হিসেবে ন্যাশনাল কাউন্সিলে থাকেন। ন্যাশনাল কাউন্সিল সমিতির প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের জন্য নিম্ন কক্ষরূপী স্ব-স্ব ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বা বোর্ড অব ম্যানেজমেন্ট মনোনয়ন করে থাকে। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিক ফেডারেশনের (আইডিএফ) অন্যতম সদস্য।

প্রতিবারের মতো এবারের ৬৪তম প্রতিষ্ঠা দিবস বা ডায়াবেটিক সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য হলো- ‘ইনসুলিন যার দরকার ইনসুলিন তার অধিকার’। রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সব সময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রতিরোধ করা যায় এবং প্রায় স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে-ছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্ত-সম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীরচর্চা করেন না, গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়াতে সাহায্য করে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারের- (ক) ইনসুলিন নির্ভরশীল এবং (খ) ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীদের ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়।

ডায়াবেটিস ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। বেশি মিষ্টি খেলে ডায়াবেটিস হয়, এ ধারণা ঠিক নয়। খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা এবং ওষুধ এ রোগ নিয়ন্ত্রণের উপায়। খাদ্যের গুণগত মানের দিকে নজর রেখে পরিমাণ মতো খাদ্য নিয়মিতভাবে গ্রহণ, জীবনের সব ক্ষেত্রে নিয়মকানুন বা শৃঙ্খলা মেনে অর্থাৎ কাজকর্মে, আহারে, বিহারে, চলাফেরায়, এমনকি বিশ্রামে ও নিদ্রায় শৃঙ্খলা মেনে চলা দরকার। নিয়ম-শৃঙ্খলাই ডায়াবেটিস রোগীর জীবনকাঠি। ডায়াবেটিস রোগীকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো খাদ্য নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হয়। রোগ সম্পর্কে ব্যাপক শিক্ষা ছাড়া ডায়াবেটিসের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। তবে ডায়াবেটিস বিষয়ে শিক্ষা কেবল রোগীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। একই সঙ্গে আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব এবং ডাক্তার ও নার্সদের শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। রোগী যদি চিকিৎসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে তার উপদেশ ও নির্দেশ ভালোভাবে মেনে চলেন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন তবে সুখী, কর্মঠ ও দীর্ঘ জীবন লাভ করতে পারেন।

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ : বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ন্যাশনাল কাউন্সিল সদস্য। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App