×

সাময়িকী

জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ ড. আহমদ শরীফ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:৪৩ পিএম

জাতীয়তাবাদী চিন্তাবিদ ড. আহমদ শরীফ

ড. আহমদ শরীফ

যাঁরা বলেন গণতন্ত্রের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি, তাঁরা কি ঠিক বলেন? এ প্রশ্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। বাংলা সাহিত্য, বাংলার সংস্কৃতি, বাংলার শিল্প ও চারুকলা, বাংলার সঙ্গীত ও নৃত্য- যেদিক থেকেই আলোচনা করি না কেন সবকিছুতেই এটি প্রমাণিত হচ্ছে যে জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদসহ আরো অনেক রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিক লক্ষ করলে নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। এরপর ১৯৭২-এর শাসনতন্ত্র গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে অবলম্বন করেই জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ অগ্রসর হতে থাকে। এই চেতনাকে যিনি ধারণ করেন, তিনি বাংলা ভাষার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের একজন মহান লেখক ও গবেষক অধ্যাপক আহমদ শরীফ। মধ্যযুগের পুঁথিগুলোকে বাংলা ভাষার উপযোগী করার জন্য তিনি গবেষণার ক্ষেত্রে যে নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন; সেই সাধনার কীর্তিস্বরূপ তিনি তাঁর সময়ে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় পণ্ডিত হিসেবে খ্যাতিলাভ করেন। একই সঙ্গে তিনি সৈয়দ সুলতান তাঁর গ্রন্থাবলি ও তাঁর যুগ শীর্ষক অভিসন্দর্ভের জন্য ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন।

চট্টগ্রামের পটিয়া থানার অন্তর্গত সুচক্রদণ্ডী গ্রামে ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ফেব্রুয়ারি আহমদ শরীফের জন্ম। তাঁর পিতা আব্দুল আজিজ ও মাতা মিরাজ খাতুন। জন্মের পর তিনি চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের কাছে লালিত-পালিত হয়েছেন। এতে অনেকের ধারণা, তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সন্তান।

আহমদ শরীফ পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, ইন্টামেডিয়েট কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ হতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন। পেশাগত জীবনে প্রথমে তিনি দুর্নীতি দমন বিভাগে অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। অল্পকিছুদিনের মধ্যেই দুর্নীতি দমন বিভাগের চাকরি ছেড়ে তিনি কুমিল্লায় নওয়াব ফয়জুন্নেসা কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর তিনি ফেনী ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করেন। ঢাকা বেতারে সহকারী প্রোগ্রাম প্রডিউসারের চাকরি ছেড়ে ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে কাজ শুরু করেন। রিসার্চ অ্যাসিস্টেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর চাচা আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সংগৃহীত পুঁথিভাণ্ডার ও সাময়িক পত্রপত্রিকা সম্ভার বিনা অর্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করার শর্ত জড়িত ছিল। সাহিত্যবিশারদ শর্তারোপ করেন যে, তাঁর মনোনীত ব্যক্তি আহমদ শরীফকে এই পুঁথি ও পত্রিকাগুলোর সম্পাদনার দায়িত্ব দিতে হবে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই শর্তে রাজি হন। এ কাজকে জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করে আহমদ শরীফ মধ্যযুগের সাহিত্য ও সামাজিক ইতিহাস রচনার জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেন। এজন্য তাঁর যুক্তি, বিশ্লেষণ, তথ্যের যথাযথ উপস্থাপন ও পাণ্ডিত্য দিয়ে মধ্যযুগের সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করেন। প্রচলিত ব্যবস্থা ও বিশ্বাস পরিত্যাগ করে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, রাজনীতি, দর্শন ও ইতিহাসসহ নানা বিষয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগে অস্থায়ী লেকচারার হিসেবে নিয়োগ পান এবং দুবছর পর থেকে সাংবাদিকতা বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষকও ছিলেন। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার সেকশনের দায়িত্বের পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেন। ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। ৩৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি আর্টস ফ্যাকাল্টির ডিন ছিলেন একাধিক মেয়াদে। এরপর তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত ‘নজরুল অধ্যাপক পদে’ যোগ দেন।

শিল্পীর স্বাধীনতা প্রশ্নে গ্রন্থে রণেশ দাশগুপ্ত ‘সাহিত্য’ অংশের শুরুতেই লিখেছেন, “শিল্পী বললেই আমরা এক বিশেষ ধরনের লোককে বুঝি। কেউ পটুয়া, কেউ নট, কেউ গায়েন, কেউ বা কবি। এরা এক বিশেষ ধরনের কাজ করে, যাকে আমরা বলি শিল্পকলা।... এঁরা আমাদের মনে রং ধরিয়ে দেয়। আমাদের বাসনা, ভয়, ঘৃণা, আশা ইত্যাদি আবেগকে সক্রিয় করে; আমাদের মানবীয় প্রবৃত্তিকে স্পর্শ করে বইয়ে দেন এক নতুন ধারায়। আমাদের সরু মোটা অনুভ‚তি নিয়ে এদের কারবার। পাথরে হোক, রঙে-রেখায় অক্ষরে হোক, তার বা টানা চামড়ায়, অথবা কুমড়োর খোলে হোক, শিল্পী এরা অভিন্ন এদিক দিয়ে যে এরা সবাই আমাদের প্রবৃত্তি, আবেগ ও অনুভ‚তিতে দোলা দেয়, ঘুম পাড়ায়, নাচায়, সক্রিয় করে। আহমদ শরীফের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। তিনি বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে পঞ্চাশের দশক থেকে আমৃত্যু লিখেছেন। সেই সঙ্গে সংস্কারমুক্ত একটি বৈষম্যহীন সামাজিক রাষ্ট্রের চিন্তাই তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বারবার। সাহিত্য ও গবেষণার ক্ষেত্রে তাঁর মতো রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন লেখক বাংলাদেশে খুবই নগণ্য সংখ্যক। তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনা সম্পূর্ণরূপে জাতীয় মুক্তির আকাক্সক্ষাস্বরূপ।

ড. আহমদ শরীফের মনীষা বুঝতে হলে তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো পাঠ করতে হবে। এই গ্রন্থগুলোতে আছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রত্যয়। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, আবুল মনসুর আহমদ, জসীমউদ্দীন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল, অন্নদাশঙ্কর রায়, হাসান হাফিজুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, রণেশ দাশগুপ্ত, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, আলতাফ মাহমুদ, জহির রায়হান, অজয় রায়, খান আতাউর রহমান, আবুদুল্লাহ আল মামুনসহ যেসব কবি-সাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক-মনীষীর নাম প্রসঙ্গক্রমে সামনে আসে তাঁদের মধ্যে ড. আহমদ শরীফ স্বতন্ত্র এবং সম্পূর্ণরূপে সংস্কারমুক্ত ব্যক্তিত্ব। তাঁর সমগ্র লেখায় আছে বাঙালি ও বাংলাদেশ।

দ্বিজাতিতত্তে্বর ভিত্তিতে (সম্প্রদায়ভিত্তিক) পাকিস্তান ও ভারত প্রতিষ্ঠা ছিল ঐতিহাসিকভাবে রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত। সেই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে গোটা উপমহাদেশকে। ভারত-পাকিস্তান বৈরীভাব, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। ভারতে হিন্দু-উগ্রবাদের উত্থান, পাকিস্তানে বিরাজমান গণবিরোধী রাজনীতি ও সামরিক প্রভাব। একইসঙ্গে কাশ্মিরসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের উত্তেজনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না পারা- এসবই আহমদ শরীফ প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই তিনি লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্পিরিট। যাঁরা বলেন জাতীয়তাবাদ উগ্রতার জন্ম দেয়, সে উগ্রতা ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হয়; তাঁরা দৈশিক ও সামগ্রিক বৈশ্বিক ব্যবস্থাকে বিবেচনায় না এনে এসব কথা বলেন। হিটলার, মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে দৈশিক সংকট এবং আন্তর্জাতিক চাপ দায়ী। একজন হিটলার উত্থানের জন্য ভার্সাই চুক্তি এবং জার্মানির ওপর তৎকালীন বৈশ্বিক পীড়ন দায়ী। ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ, সা¤্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ- এগুলোর কোনোটাই জাতীয়তাবাদ নয়, এগুলো জাতীয়তাবাদের বিরোধী। জাতীয়তাবাদীরা এগুলোকে পান তাঁদের শত্রু রূপে।

‘ভাববুদ্বুদ’ নামক ডায়েরি গ্রন্থে তাঁর ব্যক্তিগত দর্শনের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক নানা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। ড. আহমদ শরীফ এই গ্রন্থের লেখাগুলো জীবদ্দশায় প্রকাশ করেননি; এবং তাঁর উত্তরসূরিদের নিকট বলে গেছেন, এটি তাঁর মৃত্যুর অন্তত পাঁচ বছর পরে প্রকাশ করতে! একজন মুক্তিবুদ্ধিসম্পন্ন সমাজকর্তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর এই গ্রন্থে।

তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে লায়লী মজনু, মধ্যযুগের সাহিত্যে সমাজ ও সংস্কৃতির রূপ, মধ্যযুগের কবি ও কাব্য, বাঙালি ও বাঙলা সাহিত্য, বাঙলা বাঙালি বাঙালিত্ব, স্বদেশ চিন্তা, জীবনে সমাজে সাহিত্যে, স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, প্রত্যয় ও প্রত্যাশা, কালের দর্পণে স্বদেশ, বাংলার সুফি সাহিত্য, বাঙালির চিন্তা-চেতনার বিবর্তনধারা, কালিক ভাবনা, প্রগতির বাধা ও পন্থা, বাঙলার মনীষা, এ শতকে আমাদের জীবনধারার রূপরেখা, সংস্কৃতি, মানবতা ও গণমুক্তি, সংকট : জীবনে ও মননে, শাস্ত্র সমাজ ও নারীমুক্তি, জিজ্ঞাসা ও অন্বেষা, মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য, বিচিত্র চিন্তা, যুগযন্ত্রণা, বিশ শতকের বাঙালি, স্বদেশ অন্বেষা, রাজনীতির সংকট, দর্শনচিন্তা, বাউল তত্ত¡, বাঙলার বিপ্লবী পটভ‚মি, সময় সমাজ মানুষ, বাংলা ভাষাসংস্কার আন্দোলন, বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ, জাতীয়তা গণতন্ত্র ও রাজনীতি, রবীন্দ্রভাবনা, ইদানীং আমরা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যে অনন্য অবদান স্বরূপ তাকে ‘একুশে পদক’ প্রদান করা হয়।

১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ ফেব্রুয়ারি ড. আহমদ শরীফ নিজ বাসভবনে দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর কয়েক বছর পূর্বে এক উইলে তিনি মরণোত্তর চক্ষু ও দেহদান করেন। সে উইলে লেখা ছিল, ‘চক্ষু শ্রেষ্ঠ প্রত্যঙ্গ, আর রক্ত হচ্ছে প্রাণ-প্রতীক, কাজেই গোটা অঙ্গ কবরের কীটের খাদ্য হওয়ার চেয়ে মানুষের কাজে লাগাই তো বাঞ্ছনীয়।’ সে উইল মতে তার দেহ বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজে দান করা হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App