×

মুক্তচিন্তা

উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রসঙ্গে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৩৭ পিএম

উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর অধিকার প্রসঙ্গে

বাংলাদেশ বহু সংস্কৃতি ও ভাষাভাষীর দেশ এবং বাঙালির একক ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র হলেও অন্যান্য ভাষার বিকাশ ও সংরক্ষণের প্রতি যত্নশীল। জল, পানি, মাংস, গোশত নিয়ে আমরা যতই বিতর্ক করি না কেন, কিন্তু ভাষার কোনো সাম্প্রদায়িক পরিচয় নেই। উর্দুতে শুধু মুসলমান নয়, হিন্দুরাও কথা বলে। আবার বাংলাদেশে বসবাসরত উর্দুভাষী বলতে শুধু মুসলিম ভাবাটাও ভুল হবে। চট্টগ্রামের ঝাউতলায় অনেক হিন্দু উর্দুভাষী বসবাস করেন। বাংলাদেশে উর্দুকে পাকিস্তানের সঙ্গে মিলিয়ে চিন্তা করা এবং বাংলা ভাষার প্রতিদ্ব›দ্বী ভাবাটা একটা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। অথচ উর্দুর বিকাশ ভারতে, পাকিস্তানে নয়। ভারতেও বিপুল মানুষের ভাষা উর্দু। সেখানে ২২টি সরকারি ভাষার একটি উর্দু। ৭ রাজ্যে এটা ‘অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ’। কালের প্রবাহে এই জনপদে মুসলিম ধর্মের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনেক অভিবাসী নৃগোষ্ঠী এসে বসবাস করেছে। আরবি ও ফারসি ভাষার পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে এদের ভাষাও ছিল উর্দু। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসরত উর্দুভাষীদের ‘শিক্ষা’ গ্রহণ খুবই সীমাবদ্ধ এবং মাতৃভাষা উর্দুর লিখন-পঠন মৃত। মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অপ্রতুলতা ও আর্থিক অক্ষমতার জন্য এই জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা আজ শুধু মুখের বুলিতে পরিণত হয়েছে। যে দেশের জনগণ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় প্রাণ দিয়েছে, বায়ান্নর যে ভাষা আন্দোলন বিশ্বব্যাপী মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের’ প্রচলন করেছে, সে দেশেই প্রায় ১৫ লাখ মানুষের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ভাষা ‘উর্দু’র লিখিত রূপ প্রায় বিলুপ্ত।

উর্দুতে লিখতে ও পড়তে পারে এমন লোক পাওয়া এখন ভাগ্যের ব্যাপার। উর্দুভাষীদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদানের সঙ্গে উর্দু ভাষা এবং এই ভাষাভাষীদের সংস্কৃতি রক্ষা ও বিকাশ রাষ্ট্রের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাঞ্জাবিদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে বাঙালির ন্যায়সঙ্গত লড়াই। উর্দুভাষীদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান এবং সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় নিয়ে এসে এই রাষ্ট্র একাত্তরের মহান বিজয়কে নৈতিকভাবে অনেক বড় উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। তাই উর্দু স্কুল প্রতিষ্ঠা ও উর্দু ভাষায় শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ এবং উর্দুকে তফসিলি ভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে বাঙালিরা একদিকে যেমন ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে পারে, তেমনি জাতি হিসেবে নিজেকে মহান ও মর্যাদাশীল প্রমাণ করতে পারে।

বাংলাদেশের সংবিধান সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণে রক্ষাকবচ স্বরূপ। কিন্তু সংখ্যালঘু বলতে আমরা সাধারণত ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে বুঝে থাকি। জাতিগত ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের (যেমন, উর্দুভাষী) ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টি পক্ষপাতদুষ্ট। অপরাপর সংখ্যালঘুর তুলনায় ১৫ লাখ উর্দুভাষী প্রকৃতই ভাষাগত সংখ্যালঘু। উর্দুভাষীরা প্রধানত মুসলিম ধর্মাবলম্বী হলেও সুফিবাদের প্রভাব আছে। কাওয়ালি, কাসিদা প্রিয় উর্দুভাষীদের ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় বিশ্বাস বৃহত্তর বাঙালি জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক। উর্দুভাষীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। তাই ভোটের সময় কিছুসংখ্যক উর্দুভাষীর কাছে ভোট চাওয়া নয়, উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে ভাষাগত সংখ্যালঘু তফসিলি সম্প্রদায় রূপে সাংবিধানিক ঘোষণার মাধ্যমে পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান করে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সঠিক অর্থেই নিজেকে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রমাণ করতে পারে।

উর্দুভাষী ক্যাম্পের বাসিন্দাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছিলেন ২০১৪ সালের নভেম্বরে। কিন্তু পুনর্বাসন প্রক্রিয়া এবং এর অগ্রগতি অন্ধকারেই আছে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন ও ত্বরান্বিত করার জন্য উর্দুভাষী জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সমন্বয়ে পৃথক একটি কমিটি করাই হচ্ছে উর্দুভাষীদের প্রত্যাশা। অন্যথায় যে কোনো পুনর্বাসন প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হবে। পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার দ্বারা কোনোরূপ বৈষম্য, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি যেন না ঘটে এবং উর্দুভাষীদের আয়-রোজগার, রুটি-রুজি যেন ব্যাহত না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেয়া আবশ্যক। বাংলাদেশে অবস্থিত বৃহৎ প্রতিটি ক্যাম্পে ‘কমিউনিটি হাসপাতাল’ স্থাপন করার মাধ্যমে চিকিৎসা লাভের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ চাওয়া।

এ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উর্দুভাষীরা যথাসম্ভব ভ‚মিকা রেখে আসছে। উর্দুভাষী জনগোষ্ঠী বিভিন্ন কায়িক শ্রম, ক্ষুদ্র ব্যবসা, ছোটখাটো চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পেশাগত মানোন্নয়নের জন্য প্রকল্পভিত্তিক বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষা চালু ও সরকারি ঋণ, অনুদান প্রদানের দ্বারা এদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সম্ভব। জীবিকা নির্বাহের জন্য অনেকেই বেনারসি তাঁত ও শাড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বেনারসি শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানি সুযোগ দানের জন্য সরকারি সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা অতীব প্রয়োজন। তাই বেনারসি শিল্পের বিকাশ ও রপ্তানি সুযোগ দান ও অন্যান্য পেশাজীবীর পেশার মানোন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। এছাড়া সরকার ঘোষিত প্রতিবন্ধী ভাতা, বয়স্ক ভাতা ইত্যাদি ভাতা উর্দুভাষী জনগণের মধ্যে যাতে বণ্টন হয় সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান সরকারের মানবিক কর্তব্য।

উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে দেশপ্রেমে বলীয়ান করা বাঙালি ও উর্দুভাষী উভয় জনগোষ্ঠীর নৈতিক দায়িত্ব। সেজন্য উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীকে নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন কর্মসূচি যৌথভাবে পালন করাও সময়ের অন্যতম দাবি। অথচ দুঃখের বিষয় হলো, বাংলাদেশের মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো এক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না। যেহেতু উর্দুভাষীদের ভোটাধিকার দেয়া হয়েছে এবং এদের পূর্ণ নাগরিক অধিকার দেয়াও হবে রাষ্ট্রের জন্য করণীয়, সেহেতু মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এখনই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া। সংশ্লিষ্ট সবার উচিত উর্দুভাষী জনগোষ্ঠীর পূর্ণ নাগরিক অধিকার বাস্তবায়নের জন্য উল্লেখিত দাবিগুলো মানবিক দৃষ্টিতে বিবেচনা করা এবং জাতি, ভাষা, ধর্ম নির্বিশেষে সংহতি প্রকাশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করা।

 আহ্বায়ক, বাঙালি ও উর্দুভাষী সংহতি পরিষদ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App