×

মুক্তচিন্তা

ভাষা আন্দোলন ও আজকের কথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৪৪ পিএম

পূর্ব বাংলার বাঙালির তাবৎ পরিচিতি, তাবৎ গৌরব, তাবৎ সাফল্য সব কিছুই এসেছে ১৯৪৮ ও ১৯৫২-এর ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের হাত ধরে। বাঙালির যত কিছু অর্জন তারও মূলে ওই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনই। ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টে সাম্প্রদায়িক ‘মুসলিম রাষ্ট্র’ হিসেবে পাকিস্তানের জন্ম হলো। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান তুলে ভারতকে দ্বিখণ্ডিত করে মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের আত্মপ্রকাশ ঘটল। যে উগ্র সাম্প্রদায়িক আবহ তৈরি হয়েছিল পাকিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে আজ তা কল্পনা করলেও শিউরে উঠতে হয়। যারা ওই দিনগুলো এবং তৎকালীন রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেছেন তাদের পক্ষেই একমাত্র সম্ভব সে যুগের সেই ভয়াবহ আতঙ্কময় পরিবেশ সঠিকভাবে তুলে ধরা অন্য কারো পক্ষে নয়। ভাইয়ে ভাইয়ে ছুরি চালাচালি, হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, নারী অপহরণ, নারীর সম্ভ্রমহানির ওই বর্বর ঘটনাগুলোকে স্মরণে আনা বা বর্ণনা করাও একমাত্র তাদের পক্ষেই সম্ভব। ওই বিষাক্ত পরিবেশ বাংলা ও উর্দু সাহিত্যে চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাসে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আজ সে যুগের প্রত্যক্ষদর্শীর সংখ্যা যেমন নিদারুণভাবে কমে গেছে, বাজারে ওই ঐতিহাসিক ঘটনাবিষয়ক সে সময়কার প্রকাশিত বই-পুস্তকও আর পাওয়া যায় না। ফলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী, তরুণ-তরুণীদের পক্ষে তদানীন্তন ভয়াবহ পরিস্থিতির বিষয়ে কোনো কিছু সঠিকভাবে জানার সুযোগও ঘটছে না। বস্তুত প্রজন্মের পর প্রজন্ম যেন ছুটে চলেছে ইতিহাস থেকে দূরে অনেক দূরে। ১৯৪৮-এর মার্চে করাচিতে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে ওই সংসদের সদস্য জননেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত যখন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন, খাজা নাজিমুদ্দিন, লিয়াকত আলী খান (পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী) এবং অন্য মুসলিম লীগ নেতারা ধীরেন দত্তের ওই ন্যায়সঙ্গত দাবির বিরোধিতাই শুধু করেননি, বাংলা ভাষা-সংক্রান্ত দাবি উত্থাপনের জন্য তাকে ‘ভারতের দালাল’, ‘ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমন’ প্রভৃতি বলে আখ্যায়িত করতেও পরোয়া করেননি। প্রতিবাদে দ্রুততম সময়ের মধ্যে অধিবেশন ত্যাগ করে বিমানযোগে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্ররা ঢাকা বিমানবন্দরে ধীরেন দত্তকে সশ্রদ্ধ সংবর্ধনা জানান এবং তাকে বীরোচিত মর্যাদায় স্বাগত জানান। করাচির ঘটনাবলি জানার পর সেদিনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল, বামপন্থি ও জাতীয়তাবাদী তরুণ ছাত্রনেতারা ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করে পূর্ব বাংলার সর্বত্র হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, সভা-সমবেশ অনুষ্ঠানের জন্য ছাত্র সমাজের প্রতি আহ্বান জানালে প্রদেশের অনেক জেলাতেই যেমন রাজশাহী, পাবনা, রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও আরো কিছু জেলায় বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী এবং অভিভাবকদের উদ্যোগে অত্যন্ত সফল কর্মসূচি পালিত হয়। এই আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেয়ার লক্ষ্যে ব্যাপক ধরপাকড়ও শুরু হয়। অনেক জেলায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং বেশ কয়েকটি জেলায় ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে হরতাল, মিছিল প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয়। ঘটনার বর্ণনা অত্যন্ত সহজ কিন্তু তৎকালীন বাঙালি মুসলিমের কথা চিন্তায় আনলে, সাম্প্রদায়িকতার ও তার তত্ত্ব দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগের পটভ‚মির কথা ভাবলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলা কত কঠিন ছিল। সদ্য পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে না হতেই বাঙালি যুবসমাজ উর্দু নয়, আরবি নয়, ইংরেজি নয় বাংলা ভাষার উচ্চ মর্যাদার দাবিতে যে আন্দোলনটি গড়ে তুললেন তা যে কোনো বিবেচনায়ই অসাধ্য সাধন। অনেক ক্ষেত্রে মোল্লা-মৌলবিরাও ইসলামের দোহাই দিয়ে এবং বাংলা ভাষা ‘মুসলমানের ভাষা নয়’, ‘হিন্দুর ভাষা’, ‘ভারতের ভাষা’ এবং সে কারণে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যারা আন্দোলন করছেন তারা রাষ্ট্রদ্রোহী, পাকিস্তানের দুশমন ও ভারতের দালাল বলে চিহ্নিত করে ‘নারায়ে তকবির, আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি সহকারে লাঠি, ফালা, সড়কিসহ নানাবিধ অস্ত্র সহকারে এসে প্রকাশ্য রাজপথে বহু ক্ষেত্রে পুলিশের সহযোগিতায় (প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে) হামলা করে মিছিলকারীদের অনেকের মাথা ফাটিয়ে দিতে বা তাদের শরীরের রক্ত ঝরাতেও কোনো দ্বিধা বা সংকোচ আদৌ করেননি। খোদ পাবনা শহরে আহলে হাদিস নামক তৎকালীন এক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রধান জনৈক মওলানার নেতৃত্বে একইভাবে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে হামলা হয়েছিল। এই একই মহল নাটকের অভিনয়, সংগীত-নৃত্যানুষ্ঠান, আলপনা আঁকাসহ সব সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্য বিরোধিতা করত সেগুলোকে ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে। কিন্তু তাদের সশস্ত্র আক্রমণকারীদের কাউকেই তখন পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি বা কোনো মোকদ্দমাও দায়ের করেনি বরং দুধ-কলা দিয়ে পুষেছে। ভাষা আন্দোলন দমন করার জন্য অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ ও অসংখ্য শিক্ষক-ছাত্রকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ করা হয়। আবদুল মতিন, গাজীউল হক, শেখ মুজিবসহ আন্দোলনের বহু নেতাকর্মীকেও কারারুদ্ধ করতে পূর্ববাংলার কোথাও বিলম্ব করা হয়নি, সংবাদপত্রে সঠিক সংবাদ প্রকাশ করতেও দেয়া হয়নি, যত্রতত্র ১৪৪ ধারা জারি করে ভাষা আন্দোলনের শান্তিপূর্ণ সভা-সমিতি মিছিল-সমাবেশ অনুষ্ঠানে বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে। তৎকালীন সমগ্র ইতিহাসের প্রতি চোখ বুলালে, ঘটনাবলি স্মরণে আনলে এই সত্য উদঘাটিত হয় যে ধর্মকে ধর্মের জায়গায় এবং রাজনীতিকে রাজনীতির জায়গায় পৃথকভাবে স্থান না দিতে পারলে দেশ ও জনগণের সমূহ ক্ষতি হয় এবং এই ক্ষতির মাশুল আজো বাঙালি জাতিকে দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে কেন পাকিস্তানের তদানীন্তন শাসকগোষ্ঠী মানতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি বাঙালি তরুণ-তরুণীদের। মাতৃভাষার মাধ্যম ছাড়া যে শিক্ষিত হওয়া যাবে না, অশিক্ষিত মূর্খ হয়ে বেঁচে থাকতে হবে, চাকরির বাজারে ঠাঁই না পেয়ে বেকারত্বের ভয়াবহতাই জীবনের সম্বল হয়ে দাঁড়াবে, জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যগুলো যে হারিয়ে গিয়ে গৌরবহীন ঐতিহ্যবর্জিত ভবিষ্যতের এক দিশাহীন জাতি হিসেবে বাঙালিকে গড়ে উঠতে হবে, বাঙালি সংস্কৃতি, বাঙালির অর্জন সবই যে অবলুপ্তির অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবে তা দিব্যি উপলব্ধি করেছিলেন দেশপ্রেমিক শিক্ষক-ছাত্র-অভিভাবক সমাজ। তাই ওই আন্দোলন ধর্মান্ধ শক্তিগুলোর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও, সরকারের পক্ষ থেকে পরিচালিত তাবৎ অপপ্রচার এবং দমননীতির প্রয়োগ সত্ত্বেও অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ধর্মান্ধ শক্তিগুলো ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করার ফলে স্পষ্টভাবে সবাই উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিল যে ওই শক্তিগুলোই হলো শুধু বাংলা ভাষারই শুধু নয়, বাংলা সাহিত্য, বাংলা কবিতা, বাংলা উপন্যাস, বাংলার শিল্পকলা, বাংলার সংগীত-নৃত্য প্রভৃতিরও চরমতম শত্রু । তাই সেদিন জাতি তাদের কাছে মাথা নোয়ায়নি। ওই অপশক্তিগুলো তাদের কর্মকাণ্ড ভাষা আন্দোলন, বাংলার ভাষা সংস্কৃতির বিরোধিতাই শুধু করেনি বায়ান্ন-পরবর্তী বাঙালির সব আন্দোলন-সংগ্রাম, গণতন্ত্রের দাবি, যুক্তফ্রন্ট গঠন, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, বাঙালির স্বায়ত্তশাসন, বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা, সম্মিলিত ছাত্র সমাজের ১১ দফা, ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান, ১৯৫৪ ও ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক শক্তির প্রবল বিরোধিতাও তারা সক্রিয়ভাবে করেছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে ওই অপশক্তিগুলোই তাদের গণবিরোধিতা, বাঙালিবিরোধিতা নগ্নভাবেই প্রকাশ করে বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করার অপচেষ্টায় ‘পাকিস্তান’ ও ‘ইসলাম’ রক্ষার নামে অবতীর্ণ হয়েছিল সে ইতিহাস সারা বিশ্বের কাছেই পরিচিত। যা হোক ভাষা আন্দোলন যে বাঙালির পরবর্তী সব আন্দোলন-সংগ্রামের প্রধানতম উৎস তা নিয়ে দ্বিমত নেই, দ্বিমত নেই ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ অসম্ভব হতো যদি ভাষা আন্দোলন না হতো, দ্বিজাতিতত্ত্বের উগ্র ধর্মান্ধ চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে যদি না অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা বাঙালির মননের গভীরে স্থান করে নিতে পারত তবে পাকিস্তান ধ্বংসের মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। সেক্ষেত্রে বাঙালি জাতির অবলুপ্তিই হয়তো বা একমাত্র বিকল্প হয়ে দাঁড়াত। বাঙালি জাতি জীবনমুখী। জীবনকে ভালোবাসে। তাই নিজের ও জাতির জীবনকে রক্ষা করতে সব প্রতিক‚লতাকে অগ্রাহ্য করে, সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেও মাতৃভাষার মর্যাদাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামকে চ‚ড়ান্ত ত্যাগ স্বীকার করেও সাফল্যমণ্ডিত করেছে। এই এত ঐতিহ্যমণ্ডিত, গৌরবোজ্জ্বল ও ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত ভাষা আন্দোলনের মাসে যখন দেখি তার প্রধান দাবি, ‘জাতীয় জীবনের সব ক্ষেত্রে মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন চাই’, আজো অবহেলিত, যখন দেখি আরবি, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছে, যখন মাদ্রাসা শিক্ষা রাষ্ট্রীয় আনুক‚ল্যে দাপটের সঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের (এবং মুক্তিযুদ্ধের) প্রত্যক্ষ ও আদর্শিক দুশমন জামায়াতে ইসলামী বৈধভাবে এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাচ্ছে, যখন দেখি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক শত্রু হেফাজতে ইসলাম রাষ্ট্রের প্রধান উপদেষ্টার ভূমিকায় কার্যত অবতীর্ণ হতে পেরেছে এবং সর্বোপরি যখন দেখি ভাষাসংগ্রামীদের একটি তালিকা পর্যন্ত তৈরি করে তা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করে তার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে রাষ্ট্র কিছুতেই এগিয়ে আসে না, তখন একজন ভাষাসংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবতেই হয় ভাষা আন্দোলন নতুন উদ্যমে আবারো শুরু করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের অসম্পূর্ণতা এবং তার আদর্শিক বিপর্যয় প্রতিরোধে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিকল্প নেই। বাঙালির অমূল্য সম্পদ বাউলদের আজ স্থান হচ্ছে কারাগারে, তারা চিহ্নিত হচ্ছেন ধর্মদ্রোহী, রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে যেমন তারা হতেন একাত্তর পূর্ববর্তী অন্ধকার দিনগুলোতে তখন ভাবি আবারো যুদ্ধ চাই, আবারো একাত্তর চাই। জাতির ব্যাপকতম ঐক্য চাই। না হলে সব অর্জনই ব্যর্থ হবে, নতুন অর্জনের পথও হবে রুদ্ধ। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App