×

মুক্তচিন্তা

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্কুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৩৮ পিএম

প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্কুল
প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্কুল
আমাদের শিশুদের জন্য কোনো পরিকল্পিত শিক্ষায়ন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আমরা এখনো ঠিকমতো জানি না আমাদের শিশুদের জন্য কেমন স্কুল চাই, সেখানে কীভাবে পড়ানো উচিত, শিশুরা কতটুকু শিখতে পারছে এবং আমরা কতটুকু শেখাতে পারছি? দেখা যাচ্ছে অপরিকল্পিত শিক্ষায়ন ব্যবস্থার শুরুটা হচ্ছে প্রাথমিক স্কুল থেকে। তারপর সেটা মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। কীভাবে অপরিকল্পিত শিক্ষায়ন আমাদের স্কুলের শিক্ষাব্যবস্থাকে পিছিয়ে দিচ্ছে সেটাই আমি আমার লেখায় আজ তুলে ধরব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশের সব প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছেন। এজন্য ১ জানুয়ারি সারাদেশে ‘জাতীয় পাঠ্যপুস্তক উৎসব’ ঘোষণা করা হয়। বছরের প্রথম দিনই শিশুরা স্কুল থেকে সব বই পেয়ে যাচ্ছে এবং প্রতিটি স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকরা জেনে যাচ্ছে, শিশুরা প্রথম থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কী কী বিষয়ের ওপর অধ্যায়ন করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারি স্কুলগুলো বাদে অন্য স্কুলে এই নির্দিষ্টসংখ্যক বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত কিছু বই শিশুদের পড়ার জন্য দিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং সেটা শিশুর অভিভাবককে সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই কিনতে হচ্ছে এবং সেই শিশুকে পড়তেও বাধ্য করা হচ্ছে। কিন্তু কেন? তাহলে কি এই অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকগুলো শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত নয়? শিক্ষকরা বলছেন পর্যাপ্ত নয়। অপরিকল্পিত শিক্ষায়নের শুরুটা এখান থেকেই। এটাই বরং হওয়া উচিত ছিল শিশুরা সিলেবাসের বাইরে যে বইগুলো আছে সেগুলোও পড়বে। কিন্তু সেগুলো পড়বে জানার জন্য, আমাদের শিক্ষক এবং অভিভাবকরা তাদের সেগুলো পড়ার জন্য উৎসাহিত করবেন। যদি এই অনুমোদিত বইগুলো পড়ার জন্য পর্যাপ্তই না হবে, তাহলে কেন আমাদের এই অনুমোদিত বইগুলোর মানোন্নয়নে নীতিনির্ধারকরা কোনো ভ‚মিকা রাখছে না? এই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়। এবার ফিরে আসি বাস্তবতায়। প্রতিটি স্কুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের বাইরে স্কুলের দেয়া কিছু নির্দিষ্ট বই পড়তে হবে। এগুলোকে বলা হচ্ছে সহায়ক বই কিন্তু আসলে এগুলো অনুমোদনহীন বই। প্রশ্ন আসছে, কেন ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে ভিন্ন ভিন্ন সহায়ক বই দেয়া হচ্ছে? যদি পাঠ্যপুস্তকের সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্য সহায়ক বইয়েরই দরকার হবে তাহলে আমাদের উচিত শিশুদের সেগুলোকে স্কুলে পড়তে বাধ্য না করা। বরং এই সহায়ক বইগুলো শিশুরা অবসর সময়ে পড়ে নেবে। এতে সব স্কুলে একটি নির্দিষ্ট সিলেবাস থাকবে এবং শিশুরা পড়ার অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি পাবে। আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে শিশুদের ওপর এই অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে আমরা যেন তাদের শারীরিক এবং মানসিক বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত না করি। প্রাথমিক শিক্ষার আরেকটা বড় সমস্যা হলো অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন স্কুল। যেখানে সাধারণত প্লে গ্রুপ থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। কিছু কিছু কিন্ডারগার্টেন আছে যারা ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াচ্ছে। আমার তো মনে হয় না বাংলাদেশে কতগুলো কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো ধারণা আছে। এই স্কুলগুলোর মধ্যে অধিকাংশই নিবন্ধনহীন, যাদের কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। এই স্কুলগুলো চলছে যার যেমন ইচ্ছে ঠিক তেমন করে, শিক্ষার থেকে মুনাফা করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। নিবন্ধনহীন এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর জন্যও নেই কোনো নির্দিষ্ট বই। কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত জাতীয় পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বইসহ তারা তাদের ইচ্ছামতো অনুমোদনহীন বইগুলো শিশুদের পড়তে বাধ্য করছে। বিশেষ করে প্লে এবং কেজি গ্রুপের শিশুরা কী বই পড়বে এ বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনো সিলেবাস নেই। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হলো এই স্কুলগুলোতে প্লে এবং কেজি গ্রুপের শিশুদের জন্য ৫ থেকে ১০টি বই চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে এবং তাদের মাসিক, ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। দেখা যাচ্ছে, অধিকাংশ স্কুলগুলোতে শিশুদের সঠিকভাবে শিক্ষাদানের কোনো পরিবেশ নেই, ভালো শিক্ষক নেই, নেই কোনো খেলার মাঠ। যেহেতু এই কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন দেয়া হয়, তাই অধিকাংশ শিক্ষকই টিউশনিতে নিজেদের ব্যস্ত রাখেন। এতে ক্লাসরুমে শিশুরা যে আসলেই কিছু শিখছে না, সেটা তো প্রতীয়মান। আরেকটি বিষয়, শিক্ষকরা ক্লাসে কী পড়াচ্ছেন এবং কীভাবে পড়াচ্ছেন? ৩-৫ ঘণ্টার স্কুল শেষ করে একজন শিশু বাসায় ফিরে আসার পর তাকে ছুটে যেতে হচ্ছে স্কুলের কোনো শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে অথবা যেতে হচ্ছে কোনো কোচিং সেন্টারে। সেখান থেকে পড়ে এসে বাসায় কোনো শিক্ষকের কাছে পড়তে হচ্ছে। স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে হচ্ছে, আবার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে পরের দিনের জন্য। একজন শিশুকে সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যে একটু খেলাধুলা, বিশ্রাম, পড়াশোনার বাইরে গান করা, ছবি আঁকা ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি সময় দেয়ার সুযোগটা কি তাকে আমরা দিচ্ছি? উত্তর, না। উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা স্কুলের পড়া স্কুলে শেষ করে আসে, মাঝে মাঝে তাকে কিছু হোমওয়ার্ক দেয়া হয়, শুধু জানার জন্য কিছু বই প্রতিদিন সঙ্গে করে দিয়ে দেয়া হয়, যেগুলো তারা বাসায় বসে অবসর সময়ে পড়বে। সেখানকার শিশুরা স্কুলে শুধু পড়াশোনাই করে না, বরং সেখানে খেলাধুলারও ব্যবস্থা থাকে, স্কুলে লাইব্রেরি থাকে যেখানে তারা গিয়ে পড়তেও পারে। যে শিশু যেটা করতে ভালোবাসে, স্কুল থেকে তাকে সেটা করারই সুযোগ দেয়া হয়। ধরুন, কোনো শিশু গান শিখতে আগ্রহী, সে সেটা শেখার সুযোগ পাবে। যে শিশু দাবা খেলার প্রতি আগ্রহী, তাকে সেটা শেখার সুযোগ করে দেয়া হয়। তাদের সঙ্গে যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে তুলনা করা হয় তাহলে মনে হবে আমাদের স্কুলগুলো কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে গড়ে ওঠেনি। শিক্ষকদের ক্লাসরুমে গিয়ে শিশুদের পড়ানোর কথা কিন্তু দেখা যাবে, শিক্ষকরা সেটা না করে, সামান্য কিছু পড়িয়ে আগামী দিন স্কুলে কী কী পড়ে আসতে হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। কারণ কিন্তু খুব সহজ। আমাদের স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ২৫:১ থাকা উচিত। কিন্তু বাস্তবতায় এটা কখনোই পাওয়া যাবে না। তাহলে একজন শিক্ষক কীভাবে তার দ্বিগুণ বা চারগুণ শিক্ষার্থীকে সঠিকভাবে পড়াবেন? তাই সব ক্লাসে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত দেখে শিক্ষক সহকারী নিয়োগ দেয়াটা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে স্কুল শিক্ষকদের যে বেতন দেয়া হয় সেটা তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। তাই তাদেরও বাধ্য হয়ে ক্লাসে ঠিকমতো না পড়িয়ে প্রাইভেট পড়ানোর দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। তাই সব স্তরের শিক্ষকের জন্য আলাদা বেতন স্কেল দেয়াটাও জরুরি। শিক্ষকদের জন্য একটি সম্মানজনক বেতন স্কেল দেয়ার পাশাপাশি যদি প্রাইভেট পড়ানো পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া যায়, শিক্ষকরা ক্লাসে ঠিকমতো পড়াচ্ছেন কিনা সেদিকে যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ দৃষ্টি রাখেন, শিশুদের স্কুলের পড়া যেন স্কুলেই সম্পন্ন করে দেয়া হয়। প্রতিটা স্কুলে যেন শিক্ষার সঠিক পরিবেশ থাকে, মানসম্মত শ্রেণিকক্ষ যেন থাকে, এ বিষয়গুলোতে যদি লক্ষ রাখা হয় তাহলে আমরা শিশুদের আনন্দ দিয়ে পড়াশোনার করার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারব। একই সঙ্গে আমরা শিশুদের দিতে পারব একটি পরিকল্পিত শিক্ষায়ন। ড. গৌতম সাহা, সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App