×

সাহিত্য

রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেট : সনেটের নতুন দিগন্ত...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৭:৩১ পিএম

রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেট : সনেটের নতুন দিগন্ত...

কবি ও গবেষক রাজুব ভৌমিক।

রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেট : সনেটের নতুন দিগন্ত...

রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেট।

কবিতা নদীর মতো নিত্য তার বাঁক বদলায়। গতি নেয় দিক থেকে দিগন্তে। সাগর পাড়ি দিয়ে চলে যায় মহাসাগরে। আকাশের ওপারে, আকাশে। অথবা কবিতা ঘুড়ির মতো উড়ে বেড়ায়। বিমূর্ত জীবন বীক্ষণের দশদিকে যাত্রা করে কবিতা। যাত্রাই পৃথিবীর সব আলোর মধ্যে একটা ষড়ৈশ্বর্য-সুন্দর আলো। এই আলোই অবশেষে একটা করণকৌশল ও স্বতন্ত্র ডিকশনে কবিকে কবিতা নির্মাণে সহায়তা করে। নীড়ে ফেরা পাখির মতো ব্যাকুল হয়ে ওঠেন কবি। কবিতা বা কবিতার রূপ নির্মাণে তার ভেতরে একটা প্রচণ্ড অস্থিরতা, ব্যাকুলতা তৈরি করে। বিষয় যেমন রূপকে নির্মাণ করে তেমনি রূপকেও নিয়ন্ত্রণ করতে কবিকে সাহায্য করে। আর তখনই কবিতা সাধারণ থেকে জৈব-অজৈব সত্ত্বার দার্শনিকতার দিকে, সবুজ আলোর দিকে, সুন্দরের যাত্রা করে। কবিতা বহু বিষয়ের পরিধিকে স্পর্শ করে বিষয়ীগত আনন্দকে রূপ-লাবণ্যের মধ্য দিয়ে নতুন চিন্তা-চেতনাকে উসকে দেয়। কবিতা পরিপার্শ্বিকতাকে, পরিবেশ-পরিস্থিতিকে সঙ্গে নিয়ে যুক্ত হয় এক বিরাট-বিশাল আশা-আকাঙ্ক্ষার তাজমহলে। সুন্দর-সাবলীল স্বপ্নের শহরে। অবশ্য খুব কম কবিই তার কবিতায় নতুন স্বপ্ন নির্মাণে পারঙ্গমতা দেখাতে পারেন। বর্তমানে ছন্দ-গন্ধ না জানা, শুধু গদ্যে লেখা অধিকাংশ কবিতা নিছক কতোগুলো শব্দের তাল-গোল মাখানো মাংসের পিণ্ড, যেখানে বহুস্বরের সম্মিলন বা কাব্য-সৌন্দর্য নেই। শুধু সংকীর্ণ এক মনোবৃত্তিসহ কবিতার নগ্ন রূপ নির্মাণ ছাড়া আমরা সেখানে আর তেমন কিছুই পাই না। জীবনযাত্রার, চিন্তা, অভ্যাস ও রুচির ক্ষেত্রে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আমরা এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ করছি প্রবাসী কবি রাজুব ভৌমিকের ‘আয়না সনেট’-এর এই চতুর্দশপদী কবিতাগুলোর মধ্যে। তার স্বাভাবিক কবিতাগুলোও দেখা (পৃথিবীর একাংশ দেখে ফেলেছেন এই কবি) ও সময়ের বিবর্তনে অতীতের মতো সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক কামনা-বাসনাতে সীমিত নয় রাজুব ভৌমিকের কবিতা। তার কবিতা পাঠকের সামনে সত্যকে অনুসন্ধানের এবং উপলব্ধির অবিরাম ভালোবাসা। রাজুবের কবিতা নতুন মানুষের জীবনে নতুন চাহিদা তৈরি এবং পরিপূর্ণ হবার বারবার তাগিদ দেয়। কবিতার এই দুর্ভিক্ষের সময় রাজুব ভৌমিক তার আয়না সনেট নিয়ে আমাদের চেতনায় ভিন্নস্বরের গান শোনালেন বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। রাজুব আমাদের দিলেন নতুন ধানের মৌ মৌ গন্ধ। ভিন্ন স্বাদ, যুদ্ধের দামামা- পেতে শুধু অবহেলা জন্মায় গরিব, ক্ষেতে করে শ্রম বন্ধ্য, ফসলে মুনিব; নিষ্ফল কপাল তার, শোষিত জীবন, বলহীন বুকে সর্ব, লাথিতে মরণ। ক্লেশ দুঃখ নিয়ে, অতিবাহিত সংসার, বেশ হলো ভাবে, ধনাঢ্য যে পরিবার; করুণ কাহিনি তার, ভূতেও না শুনে, তরুণ আত্মা ঝরে, রাখে না কেউ মনে। মহাকাব্য হয়নি কভু, কথা নিঃস্বরে, অদ্রাব্য তাহার গল্প, করুণা ভবের; ডরে নাহি চলে, ভবে দিন গরিবের, মরে সে অযথা, নিয়ে বোঝা সংসারের। গরিবের জন্ম ভবে, জন্য ভুলিবার; পাপের কুদৃষ্টি যে, সারা জনম তার। -গরিবের জন্ম রাজুব ভৌমিক কবিতার এই পারঙ্গমতার দুয়ারে, নিত্য-নতুনের আখড়ায় ব্যথার পিরামিডসহ কাহারবা তালে কড়া নাড়ছেন। সমাজ-বাস্তবতা, শিল্পের সুন্দর-ষড়ৈশ্বর্য বয়ান ছাড়া তার কবিতায় সংকীর্ণ ও বোধহীনতা, সমাজের উদাসীনতা, প্রাপ্তির লোলুপতা, মেরুদণ্ডহীনতা, দালালি মনোবৃত্তির তেমন কিছুই নেই। রাজুব ভৌমিকের কবিতা প্রেম-ভালোবাসা, সমাজ বিপ্লবের, বিদ্রোহের, মনো-বিকাশের, রাষ্ট্র পরিবর্তনের হাতিয়ার হয়ে আমাদের চাহিদাকে শিল্পের নান্দনিক মোড়কে উপস্থাপন করেছে। রাজুব আমাদের দিচ্ছেন পলিনড্রম কবিতার ঘ্রাণ, রমাকান্তকামার- বাংলা কবিতায় এ সত্যিই বিরল। সঙ্গত কারণেই রাজুব ভৌমিকের কবিতা ভাষাহীন অবস্থান থেকে ভাষাসূত্রশিল্পকে অবলম্বন করে নতুন দিগন্তে উপনীত হয়েছে। তাই তার কবিতা যেমন তার নিজের সৃষ্টি তেমনই পাঠকেরও। কারণ পাঠোদ্ধারের মধ্য দিয়ে পাঠক কবিতাকে নতুন করে, নতুন ভাবে রচনা করেন- সামনে সে বলে মধুতুল্য মিষ্ট কথা পিছনে ঘটায় বিঘ্ন, বলিয়া অযথা সারাদিনে বসিয়া ইন্দ্রিয় সুখাসনে আশ্বিনে দেয় পুজা, শারদা উপাসনে। দুঃসাধ্যকরণ বলিয়া জগতে নাই সান্ধ্য হইলে করে কুকর্মের লড়াই যত সহজে জ্ঞাত হয় পাখির গতি তত কঠিন মনুর, ব্যগ্র অনুভূতি। সৎসঙ্গ বিমুখতা ঈর্ষায় কাটে দিন অঙ্গ জ্বলে পর সুখে কাঁদে সে কঠিন মিথ্যাই শক্তি তার, শিশুর শক্তি কান্না। -মানুষ কবি রাজুব ভৌমিকের কবিতায় আছে বহুমাত্রিকতা। এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি লেখেননি। বহু দেশ ভ্রমণ করা এই কবি-পুরুষটি যখন যেখানে যা দেখেছেন, যা তার মনকে কষ্ট বা ভালোবাসার আগুনে পুড়িয়েছে- তিনি তাই নিয়েই লিখেছেন। বিদেশে থাকলেও তার মন সব সময় পড়ে রয়েছে আমাদের এই বাংলায়। তার নিজের জন্মভূমিতে। বাংলাদেশে। জন্মভূমির মায়া তিনি কখনো ত্যাগ করতে পারেননি। বাংলার আকাশ বাতাস, তেপান্তর, নীল জোছনা, কাশবন, ধানক্ষেত, রৌদ্র-মেঘের লুকোচুরি, মুক্তিযুদ্ধ, অসহায় সমাজের কথা, ধনী-গরিবের কথা- দেশের মানুষের সফলতা-অসফলতার কথা তার আয়না সনেটে উঠে এসেছে নিপুণতা এবং বেশ মুন্সীয়ানার সাথে- নয়নের অশ্রু ঝরে, ভাবিলে আশায়, বিরহের জলে ভেসে বুঝি প্রাণ যায়; সখির লাগিয়া নয়ন, স্বপ্নতে ভাসে, শিশির কাঁদে নীরবে, কত বিলাসে। আশাতে জীবন বাঁচে, মৃত্যু সখি বিনে, তোমাতে স্বয়ং সমর্পিত, প্রেম গো মনে; যত শিশুর আশা, হবে অনেক বড়, তত মোর প্রাণ, চাহিবে প্রেম খগড়। -নয়নের আশা রুপালি মাছেরা, আনন্দে মাতায় নদী অলি গানে গানে, নাচে দ্রৌপদী; সবুজ-শ্যামল স্বিগ্ধতা, রূপসী বাংলা, অবুজ মনখানি, নাহি বুঝে গো জ্বালা যতদিন না দেশে ফিরে আসিব শেষে কঠিন মৃত্যু, বঙ্গ চিন্তায় পরিশেষে। -হৃদয়ে বাংলাদেশ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বাংলাভাষা ও সাহিত্যের প্রথম সার্থক সনেট রচয়িতা। বাংলায় তিনিই প্রথম চতুর্দশপদী কবিতা রচনা করেন। চতুর্দশপদী কবিতা লিখতে গিয়ে মধুসূদন কবি ইতালীয় কবি পেত্রার্ক, মিল্টন, শেকসপিয়র ও ফরাসি কবিতার কাব্যরীতি অনুসরণ করেছিলেন। স্যার ফিলিপ সিডনি, এডমন্ড স্পেন্সার, মাইকেল ড্রাইটনসহ আরো অনেকেই সরেটকে ভেঙেচুরে নতুন ধারায় এনে দিয়েছিলেন। সনেট বা এই চতুর্দশপদী কবিতার বেশ কিছু নির্দিষ্ট নিয়মকানুন আছে। কালে কালে কবিরা এ নিয়মের ব্যত্যয়ও ঘটিয়েছেন। সচেতনভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়েই তারা কাব্য প্রয়াসের এ বিধিবদ্ধতা ভেঙে চুরমার করেছেন। বাংলা সনেটেও ছন্দ-গন্ধ ও বৈশিষ্ট্যে পরিবর্তন এনেছেন কেউ কেউ। অনেকেই পঙ্ক্তি বিন্যাসে এনেছেন নতুনত্ব। মধুসূদনের সেই চতুর্দশপদী কবিতা পরিবর্তিত হয়ে নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে পাঠকের কাছে। উপস্থাপনের এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া বলেই আমাদের ধারণা। আমাদের আজকের আলোচিত কবি রাজুব ভৌমিকও বাংলা সনেটে বেশকিছু বেশকিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘বাংলা-সাহিত্য ভাণ্ডারে নতুন কিছু জমা দিব বলে আমার এই ছোট্ট সৃষ্টি- আয়না সনেট। আয়না সনেট লেখার পূর্বে আমি বিশ্ব সাহিত্যের বিভিন্ন ধরনের সনেট নিয়ে প্রচুর গবেষণা করার চেষ্টা করেছি। আমার গবষেণার উদ্দশ্যে ছিল একটাই- বিশ্বের সব ধরনের সনেট সম্বন্ধে জানা এবং নতুন কিছু সৃষ্টি করা। ইতালীয় ভাষায় পের্ত্রাকের হাতেই সনেট কবিতা পূর্ণতা লাভ করার পর শেকসপিয়রীয় রীতির সনেট বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত- বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে প্রথম তার রচিত ‘কবি-মাতৃভাষা’ এর মাধ্যমে সনেট জমা দেন এবং বাংলা সাহিত্যে সনেটের প্রচলন তিনিই শুরু করনে। তারপর আবুল হোসেন, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ শামসুল হক, শামসুর রাহমান ও আল মাহমুদের সনেট আমাকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। আমি তাদের কবিতা পড়ে মোহাবিষ্ট হই। সুকান্ত ভট্টাচার্য, যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখায়ও আমাকে বেশ আকর্ষণ করে। আমার আয়না সনেটগুলো ঠিক আয়নার মতো- দুই দিক থেকেই পড়া যাবে। আমার আয়না সনেটগুলো সাধারণত পর্ব বিন্যাস-রীতি মেনে চলে না। নিচের লাইন দুটো একটু পড়ার চেষ্টা করুন। পেতে শুধু অবহেলা জন্মায় গরিব; ২+২+৪+৩+৩=১৪ ক্ষেতে করে শ্রম বন্ধ্য, ফসলে মুনিব। ২+২+২+২+৩+৩=১৪ শেষ দিক থেকে পড়লে হবে- গরিব জন্মায়, অবহলো শুধু পেতে; ৩+৩+৪+২+২= ১৪ মুনিব ফসলে, বন্ধ্য শ্রম করে ক্ষেতে। ৩+৩+২+২+২+২= ১৪ ঠিক আয়নার মতো। আয়না সনেট- যে সনেটগুলো দুই দিক থেকেই পড়া যাবে। এই কবিতাগুলোর অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে- প্রত্যেক কবিতার ভেতরে আরেকটি কবিতা আছে। এই কবিতাগুলো দুই দিক থেকেই চৌদ্দ অক্ষরের, চৌদ্দ লাইন বিশিষ্ট- ক ক খ খ, গ গ ঘ ঘ, ঙ ঙ চ চ এবং ছ ছ অন্তমিল নিয়ে সাজানো। আয়না সনেটগুলো কোনো মাত্রা (৮, ৬) নিয়ম মানে না। আয়না সনেটগুলো আবার নিচের লাইন থেকে উপরের লাইন পর্যন্ত পড়া যাবে। আয়না সনেট লেখার পদ্ধতি একটু ভিন্ন ধরনের। সম্ভবত আয়না সনেটগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন ধরনের সনেট। এই ধরনের সনেট পূর্বে কখনো লেখা হয়নি। [caption id="attachment_205234" align="aligncenter" width="700"] রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেট।[/caption] আয়না সনেটের সাথে পলিনড্রম কবিতার সামান্য মিল আছে। পূর্বে পলিনড্রম বা Palindrome পদ্ধতিতে সাধারণ কবিতা লেখা হয়েছে। কিন্তু কখনো সনেট লেখা হয়নি। Henry Peacham র্সবপ্রথম ১৬৩৮ সালে পলিনড্রম পদ্ধতিতে লেখা তার বই The Truth of Our Times প্রকাশ করছেনে। চীনের বিখ্যাত কবি Su Hui সবচেয়ে জটিল একটি পলিনড্রম কবিতা লিখেছেন- তিনি একটিই পলিনড্রম কবিতা লিখেছেন কিন্তু এ পর্যন্ত, মনে হয় আমি ছাড়া আর কেউ পলিনড্রম সনেট লেখেনি। আশা করি আপনাদের এই কবিতাগুলো ভালো লাগবে।’ পৃথিবীতে নতুনকে মেনে নেয়ার প্রবণতা আমাদের খুব কমই আছে। মানসুর হেল্লাজের সময়ের মানুষরা তাকে মেনে না নিয়ে শূলে চড়িয়েছিলেন। ইংরেজরা সাদা চামড়ার ‘কুইন’-কে মেনে নেয়নি। কেননা, কোনো এক বলিষ্ঠ সুন্দর যুবা নিগ্রোর পৌরুষে তার জন্ম হয়েছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ইরেজিতে কবিতা লিখত বলে তাকে অনেক নিন্দা সইতে হয়েছে। সোনালি কাবিনসহ কবি আল মাহমুদের সাহিত্যসম্ভারকে কোনো কোনো অতি পণ্ডিত বলে বেড়ায়, তার সাহিত্য থেকে ‘সেক্স’ ফেলে দিলে সেখানে আর কোনো কবিতাই থাকবে না। আরে কমবোধ আর অর্বাচিন তোর এতো ক্ষমতা থাকলে সোনালি কাবিনের সনেটের মতো একটা সনেট লিখে দেখা। তোর যদি ‘না’ বলার এতোই বাতিক তো পারলে নজরুলের মতো একটা ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে দেখা। পৃথিবীতে না বলার হিরিক এতো বেশি, যা লিখে শেষ করা যাবে না। জে কে ব্রাউনিংয়ের বিখ্যাত হ্যারিপটার সিরিজও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশের স্কুলগুলোতে নিষিদ্ধ হয়েছিল। কেন জানি না, আমার বোধে আসে না, ওই যুক্তরাষ্ট্রসহ তার কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি’। এই বই পড়ে শিশু-কিশোর, মানুষরা অবাধ্যতা আর দুষ্টুমি ছাড়া কিছুই শিখতে পারবে না- এই কথা বলে নিষিদ্ধ হয়েছিল বিখ্যাত কথাশিল্পী মার্ক টোয়েনের ‘অ্যাডভেঞ্চার অব টম সসার’। অনেকটা আমাদের দেশের সেই প্রবাদের মতো- ভাত দেয়ার মরদ নাই, কিল মারা গোসাই। আমরা হচ্ছি সেই লোক। যাক, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। রাজুব ভৌমিককে আমি শুধু সাদুবাদই না, যাক সে কথা, আমরা রীতিমতো স্যালুট জানাই তার আয়না সনেটের রাজুব ভৌমিককে তার এই ভিন্নতার জন্য। ভিন্নস্বরেভেজা কাব্যের জন্য। তবে রাজুব ভৌমিকের এই আয়না সনেটে যদি জোড়ে জোড়, বেজোড়ে গাঁথো বেজোড় নিয়মটুকু মানা হতো (আমার কোনো সনেটই মাত্রার নিয়ম মানে না। অর্থাৎ আমার সব সনেটগুলো মাত্রাহীন- রাজুব ভৌমিক) তাহলে আয়না সনেটগ্রন্থটি সোনায় সোহাগা হতো বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আবার এ কথা না বলেও পারছি না, সৈয়দ শামসুল হককে যখন তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা ‘ফির মিলেঙ্গ হাম দোনো’ (প্রথম মুক্তি-১৯৭৮) নিয়ে জানতে চাইলাম, তিনি আমাকে কিছুই বললেন না। বরঞ্চ দ্বিতীয়বার জানতে চাইলে, তিনি ধমকের সুরে বললেন, ‘তুমি এ বিষয়ে আমাকে আর প্রশ্ন করো না।’ আমরা আবার ফিরে যাচ্ছি কবি রাজুব ভৌমিকের কাছে। তার শেষ প্রেমপত্রের কাছে। প্রেম-ভালোবাসা পবিত্রতার বহিঃপ্রকাশ। প্রেম হলো একজনের কাছে আরেকজনের ভালোবাসার দৃঢ় অনুভূতির প্রকাশ। যদিও প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতিগুলো যৌন আকর্ষণের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। কিন্তু কবি রাজুব ভৌমিকের কাছে এই প্রেম হলো- আমৃত্যু ভালোবেসে তোমার স্বর্গের দুয়ার হবো। যেখানে কোনো কাম- ক্রোধ নেই। বরঞ্চ আমার কাছে শেষের দুটো লাইনকে কাপলেটই মনে হয়েছে। তিনি তার শেষ প্রেমপত্রে লিখেছেন- হয়তো তোমার আর হবে নাহি দেখা অনন্ত মোর প্রেম, তাই পত্রটি লেখা। রক্তাক্ত মোর বুক, খুনি তোমার চোখ অশান্ত জ্বলে হিয়া, তোমার প্রেমের রোখ। দোষ কী ছিল আমার করিলে তাবিজ তোষ বিনে ব্যথা নিয়ে দুঃখের প্রাণীজ চেয়েছি আমি তোরে, ভোর-সন্ধ্যা-বলিতে কাছি গলায় দিয়ে প্রেম তব সহিতে। করিলে অবজ্ঞা মোরে দেখিলে না দেখে জ্বলে কলিজা জ্বলে, পত্র তোমায় লেখে। মৃত্যু যদি হয় প্রেয়সী তোমার পূর্বে আমৃত্যু ভালোবেসে হবো দুয়ার স্বর্গে। -শেষ প্রেমপত্র কবি রাজুব ভৌমিকের ‘আয়না সনেটে’র আবাসিক সম্পাদক, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকা সংস্করণ ইব্রাহীম চৌধুরীর কিছু কথা এখানে আমরা তুলে ধরতে চাই। তিনি যথার্থই বলেছেন- ‘কবি রাজুব ভৌমিক শুরুতেই তার চতুর্দশপদী নিয়ে ব্যাখ্যার অবতারণা করেছেন। এ ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে কাব্য প্রয়াসের এক বিধিবদ্ধতাকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন। কবিতাকে তো অনেক সময়ই কোনো সংজ্ঞায় ধারণ করা যায় না, কারণ, ভাব আর হৃদয় কাতরতা সব সংজ্ঞাকে চুরমার করে বেরিয়ে আসে। মধু কবি সনেট লিখেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে। এর উত্তরাধিকার হিসেবে কবি রাজুব ভৌমিক ইস্ট রিভার বা হাডসন পারের কোলাহলময় নগরী থেকে তার হৃদয়কাতরতাকে উপস্থাপনা করেছেন আয়না সনেট, চতুর্দশপদী কবিতাবলীতে। কবিতার বিষয়বস্তুতে কবি উপস্থাপনার ভিন্ন কলাকৌশল আরোপ করার প্রয়াস পেয়েছেন। চেষ্টা করেছেন ভাবকে ব্যঙ্ময় করে তুলবার। প্রেম-প্রকৃতি থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ নানা বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে তার এ গ্রন্থের চতুর্দশপদীগুলো। এইসব নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাপিত জীবনের কাব্যময় উপস্থাপনা কতটা পাওয়া যাবে রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেট, চতুর্দশপদী কবিতাবলী কবিতাগ্রন্থে সে বিচার তার পাঠকরাই করবেন। কারণ কবিতার রস বিতরণের জন্য যেমন কবিকে প্রস্তুতি নিতে হয়, রস আস্বাদনের জন্য কাব্যরসিকের প্রস্তুতিও অনিবার্য হয়ে ওঠে। এমন প্রস্তুত কাব্যবোদ্ধাদের কাছে রাজুব ভৌমিকের চতুর্দশপদী কবিতাবলী প্রশ্রয় পাবে বা আদৃত হবে কিনা তাকে কালের হাতেই ছেড়ে দিতে হবে আমাদের। রসিক পাঠকের ভরসায় থেকে আমরা কেবল তার জন্য শুভকামনা জানাতে পারি, সেই শুভেচ্ছাই রইল আমাদের পক্ষ থেকে। কবি ও লেখক, অধ্যাপক ড. রাজুব ভৌমিকের জন্ম নোয়াখালী জেলার শ্রীনদ্দি গ্রামে, জন্মসাল ১৯৮৮। ওটার হাট সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবনের যাত্রা শুরু। যুক্তরাষ্ট্রে একটি স্নাতক ডিগ্রি, চারটি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং দুটি ডক্টরেট ডিগ্রি (একটি পিএইচডি আর একটি ডক্টরেট অব সাইকোলোজি) সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি আরো দুইটি ডক্টরেট ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত। গত পাঁচ বছর ধরে জন জে কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্কে তিনি অপরাধবিদ্যা, আইন ও বিচার বিভাগে অধ্যাপনা করছেন এবং হসটস কলেজ, সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্কে তিনি মনস্তাত্ত্বিক বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। অধিকন্তু, গত সাত বছর ধরে পেশায় একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে নিউইয়র্ক সিটি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি), কাউন্টার টেরোরিজম অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে সাংবাদিকতার পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাতে সাংবাদিকতা করেন। রাজুব ভৌমিকের আয়না সনেটের আরো কিছু অসাধারণ পঙ্ক্তিমালা; যা অনেকটা কাপলেটে পরিনথ হয়েছে- ১. নিপীড়িত নিয়ে সুর বলিষ্ঠ তোমার জাগ্রত করিলে কত ঘুমন্ত প্রহরী। ২. মোরা প্রতিবন্ধী ভবে, থেকে সবকিছু ওরা শুদ্ধ বলে, শান্তি চলে পিছু পিছু। ৩ .করিলে কেনো তাবিজ, প্রাণ মোর যায় সহিলে শুধু মানুষ, ভারোবাসা পায়। ৪. টাকার পিছু পিছু দৌড়াই সর্বক্ষণ। ৫. লেখার ইচ্ছে তোমায় ছিল একরাশ সবার না হয় প্রেম, হয় অভিলাষ। ৬. কেবল দিও সখি মালাখানি প্রেমের উজ্জ্বল করো হে, আয়ুষ্কাল বিরহের। ৭. সখি কহে মোরে, প্রেম কেনো দুঃসময় রাখি বুকে সর্ব, শুধু হারানোর ভয়। ৮. মন লহো কৃষ্ণ নাম, করো গুন-গান। ভু মানুষ, হৃদয়ে বাংলাদেশ, সখি কহে, অনন্য নজরুল, প্রেম কেনো দুঃখময়, রাখি বুকে সর্ব, সখি কহে মোরে, প্রেমাশে, এরাই ধর্ষক, সাঁইয়ের ঘরে, সখিতে কালা, আমার হৃদয় গলে, বঙ্গবন্ধু, লজ্জাহীন পুলিশ, জননী, দূরে যদি থাকিবে ও এখন সময়- কবিতাগুলো কবিতাপ্রেমী মানুষদের মনে দাগ না কেটে পারবে না বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। রাজুব ভৌমিকের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৫টির ও বেশি। সিটি ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্কে তার প্রকাশিত তিনটি বই পাঠ্যপুস্তক নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। আয়না সনেট তার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ সনেটগ্রন্থ। রাজুব ভৌমিকের এ গ্রন্থটির বহুল প্রচার, প্রসার ও সমৃদ্ধি কামনা করাই যায়। বইটি যে কারো সংগ্রহকে সমৃদ্ধ করবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App