×

মুক্তচিন্তা

দুইটি বিশ্বযুদ্ধের উৎসস্থল বার্লিন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:৫০ পিএম

জার্মানি আগে কখনো যাইনি। দুই দুইটি মহাযুদ্ধের উৎসস্থল জার্মান যাওয়ার সুপ্ত একটি বাসনা হয়তো মনে ছিল, তাই সেবার সিদ্ধান্ত নিলাম, যাব। সেটা ২০১০, এক দশক আগের কথা। এখন ফেব্রুয়ারি ২০২০। পহেলা সেপ্টেম্বর বার্লিনের টেগেল এয়ারপোর্টে আমরা যখন পৌঁছলাম, সকাল তখন ১১টা পেরিয়ে গেছে। কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না। লন্ডন থেকে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের দেড় ঘণ্টার কম সময়ের ফ্লাইটে আতিথেয়তার কোনো কমতি ছিল না। প্লেনে আমাদের চেহারার অন্য কোনো যাত্রী দেখিনি। যথানিয়মে ইমিগ্রেশনে গেলে দু’একটি সাদামাটা প্রশ্ন করে পাসপোর্টে সিল মেরে ছেড়ে দেয়। লাগেজ নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে কোনো কাস্টমস চোখে পড়ল না। সাকুল্যে ১৫-২০ মিনিটে সব সেরে বাইরে বেরিয়ে এলাম। এমনকি লন্ডনেও ইমিগ্রেশন এটা-ওটা প্রশ্ন করেছে। বলেছি, ঘুরতে এসেছি, আগেও ক’বার এসেছি। তারপরও কোথায় থাকব, ক’দিন থাকব ইত্যাকার প্রশ্ন করতে থাকলে পাশ থেকে আমার ১৪ বছরের পুত্র ‘অর্জুন’ বলে, ‘হোয়াই সি ইজ আস্কিং সো মেনি কোশ্চেন’? আমি উত্তর দেয়ার আগেই মহিলা উত্তর দেয়, ‘ইট ইজ মাই জব’, সঙ্গে আরো যোগ দেয়, ‘বিলিভ মি, ইন আমেরিকা দে আস্ক আস মোর কোশ্চেন’। এরপর আর দেরি হয়নি। আবার বার্লিন থেকে প্যারিসে নামলে দেখলাম, কোনো ইমিগ্রেশন, কাস্টমস কিচ্ছু নেই! বন্ধুরা জানালো, ওটা বার্লিন এয়ারপোর্টে হয়ে গেছে। জানলাম, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে এরকমই। এর আগেও (২০০৩) জেনেভায় দেখেছি দূর থেকে পাসপোর্ট দেখালেই হতো। আমি ট্রেনে জেনেভা থেকে প্যারিস যাচ্ছিলাম। কোনো চেকিং, কাস্টমস নেই? প্যারিসে নেমেও একই অবস্থা। বন্ধুরা আমায় ট্রেনের কামরা থেকে রিসিভ করে। ভাবলাম, ৯/১১ না হলে দুনিয়াটা আরো সহজ হতো। মনে পড়ে ২০০৫-এ প্যারিস থেকে নিউইয়র্ক আসার পথে প্লেনের দরজায় পা দেয়ার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে আমায় থামানো হয়, আমার জামাকাপড় খোলা ছাড়া প্রায় সবকিছু তল্লাশি চালায়। অসংখ্য প্রশ্নবাণে অতিষ্ঠ হয়ে তখন ওদের বলেছিলাম, ‘আই এম নট এ মুসলিম’। এরপর কেন জানি, সব থামে। রাগে-লজ্জায় তখন ইসলামি মৌলবাদীদের গালি দিতে দিতে প্লেনে উঠি, এই ব্যাটাদের জন্য আমাদের এই বেইজ্জতি। এবার স্ত্রীকন্যা সঙ্গে থাকায় তেমন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। তবু আমার পুত্রকন্যা এতটুকুও সইতে রাজি নয়? মনে মনে ভাবলাম, বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস এরা দেখেনি। আমার বড়পুত্র ‘পাপাই’ একবার দেশে গিয়ে এয়ারপোর্টে মাল নিয়ে টানাটানি ও ফকিরের রাজত্ব দেখে কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়! সেটা অনেকদিন আগের কথা। যাহোক, টেগেল এয়ারপোর্টটি সুন্দর, ছিমছাম, গোছানো। টেলিফোন করতে চাইলাম, দেখলাম লন্ডনের ‘সিমকার্ড’ অচল। বুথ থেকে হোটেলে টেলিফোন করতে চাইলাম। বেশ ক’বার চেষ্টা করলাম। বেশ কয়েক ইউরো খরচ হলো। কাজ হলো না। ছেলেও তেমন সুবিধা করতে পারল না। কারণ ‘নো ইংলিশ’। পুরো এয়ারপোর্টে ইংরেজি বলার লোক পেলাম না? দু’একজন দাবি করলেন, তারা কিঞ্চিৎ ইংরেজি জানেন, কিন্তু তাদের ইংরেজি বোঝার ক্ষমতা আমাদের ছিল না। এয়ারপোর্টে ফ্রি কম্পিউটারাইজড টেলিফোন ছিল, কিন্তু সময় মাত্র এক মিনিট। বার কয়েক এক মিনিট এক মিনিট করে কথা বলে যা বুঝলাম, এয়ারপোর্টের বাইরে বাসস্টপে হোটেলের শ্যাটল অপেক্ষা করছে। প্রায় একই সময়ে কোনো এক এয়ারলাইনসের এক মহিলা ‘এয়ারহোস্টেস, পেলাম, তিনি মোটামুটি ইংরেজি জানেন, আমাদের দেখিয়ে দিলেন, কোথা দিয়ে যেতে হবে। মহিলাকে ধন্যবাদ দিয়ে, বাইরে এসে দেখি ‘শ্যাটল’ দাঁড়িয়ে। দশ-বারো মিনিটে হোটেল পৌঁছলাম। লোকজন ইংরেজি জানে, ও বলছে। রুমে ঢুকে হাতমুখ ধুয়ে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে বের হয়ে যাই বার্লিন দেখতে। হোটেল থেকে গ্রুপ টিকেট কিনে এবং ম্যাপ নিয়ে পৌঁছে যাই, ‘জ্যুলজিকেল গার্টেন’-এ, অর্থাৎ আমাদের গুলিস্তানে! সুশৃঙ্খল, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বার্লিন শহর বেশ সুন্দর। মাত্র কয়েক বছর? ১৯৪৫-এর ধ্বংসস্তূপ থেকে ওরা আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, ওরা উন্নত। সর্বত্র পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। বোঝাই যায় না যে, এই বার্লিন শহর মাত্র ক’দিন আগেও দুইভাগে বিভক্ত ছিল। পূর্ব ও পশ্চিম বার্লিন। বাসে যেতে যেতে এক বুড়ি জানালো, এটা আগে পূর্ব-জার্মান ছিল, ওটা পশ্চিম জার্মান ইত্যাদি। ভাবছিলাম, এটা কি করে সম্ভব হয়েছিল? একটি শহরকে মধ্যখান দিয়ে দেয়াল দিয়ে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। অবস্থা এ রকম যে, ঢাকা শহরকে ফার্মগেট বরাবর পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত করলে যা হবে, তাই! এখন আর দেয়াল নেই, বোঝাও যায় না, কোথায় দেয়াল ছিল। তবে স্মৃতি হিসেবে দেয়ালের কিছুটা অংশ এখনো রেখে দেয়া হয়েছে। ওই দেয়ালের লেখা পড়লে বোঝা যায়, জার্মানরা কতটা দেয়ালের বিরুদ্ধে ছিল। তাই দেয়াল ভাঙতে ওদের বেশি সময় লাগেনি। শুধু যে ইটের দেয়াল ভেঙেছে তা নয়, জার্মানদের মনে দেয়ালও ভেঙেছে। দুই জার্মান এখন এক। চীনের দেয়াল দেখিনি। তাই জার্মানির ভাঙা দেয়াল দেখতে আমরা অর্ধেক দিন ব্যয় করি। দেয়ালের পাশে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছে, কোনো জাতিকে কি দেয়াল দিয়ে বেঁধে রাখা যায়? প্রথমদিন হোটেলে গিয়ে হামিদুলকে কল দেই? চমৎকার মানুষ। তাকে আমি চিনতাম না, পার্থদা, মানে পার্থ প্রতিম মজুমদার তার ফোন নম্বর দিয়ে বলেছিলেন, কল করবেন, দেখবেন অন্য মানুষ। তাই দেখলাম। কথা বলে ভালো লাগল। জার্মান বউ, কিন্তু বঙ্গচর্চা থেমে নেই। বন্ধু-বান্ধব ছাড়া জার্মানিতে আরো একজনকে কল দিয়েছিলাম, তিনি হলেন ‘দাউদ হায়দার’। বঙ্গবন্ধুর আমলে কৃষ্ণ ও মুহম্মদকে একই সঙ্গে গালি দিয়ে কবিতা লিখে দাউদ হায়দার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। তারপর তসলিমা নাসরিন। আমার মতে, দাউদ হায়দার এবং তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে বহিষ্কার বাংলাদেশে ইসলামি মৌলবাদ চাঙ্গা করতে সহায়ক হয়েছে। তাই দাউদ হায়দারের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিল। হয়নি। কারণ দাউদ হায়দার হয়তো চাননি দেখা করতে। অথবা আমার মনে হয়েছে, দাউদ হায়দারের মধ্যে ‘অহমিকা’ আছে! তখন ভেবেছিলাম, দাউদ হায়দার কি আল-মাহমুদ হয়ে যাচ্ছেন? আমার এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘আচ্ছা বোরখা পরা গৃহবধূ তসলিমা’ কি চিন্তা করা যায়? তিনি নিজেই উত্তর দেন, ‘সবই সম্ভব’। ক’বছর পর মুক্তধারার বইমেলায় দাউদ হায়দার নিউইয়র্কে এসেছিলেন, দেখা হয়েছে, ‘হাই-হ্যালো হয়েছে, জার্মানিতে কথা বলার যে উৎসাহ ছিল, তা হারিয়ে গেছে, সুতরাং কথা হয়নি। তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে ২০১৯-এ দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। ২০২০-এ দাঁড়িয়ে বলা যায়, দাউদ হায়দার এখনো আল-মাহমুদ হননি। তসলিমা নাসরিন আগের মতোই স্বাধীন আছেন। সেবার জার্মানিতে দাউদ হায়দারের সঙ্গে আমার ১৫/২০ মিনিট কথা হয়েছে। টেলিফোনে। বেশির ভাগ সময় কথা আমি বলেছি এবং তার সঙ্গে দেখা করার একটা সময়-নির্ঘণ্ট ঠিক করি। পরদিন যথাস্থানে পৌঁছে কল দেই, তবে অচেনা জায়গায় যথা সময়ে পৌঁছতে পারিনি, ঘণ্টাখানেকের একটু কম সময় দেরি হয়ে যায়! তিনি কল ধরেন। বললাম, আমি পৌঁছেছি, আপনি কোথায়? তিনি বললেন, ‘সরি, আপনি লেট করেছেন, আমি অন্য এপয়েন্টমেন্ট চলে এসেছি। কি আর করা, দেখা হলো না। এই দেখা না হওয়ার জন্যে নিঃসন্দেহে আমি দায়ী, তবু কেন জানি মনে হয়েছে, তার অনীহা ছিল! আমি পর্যটক নই, ভ্রমণ বৃত্তান্ত লেখাও আমার উদ্দেশ্য নয়। এটিকে পথ চলতে চলতে কিছু ঘটনা, কিছু স্মৃতিচারণ বলা যেতে পারে। আমার ছেলেমেয়েদের অভ্যাস হচ্ছে, যে দেশে যাবে সেই দেশের খাবার খাবে। আমার তো পকেটের দিকে নজর রেখে কাজ করতে হয়! ভরসা যে পকেটে প্লাস্টিক থাকে, ক্যাশের কোনো বালাই নেই! শহরের ব্যস্ত এলাকায় একটি ভালো রেস্তোরাঁয় খেলাম। প্যারিসে বাঙালি ভরা। তাছাড়া পার্থদা ছিলেন। কোনো ঝামেলা হয়নি। বরং পার্থদা’র সান্নিধ্যে সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল। হাসতে হাসতে পার্থদা সবার পেটে খিল ধরিয়ে দিয়েছিল। পার্থদা আমাদের পারিবারিক বন্ধু, তিনি টেলিফোন করা মানে ‘হাসতে আপনাকে হবেই’। সেই গল্প না হয় পরে? আমাদের দেশে মানুষ লন্ডন-প্যারিস যেতে ভালোবাসে। এতদিন আমি বিনে পয়সায় পরামর্শ দিতাম, ‘বার্লিন যান’। ২০১৯-এ দুই সপ্তাহ ইতালি ছিলাম, এখন বলি, ভেনিস যান, বা সুযোগ থাকলে ডিজনি ওয়ার্ল্ড যান। আসলে শহর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ুন, যেখানে যান, সেখানেই ভালো লাগবে। শিতাংশু গুহ : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App