×

মুক্তচিন্তা

বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ ও আমাদের করণীয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৭:৪২ পিএম

শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়কসহ সর্ব প্রকার পাঠ্যপুস্তক ক্রমান্বয়ে বাংলায় লেখা ও অনুবাদের ব্যাপারে বাংলা একাডেমিকে তৎপর হতে হবে এবং বাংলা ভাষায় প্রণীত বই অনুসরণ শিক্ষাঙ্গনে বাধ্যতামূলক করতে হবে। রেডিও-টিভিতে বাংলা-ইংরেজি মিশেলে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ করতে হবে।

ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বিভিন্নভাবে একেকটি ভাষা অন্য একটি ভাষার ভেতর প্রবেশ করে থাকে। আধিপত্য, বাণিজ্য ইত্যাদি কারণে একেকটি ভাষা অন্য একটি ভাষার শব্দে নিজের স্থান করে নেয়। বাংলা ভাষার ভেতর আরবি, উর্দু, ফার্সি, ইংরেজিসহ বহু ভাষার হানা আছে। পাকিস্তান আমলে পাকিস্তানিরা উর্দু ভাষাকে বাংলার ওপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, যা টেনে এনেছে বায়ান্ন ও একাত্তর। তবে আমাদের ওপর সর্বশেষ যে দুটি সাম্রাবাদী ভাষা আগ্রাসন চালাচ্ছে তা হচ্ছে ইংরেজি আর হিন্দি। সারা পৃথিবীতে ইংরেজি এক ভয়াবহ দানবে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিতে দুর্বল আর অসাবধানী দেশের ভাষাকে ক্রমে গ্রাস করছে ইংরেজি দানবটি। এই বিশ্বায়নের যুগে মূল আধিপত্যই ভাষাভিত্তিক হওয়ায় আগ্রাসন প্রবণতা রোধে বাংলা ভাষার ভবিষ্যতের ব্যাপারে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ বিশেষ জরুরি। আমাদের তরুণ প্রজন্ম অত্যাধুনিক বিজ্ঞানসম্মত জীবনযাপন করে। এদের বিচরণ ইন্টারনেটে, এদের চোখে হলিউড, এদের কানে বিবিসি-সিএনএন। বাংলা-ইংরেজি-হিন্দির মিশেলে এক অদ্ভুত জগাখিচুড়ি বাংলা ভাষায় কথা বলে তারা। বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত পর্যায় অতিক্রমকারী মধ্যম আয়ের দেশ থেকে অগ্রসরমান একটা দেশের জন্য এটা এক ভয়াবহ রূপ। বাংলাদেশের কেজি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাই ইংরেজি। এসব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের পোশাক-আশাক পশ্চিমি, এরা খায় পশ্চিমি, এদের জীবনাচার পশ্চিমি। শোবার ঘরে তো আছেই এইচবিও, স্টার মুভি, সনি, বিবিসি, জিটিভি, সিএনএন। এরপর রাস্তাঘাটে গজিয়ে উঠেছে ইংরেজিতে দখল দেয়ার এজেন্সি। শিশুদের ইংলিশ মিডিয়ামে সিদ্ধ করার প্রয়াস চলছে নিরন্তর। অভিভাবকরা পারলে ইংরেজি রান্না করে খাওয়ায়। বাংলাদেশের সাহিত্যে ইংরেজি কেন্দ্রিক এক ধরনের হীনমন্যতা লক্ষ করা যায়। এখানে ইংরেজিতে বই পড়তে না পারলে যেন জাতে ওঠা যায় না। এটা একটা হীনমন্য ধারণা মাত্র। কথায় কথায় তারা বলে এ দেশের সাহিত্যে কিছু নেই। এরা নিজের অজান্তেই প্রায় সংক্রমিত। বাংলাদেশে সম্প্রতি প্রাইভেট রেডিওতে অদ্ভুত ধরনের একটা বাংলা-ইংরেজি মিশেল ভাষা বলার চেষ্টা হচ্ছে। কেন তারা এ ধরনের আজগুবি ভাষা প্রচারে মেতে উঠেছে তা ভেবে দেখা দরকার। এর পেছনে কারা আছে খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। টিভি চ্যানেলগুলোতে বিকৃত বাংলার সমারোহ। এসবের বিরুদ্ধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। পৃথিবীতে ফ্রান্স, জার্মানি, চীন, জাপানসহ অনেক প্রতিপত্তিশালী দেশ তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। ফরাসিরা তো নিজেদের ভাষাটাকে জোঁকের মতো আঁকড়ে আছে। ভীনদেশির সঙ্গে কথা বলতেও তারা নিজেদের ভাষা ছাড়া ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা ব্যবহার করে না। ফ্রেঞ্চ লেখাটি অনুবাদ করার জন্য ইংল্যান্ডের আলাদা ডিপার্টমেন্ট আছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য একাডেমিতে মূল ফ্রেঞ্চ, হিস্পানি, স্প্যানিশ, রুশ থেকে অহরহ বই বাংলায় অনুবাদ হচ্ছে। অথচ বাংলা আমাদের পুরো দেশের ভাষা হওয়া সত্তে¡ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আক্রান্ত ঢাকার বাংলা একাডেমি সরকারি আমলা, রাজনীতিবিদ আর বাংলা একাডেমির কর্মকর্তাদের হাবিজাবি ছাপাতে ব্যস্ত। পরিশেষে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘকালের সক্রিয় অংশগ্রহণকারী, রাষ্ট্রীয় সম্মাননা একুশে পদক এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পদকপ্রাপ্ত ভাষাসংগ্রামী হিসেবে বলতে চাই বাংলা ভাষাকে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হবে। অন্যান্য বড় দুর্ধর্ষ ভাষার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সব কৌশল অবলম্বন করতে হবে। ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজির সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। তবে নিজের মাতৃভাষা বাংলাকে কাক্সিক্ষত গুরুত্ব দিয়ে, প্রাধান্য দিয়ে, সুরক্ষা করে আন্তর্জাতিকভাবে প্রয়োজনে ইংরেজি গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বিদেশিদের সঙ্গে যোগাযোগ, বৈদেশিক বাণিজ্য ছাড়া অভ্যন্তরীণভাবে নয়। ইংরেজির মতো দুর্ধর্ষ সা¤্রাজ্যবাদী ভাষার নীরব আগ্রাসন থেকে আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে বাঁচাতে সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে। বাংলা ভাষার ব্যবহার ও প্রসার কল্পে আমার কিছু পরামর্শ নিম্নে প্রদত্ত নতুন প্রজন্মের কাছে মায়ের ভাষা তথা মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার ইতিহাস আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে হবে, যাতে তারা মাতৃভাষা বাংলার চর্চা, পরিচর্যা ও ব্যবহারে আগ্রহী হয়। বাংলা ভাষা ব্যবহারে নতুন প্রজন্মের মনোবৃত্তির উন্মেষ সাধনকল্পে সময়ে সময়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের আয়োজন ও আলোচনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এভাবে নতুন প্রজন্ম ছাড়াও সার্বিকভাবে গণসচেতনতা সৃষ্টি করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাঙ্গন তথা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষক-শিক্ষিকারা বাংলা ভাষার ব্যবহার ও মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ ভ‚মিকা রাখতে পারেন। সরকারি, আধা-সরকারি ও বেসরকারি সর্ব পর্যায়ে চাকরিতে নিয়োগকালে চাকরি প্রার্থীদের শর্ত হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রমাণ যাচাই করে নিতে হবে এবং চাকরিকালীন পদোন্নতির ক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারের ব্যাপারে তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে এ শর্ত আরোপ করে একটা মার্কিং সিস্টেম কার্যকরীভাবে চালু করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা চর্চাকারী ও ব্যবহারকারীদের অগ্রাধিকার দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। শিক্ষা পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিষয়কসহ সর্ব প্রকার পাঠ্যপুস্তক ক্রমান্বয়ে বাংলায় লেখা ও অনুবাদের ব্যাপারে বাংলা একাডেমিকে তৎপর হতে হবে এবং বাংলা ভাষায় প্রণীত বই অনুসরণ শিক্ষাঙ্গনে বাধ্যতামূলক করতে হবে। রেডিও-টিভিতে বাংলা-ইংরেজি মিশেলে বাংলা ভাষার বিকৃতি রোধ করতে হবে। মাতৃভাষা বাংলার চর্চা ও ব্যবহারে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূরীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। আমার উপরোক্ত প্রস্তাবাদির সঙ্গে প্রকৃত মাতৃভাষাপ্রেমী বিশেষজ্ঞদের গবেষণাপ্রসূত পরামর্শ সংযোজন করে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে এই বিশ্বায়নের যুগে ইংরেজির আগ্রাসন এবং অন্য ভাষার জগাখিচুড়ি সংক্রমণ থেকে প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে রক্ষা করে স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য অক্ষুণœ রাখা সম্ভব হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমাদের স্লোগান হবে ‘বিশ্বকে নেব বাংলার পাশে, বাংলাকে নেব বিশ্বের পাশে’।

শামসুল হুদা : ভাষাসৈনিক ও লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App