×

মুক্তচিন্তা

বাংলা ভাষা ও জাতীয়তাবোধ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:৩৩ পিএম

বাংলা ভাষা ও জাতীয়তাবোধ

বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ভাষা আন্দোলন মূলত একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল। নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতির সম্মান রক্ষার্থেই এই আন্দোলন সংঘটিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। সারাদেশে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেদিন সকাল থেকেই দলে দলে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে জড়ো হতে থাকেন। উদ্দেশ্য বাংলা ভাষার দাবিতে সোচ্চার হওয়া ও মাতৃভাষার পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করা। চারদিকে আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ১৪৪ ধারা ভেঙে সভা থেকে মিছিলটি বের হলো। পথিমধ্যে পুলিশের বাধার মুখে পড়লে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়। গুলি চালায় পুলিশ মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েন আব্দুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন। রক্তে রঞ্জিত হয়ে ওঠে বাংলার পথঘাট, আঘাত করে অস্তিত্বে। এই রক্ত যেন বাংলার সব মানুষকে এক সুতায় গেঁথে ফেলে। সব ভেদাভেদ ভুলে সবাই মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু করেন। যার ফলে ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের শোচনীয় পরাজয় হয়। পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। যা ছিল পাকিস্তান সরকারের এক চরমতম পরাজয়। আর বিশ্বে বাংলাভাষা ও বাঙালি মাথা উঁচু করে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকে। জানান দিয়ে দেয়, বাঙালি কীভাবে তার অধিকার আদায় করতে হয়। কখনো কারো কাছে মাথা নোয়াবার নয়। যত বাধা-বিপত্তি আসুক না কেন, বাঙালি জাতি সবসময় একতাবদ্ধভাবে সব শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে বীরদর্পে লড়বে। বাঙালির মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে যে অগ্নিশিখা জ্বালিয়ে ছিল তা জনসাধারণের মনে বিস্ফোরিত হয়েছিল। জাতীয়তাবাদের যে চেতনা মানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে দখল করেছিল তা পরবর্তী প্রতিটা আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি জাতিকে একত্রিত করেছে। সব অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, রক্ত দিতে বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ করে না। যার দরুন কোনো শক্তি বাঙালি জাতিকে বশ করতে পারেনি। বাঙালি জনগোষ্ঠীকে যখন পাকিস্তান সরকার কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তখন পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শোষণের মাত্রা যেন দিন দিন বাড়তেই থাকে। সব অত্যাচার ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য বাঙালির জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয় দফা পেশ করেন, যাকে বলা হয় বাঙালির মুক্তির সনদ। যেখানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বাংলার মানুষের মনে আশার সঞ্চার হতে থাকে, স্বপ্ন দেখতে হয় তাকে নতুন ভোরের। পাকিস্তান সরকার এতে ভীত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করে। ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়। মামলা যেন বাঙালির জমে থাকা আগুনে বাতাস দিতে থাকে। চারদিকে তীব্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান। সবই যেন একই সূত্রে গাঁথা। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই বাঙালি হৃদয়ে পাকিস্তানের শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম বিদ্রোহ মনোভাব প্রকাশ পায়। বলা যায়, বাঙালির সব প্রকার অধিকার আদায়ের সূচনা ছিল ভাষা আন্দোলন। প্রথমত ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলার মানুষ দাবি আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত এই আন্দোলনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম দাবি পূরণের স্বাদ গ্রহণ করে। যা প্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে পরবর্তী দাবি আদায়ে এবং উপলব্ধি করায় যে আন্দোলন ছাড়া কখনো অধিকার আদায় সম্ভব নয়। এই আন্দোলন মানুষের মনে মনোবল ও সুদৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঞ্চার করে, যা বাঙালিদের মনে জাতীয়তাবাদ চেতনার উন্মেষ ঘটায়। পরবর্তী সময় বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভাষা আন্দোলনের মনোবল ও শক্তির রসদ জুগিয়েছে। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের মানচিত্রে এক অনন্য আসন গড়ে তুলেছে। বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের নাম উচ্চস্বরে ব্যবহার হচ্ছে। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এই একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। জাতীয়তাবাদের চেতনায় জাগ্রত হতে হবে। বাঙালি অতীতে কখনো হারেনি, ভবিষ্যতেও হারবে না। দল-মত নির্বিশেষে সবার সহযোগিতায় প্রিয় বাংলাদেশ বিশ্ব আসনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।

 শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App