×

মুক্তচিন্তা

উপশাখা : ব্যাংকিং সেবার নতুন দিগন্ত

Icon

nakib

প্রকাশ: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:২১ পিএম

আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য ব্যাংকিং সেবায় নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে। এক সময় ব্যাংকের ব্যবসা হিসেবে ব্যাংক শাখা, কৃষি শাখা, বুথ (কালেকশন বুথ ও ইলেক্ট্রনিক বুথ) ও ব্যবসা উন্নয়ন কেন্দ্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। অল্প ব্যয়ে ব্যাংকিং সেবা কীভাবে মানুষের নাগালে পৌঁছানো যায় সে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তৎপর, তারই আলোকে গত ডিসেম্বর ২০১৮ নতুন পদ্ধতি বুথভিত্তিক ব্যাংকিংয়ের নীতিমালা জারি করা হয়। মোবাইল ব্যাংকিং, এজেন্ট ব্যাংকিং প্রভৃতির পর এসেছে এই নতুন সেবা। আর্থিক সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে চালু হওয়া ‘ব্যাংকিং বুথ’ নামের ব্যবসাকেন্দ্র বর্তমানে ‘উপশাখা’ হিসেবে বিবেচিত হয়। উল্লেখ্য, গত ডিসেম্বর ২০১৯ বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলার জারির মাধ্যমে ব্যাংকিং বুথকে উপশাখায় রূপান্তর করা হয়। উপশাখা বলতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে নির্দেশিত নীতি পদ্ধতির আলোকে সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য ব্যাংকের কোনো পূর্ণাঙ্গ শাখার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত স্বল্পব্যয়ী ব্যবসাকেন্দ্রকে বুঝায়। প্রতিটি উপশাখা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নিকটবর্তী কোনো শাখার নিয়ন্ত্রণাধীনে পরিচালিত হয়। নিয়ন্ত্রণকারী শাখা থেকে উপশাখার ন্যূনতম দূরত্ব হতে হয় কম-বেশি এক কিলোমিটার। জেলা শহরের বাইরে উপশাখা স্থাপনের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণকারী শাখা থেকে নিয়মিত যোগাযোগ, নগদ অর্থের সহজ ও নিরাপদ পরিবহন এবং সার্বিক নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে শাখা থেকে এর দূরত্ব নির্ধারণ করা হয়। উপশাখা থেকে ব্যাংকের বিদ্যমান এজেন্ট আউটলেটের দূরত্ব মেট্রোপলিটান এলাকার ভেতরে ও বাইরে যথাক্রমে ৩ ও ৫ কিলোমিটার বজায় রাখতে হয়। উপশাখার ফ্লোর স্পেস হবে অনধিক ১০০০ বর্গফুট এবং ব্যাংকিং কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ন্যূনতম ২ জন কর্মকর্তা নিযুক্ত হবে। ব্যাংকের ভল্টের নিরাপত্তার মতো উপশাখার নগদ টাকা জমা ও ক্যাশে থাকা টাকার পূর্ণ বিমা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া প্রয়োজনে উপশাখায় ভল্ট স্থাপন করা যাবে। এসব ব্যবসায় কেন্দ্র চালু করতে হলে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। উপশাখায় নিরবচ্ছিন্ন ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাসহ তথ্যপ্রযুক্তি কাঠামো থাকতে হবে। উপশাখা থেকে ব্যাংকিংয়ের প্রায় সব সুবিধাই মিলছে। উপশাখাকে স্বল্পব্যয়ী ব্যাংকিং সেবা আউটলেট হিসেবে গণ্য হয়। সে বিবেচনায়, প্রচলিত শাখা স্থাপনের জন্য নির্ধারিত বিভিন্ন ব্যয়সীমার চেয়ে উপশাখা স্থাপনের ব্যয় এবং প্রচলিত শাখা কর্তৃক প্রদত্ত ব্যাংকিং সেবার জন্য নির্ধারিত ফি, চার্জ, কমিশনের চেয়ে ব্যাংকিং বুথে সেবা প্রদানের ফি, চার্জ, কমিশন ইত্যাদি কম বৈ বেশি হবে না। উপশাখার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে ব্যাংক ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে আর্থিক সেবা সুবিধাবঞ্চিত জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং স্বল্পব্যয়ী ব্যাংকিং সেবা আউটলেটের মাধ্যমে অধিকতর আর্থিক সেবা ভুক্তি নিশ্চিত করা। তাছাড়া ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় ব্যাপক আর্থিক সেবা ভুক্তির লক্ষ্যে স্বল্পব্যয়ী, কার্যকর ও টেকসই সেবা বিতরণ মাধ্যম প্রতিষ্ঠা করা, ব্যাংকের গ্রাহকভিত্তি দেশব্যাপী সম্প্রসারণ করা, ব্যাংকিং আওতাবহির্ভূত এলাকার জনগণের নিরাপদ সঞ্চয়ের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়কে জাতীয় সঞ্চয়ের মূলধারায় আনয়ন করা, বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অর্থ সহজে ও দ্রুততম সময়ে সুবিধাভোগীর কাছে পৌঁছানো, দেশব্যাপী জনগণের অর্থের প্রবাহকে (লেনদেনকে) সহজতর ও ঝুঁকিমুক্ত করা, পশ্চাৎপদ এলাকার অর্থায়নের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আধুনিক ডিজিটাল/ইলেক্ট্রনিক ব্যাংকিং সেবাকে তৃণমূল পর্যায়ে জনপ্রিয় করে তোলা। অর্থাৎ উপশাখায় বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিদেশি মুদ্রার লেনদেন ব্যতীত নির্ধারিত সীমায় সব ধরনের ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালিত করা। উপশাখার মাধ্যমে গ্রাহকদের আরো উন্নত সেবা দেয়াই লক্ষ্য। একই সঙ্গে এসব সেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করাও একটি লক্ষ্য। বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব উদ্যোগে সাধারণ মানুষ উপকৃত হওয়ার পাশাপাশি লাভজনক হবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানও। এর ফলে ব্যাংকগুলোর লোকসানি শাখা কমে যাবে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাও বাড়বে। এর আগে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হিসেবে ২০১৪ সালে ‘এজেন্ট ব্যাংকিং’ সেবা চালু করা হয়। ২০১১ সালে যাত্রা হয় ‘মোবাইল ব্যাংকিং’-এর। এর মধ্যে দেশে এ দুটিই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উপশাখার ক্ষেত্রে সব লেনদেন স্বাভাবিক ব্যাংকিং সময়ের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়ে থাকে। গ্রাহকদের তাৎক্ষণিকভাবে এসএমএস ও প্রিন্ট রসিদ দেয়া হয়। তবে উপশাখা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের চেয়েও সহজ। কারণ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে কমিশন দেয়ার একটা ব্যাপার থাকে। কিন্তু উপশাখায় সেটা নেই। সবার মধ্যে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ইতোমধ্যেই ২১টি ব্যাংক উপশাখা চালু করেছে। এ সেবা ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তৈরি হচ্ছে নতুন গ্রাহক, বাড়ছে আমানত। এই উপশাখা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অগ্রগতিকে আরো একধাপ এগিয়ে নেবে বলে মনে করছেন ব্যাংকার ও বিশ্লেষকরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবমতে, সারা দেশে ইতোমধ্যে ২১ ব্যাংকের ৩৫৫টি উপশাখা চালু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি উপশাখা খুলেছে নতুন প্রজন্মের এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক। ব্যাংকটি সারা দেশে ১০৫টি ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ে উপশাখা স্থাপন করেছে। এর বাইরে আরো ২৫টি শাখা খুলেছে ব্যাংকটি। যাতে সাড়ে ৭ হাজার গ্রাহক তৈরি হয়েছে। জমা পড়েছে ১৮৩ কোটি টাকার আমানত। ঋণ বিতরণ হয়েছে ২১ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকিং সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে উদ্যোগ নিয়েছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হওয়ার দাবি রাখে। বাংলাদেশে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন, বেসরকারি এবং বিদেশি মিলিয়ে মোট ৬২টি ব্যাংক ব্যবসায়রত রয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত দেশের সব এলাকায় ব্যাংকিং সেবা সম্প্রসারিত করা সম্ভব হয়নি। নানা কারণেই ব্যাংকগুলো গ্রামীণ এলাকায় শাখা খুলতে খুব একটা আগ্রহী হয় না। ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হয়ে গেছে বলে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন। প্রতিবেশী দেশ বিশাল জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতেও বাংলাদেশের মতো এত বিপুলসংখ্যক ব্যাংক নেই। বিশ্বব্যাংকিং ইতিহাসে দুধরনের ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করা যায়। এর একটি হচ্ছে ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং। ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কমসংখ্যক ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয় তারা বিপুলসংখ্যক শাখা স্থাপনের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করে। যুক্তরাজ্যের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অন্যদিকে ইউনিট ব্যাংকিং হচ্ছে অল্প কয়েকটি শাখা নিয়ে এক একটি ব্যাংক স্থাপিত হয়। এভাবে জনগণের ব্যাংকিং চাহিদা পূরণের জন্য প্রচুরসংখ্যক ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ব্যবস্থা ইউনিট ব্যাংকিংয়ের চমৎকার উদাহরণ। ইউনিট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় বিদ্যমান ব্যাংকগুলো পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে আধুনিক ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে। বাংলাদেশে বোধগম্য কারণেই ইউনিট ব্যাংকিং সম্ভব নয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু আছে তা ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং বলা যেতে পারে। কিন্তু ব্যাংকগুলো গ্রামীণ জনপদে তাদের শাখা খোলার ব্যাপারে তেমন একটা আগ্রহী হয় না। এ কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষকে ব্যাংকিং কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা বাধ্য হয়ে আর্থিক কার্যক্রমের জন্য এনজিওদের কাছে ধরনা দেয়। এনজিওরা এ সুযোগে উচ্চসুদ চার্জ করে ব্যবসায়িক ফায়দা লুটে নিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে উপশাখা ব্যাংকিং ব্যবস্থা অনেকটাই সহায়ক হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এম এ মাসুম : ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App