×

মুক্তচিন্তা

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কি বিবেচনায় নেবেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১০ পিএম

রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, ‘আমরা এত বড় রাজনৈতিক সংগঠন, আমাদের এসব সামান্য বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়? দলের এ জাতীয় ভাবনার সুযোগে একজন অসংস্কৃত-অযোগ্য ব্যক্তি চেয়ার দখল করে বসেই তার অযোগ্যতা-অশিষ্টতা-মূর্খতা আর মোহান্ধতায় দলের সর্বনাশ করে ছাড়বে। আর ক্ষমতাসীন দলের সর্বনাশ মানে দেশের মানুষের সর্বনাশ।

সংস্কৃতির আলোবর্জিত মানুষ প্রায়ই মোহান্ধতায় এমন সব কর্মকাণ্ড করে বসে, যোগ্যতার বাইরে গিয়ে এতসব অধিকার দাবি করে বসে, যা কেবল তাকে নয়, বিপাকে ফেলে তার গোত্র-গোষ্ঠী-সমাজ-দলকেও। জীবনের প্রয়োজনে আমাদের জানার বিষয় অগণন। কাঠ সম্পর্কে একজন সূত্রধর যা জানেন, একজন চিকিৎসকের তা জানার সুযোগ কম, জলের তলায় মাছেদের ক্রীড়াশৈলী সম্পর্কে একজন জেলে-ধীবর যতটা খোঁজ রাখেন, তা জানার সুযোগ একজন প্রকৌশলীর কোথায়? এবং এ সত্যটা একজন সংস্কৃতিমান ব্যক্তি যত সহজে মান্যতায় আনেন, একজন অসংস্কৃত ব্যক্তির পক্ষে তা মান্যতায় নেয়া ততটা সহজ নয়; কেন না, সে যে জানে না, সেটাই তো তার জানা নেই। আপাতদৃষ্টিতে আমার এ কথাগুলোকে যতটাই সাদামাটা মনে হোক, আমি কিন্তু বিষয়টিকে অতটা সাদামাটা মনে করি না; মনে করি না বলেই সংস্কৃতি বিষয়ে আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে বেশি বলি, বারবার বলতে চেষ্টা করি। আজকের মূল প্রসঙ্গে প্রবেশের আগে, মূল বক্তব্য প্রতিষ্ঠার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে কাঠ সম্পর্কে দুয়েকটা কথা বলি; বিষয়টি নতুন কিছু উদ্ভাবন নয় আমার, অনেকের জানা বিষয়, তবু বলি।

আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে কাষ্ঠের প্রয়োজন এবং ব্যবহার একেবারে কম নয়, যদিও সাম্প্রতিক সময়ে বিকল্প ব্যবহারে কাঠের ব্যবহার অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে, তারপরও নানা প্রয়োজনেই কাঠের গুরুত্ব এবং বনেদিপনা আজো অটুট আছে। কাষ্ঠ ব্যবহারে দুটি জরুরি অনুষঙ্গ হলো ‘সিজনড’ কাঠ আর ‘সারি’ কাঠ। ‘সিজনড’ কাঠ না হলে সে কাঠে জ্বালানি করা যায় সহজেই, কিন্তু শখের আসবাব তৈরি করতে গেলে ব্যবহার্য কাঠ ‘সিজনড’ হওয়া আবশ্যক, অন্যথায় কাষ্ঠ নির্মিত আসবাবের মান অটুট রাখা অসম্ভব। অন্যদিকে ব্যবহার্য কাঠ যদি ‘সারি’ না হয়, তাহলেও আসবাব নিয়ে আপনাকে বিপাকে পড়তে হবে। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে ক্ষতি নেই, আগুন আপনি পেয়েই যাবেন, পুড়েই তা নিঃশেষ হবে; কিন্তু স্থায়িত্বের কথা বিবেচনা করলে কাঠটা ‘সারি’ হওয়া আবশ্যক। সুতরাং ওই শব্দ দুটির গুরুত্ব আপনাকে বুঝতেই হবে। এই ‘সিজনড’ আর ‘সারি’ শব্দ দুটি সম্পর্কে যার ধারণা কম, তিনি আসবাব কিনতে গিয়ে ঠকে যাবেন সে আর বিচিত্র কী। ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক একবাক্যে বলি, ‘সিজনড’ তাই, যখন একটি বৃক্ষ কর্তনের পর তার শরীর থেকে রস শুকিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়, আর ‘সারি’ কাঠ তাই, যে গাছ কেটে কাঠ সংগ্রহ করা হয়, সে গাছটির বয়ঃপ্রাপ্তি; পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর যদি গাছটি কর্তন করা হয় তাহলেই কাঠে ‘সার’ পাওয়া সম্ভব; অপরিণত বয়সের গাছ কেটে কাঠ সংগ্রহ করা হলে সে কাঠ ‘সারি’ হয় না; সে কাঠ সহজেই নানা কীটের খাদ্য হয়। ভূমিকা শেষ, এবার মূল প্রসঙ্গে আসছি।

সংস্কৃতিমান মানুষকে আমরা ‘সিজনড’ আর ‘সারি’ কাঠের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। আর সংস্কৃতির আলোবর্জিত মানুষ ঠিক তার বিপরীত। সুতরাং অসংস্কৃতজন যখনই কোনো দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, অথবা ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ পেয়ে যান, তখনই বিপর্যয় ঘটানোর সমূহ সম্ভাবনা। বারবার তিনি সীমা লঙ্ঘন করবেন; তার সীমা লঙ্ঘন যে সবসময়ই স্বার্থান্ধতায় করবেন, তা না-ও হতে পারে, প্রায়ই অন্ধতা বশত করবেন, অশিষ্টতাজনিত কারণে করবেন, মোহান্ধতায় করবেন; যে ভাবেই করুন, প্রশ্নবিদ্ধ হবে তার দল-গোত্র-সমাজ-গোষ্ঠী। ক্ষমতার সঙ্গে যখন রাজনীতির যোগ, বিশেষ করে সরকারের দায়িত্বে থাকা রাজনৈতিক দলের যোগ; তখন কেবল ক্ষমতার স্থায়িত্বের জন্য নয়, জণসাধারণের জন্য সর্বোচ্চ অধিকার নিশ্চিতকরণের জন্যও দলের উচ্চ পর্যায় থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত যাদেরই দায়িত্ব দেয়া হবে, সবার ক্ষেত্রেই ‘সংস্কৃতিমান’ কি-না তা যাচাই করে নেয়া প্রয়োজন; তা না হলে আখেরে পস্তাতে হবে দলকেই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন’। বর্তমান সময়ে যখন কথাগুলো বলছি, অবশ্যই বর্তমান দায়িত্বশীল দলের উদ্দেশেই বলছি; আমি বলছি সতর্কতার জন্য, আপনি মানবেন কিনা সেটা আপনার বিবেচনা; এর আগেও আমরা দেখেছি ‘জাসাস’ নামের সাংস্কৃতিক দুর্বৃত্তায়নের চিত্র, দেখেছি তাদের বিপর্যয়ও।

একটা নাটকে বিভিন্ন চরিত্র থাকে, তার মধ্যে ‘মৃতসৈনিক’ নামে খ্যাত কিছু চরিত্র, যেমন গ্রামবাসী, পুলিশ, চৌকিদার, বন্যার্ত ইত্যাদিও থাকে; নাটকে তাদের বিশেষ কোনো ভ‚মিকাও থাকে না, সংলাপও থাকে না। দেখা যায় অপরিণত কিছু নতুন শিল্পীকে দেয়া হয় সেসব চরিত্র। সাধারণত দেখা যায় ওইসব গুরুত্বহীন ‘মৃতসৈনিকই’ নাটকের সর্বনাশ করে। তাদের কারণেই নাটকটি সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়ে উঠতে পারে না। নাটক যেহেতু টিমওয়ার্কের বিষয়, সুতরাং একজন নাট্যনির্দেশককে ‘মৃতসৈনিক’ চরিত্রের প্রতিও পূর্ণ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘নাটক ফুলের গাছ, তাতে কেবল ফুল ফোটালেই চলে না, সঙ্গে পাতাটি এবং কাঁটাটিও থাকা চাই।’

রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, ‘আমরা এত বড় রাজনৈতিক সংগঠন, আমাদের এসব সামান্য বিষয় নিয়ে ভাবার অবকাশ কোথায়? তাছাড়া রাজনৈতিক সংগঠনের ‘সাংস্কৃতিক সম্পাদক’ পদটি নাটকের ‘মৃতসৈনিকের’ মতোই, সুতরাং ওই পদে একজন কাউকে বসিয়ে দিলেই হলো!’ তাহলে দল চরম ভুল করবে। মনে রাখবেন, ‘মরা শামুকেই পা কাটে!’ দলের এ জাতীয় ভাবনার সুযোগে একজন অসংস্কৃত-অযোগ্য ব্যক্তি চেয়ার দখল করে বসেই তার অযোগ্যতা-অশিষ্টতা-মূর্খতা আর মোহান্ধতায় দলের সর্বনাশ করে ছাড়বে। আর ক্ষমতাসীন দলের সর্বনাশ মানে দেশের মানুষের সর্বনাশ। ভাববেন না আমি কোনো ব্যক্তি বিশেষের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছি, বরং আমি বেশকিছু জেলা-উপজেলার কমিটি পর্যবেক্ষণ করেই আমার এ অনুভ‚তির কথা উপস্থাপন করলাম, দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা বিবেচনা করে। একটি রাজনৈতিক দলের ‘সাংস্কৃতিক সম্পাদক’ কিছুতেই নাটকের ‘মৃতসৈনিকের’ চরিত্র নয়, বরং প্রাগ্রসরতা বিবেচনায় এটি অন্যতম ‘মুখ্যচরিত্র’। আর মুখ্য চরিত্র অযোগ্য-অশিষ্ট-অসংস্কৃত হলে দল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া কেবল কঠিন নয় বরং অসম্ভব। এখনো সময় আছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবুন। যেখানে প্রয়োজন বদলান, প্রয়োজনে সেমিনার-কর্মশালা-প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে তাদের প্রস্তুত করে তুলুন।

সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করছি, নানা ছুতানাতায় মানুষ প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। ভাবখানা এই, যেন দেশ উদ্ধারের দায় এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর। তাই যদি হয়, তাহলে পয়সা খরচা করে দেশে অত-শত মন্ত্রী পোষার আবশ্যিকতা কী। অন্যেরা যদি স্বল্প গুরুত্বের বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হতে পারেন, তাহলে আমি জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হলে দোষের কী? যদি আমার আকুতি নেত্রী বরাবরে পৌঁছায়, তবে বুঝব, তার অধস্তনরা ঠিকঠাক মতো কাজ করছেন; নইলে বুঝব, বিভ্রান্তির বেড়াজালে বন্দি প্রধানমন্ত্রী কেবল দম দেয়া পুতুল একজন; কিন্তু আমার পূর্ণ আস্থা, আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা, বাঙালির অহঙ্কার জাতির জনকের রক্তের উত্তরাধিকার দীপ্তনেত্রী শেখ হাসিনার ওপর। সেই আস্থায় বিশ্বাস রেখেই আজকের রচনা।

ফরিদ আহমদ দুলাল : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App