বালখিল্য ভুলের দায় কার
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:২০ পিএম
সিলেট শিক্ষা বোর্ডের অধীনে চলতি বছরের মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষার প্রথম দিন (৩ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ৯টায় হবিগঞ্জের বাহুবলের একটি কেন্দ্রে বলা হয়, বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা হবে সেট কোড-২-এর প্রশ্নপত্র দিয়ে। ১৫ মিনিট পর সকাল পৌনে ১০টায় বার্তা আসে সেট কোড-৩-এর প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া হবে। মূলত সেট কোড-২-এর বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্র ওই কেন্দ্রেই যায়নি। কিন্তু ১৫ মিনিটের ব্যবধানে দুই রকম বার্তায় পরীক্ষা সংশ্লিষ্টরা বিভ্রান্তিতে পড়েন।
শুধু এটাই নয়, গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ৭টি পরীক্ষায় আরো অসংখ্য ভুল ধরা পড়েছে। বাজারে নিষিদ্ধ নোট-গাইড থেকে হুবহু তুলে দেয়া হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্ন, কেন্দ্রে নতুন ও পুরনো সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন বিতরণে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন দায়িত্বরত শিক্ষকরা। আবার কোথাও কোথাও ইচ্ছামতো পরীক্ষার সময় বাড়ানো বা কমানো হচ্ছে। এসব নিয়ে দায়িত্বশীলরা নির্বিকার।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের সমন্বয়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক ভোরের কাগজকে বলেন, গত বছরের চেয়ে এ বছর ভুলের সংখ্যা কম। তবু এই ভুল হওয়া উচিত নয়। ভুলের দায় কার জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে সাধারণত শিক্ষকদেরই দায়ী করা হয় এবং এবারও করা হয়েছে। তবে কতজন শিক্ষককে দায়ী করা হয়েছে তার পরিসংখ্যান তিনি দিতে পারেননি। বোর্ডের দায় কতটুকু জানতে চাইলে তিনি নিরুত্তর থেকে বলেন, এতে পরীক্ষার্থীদের কোনো ক্ষতি হবে না।
গত দু-তিন বছর ধরে পরীক্ষায় অনিয়ম-বিশৃঙ্খলার অভিযোগ অনেকটাই কমে গিয়েছিল। এ সময় দু-একটি ঘটনা ঘটলেও শিক্ষা প্রশাসন অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ ছাড়া শিক্ষামন্ত্রী পরীক্ষা চলাকালীন এক মাস সব ধরনের কোচিং সেন্টার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু দু-এক বছর যেতে না যেতেই অবস্থা আবার আগের মতো হয়ে উঠেছে। এবার অধিকাংশ কোচিং সেন্টারই খোলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছর এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিটি পরীক্ষায় কোনো না কোনো ভুল রয়েছে। ভুলের কারণে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এর দায় কার সেটি নিয়ে কেউ কথা বলছেন না। এসব ভুলের ক্ষেত্রে সাধারণত দায়িত্বরত শিক্ষকদের দায়ী করা হয়। অথচ শিক্ষকদের ওপরে রয়েছেন মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা, তাদের ওপরে বোর্ড কর্তৃপক্ষ এবং সবার ওপরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে ভুলের দায় এরা কেউ নিচ্ছেন না।
ঢাকা বোর্ডের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, গত সাতটি পরীক্ষায় ভুলের জন্য দায়ীদের চিহ্নিত করা সংক্রান্ত কোনো বার্তা প্রকাশ করা হয়নি। তবে গত ২০ জানুয়ারি ঢাকা বোর্ডের অধীনে কেন্দ্র সচিবদের নিয়ে পরীক্ষা সংক্রান্ত যে বৈঠক ডাকা হয়েছিল তাতে ১১ জন কেন্দ্র সচিব যোগ দেননি। এ জন্য গত ১২ ফেব্রুয়ারি তাদের শোকজ করেছে ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড তাদের ওয়েবসাইটে প্রধান শিক্ষক ও ট্যাগ অফিসারদের উদ্দেশ্যে বার্তা প্রকাশ করে বলেছে, মাধ্যমিক পরীক্ষায় সঠিক প্রশ্নপত্র ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি। সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণের স্বার্থে নতুন বা পুরনো সিলেবাসের প্রশ্নপত্র যথাযথ ও নির্ভুলভাবে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকতর সতর্কতার সঙ্গে বিতরণ করতে হবে। একই দিন সিলেট শিক্ষা বোর্ডও তাদের অধীনের পরীক্ষাকেন্দ্র সচিবদের বলেছে, নতুন ও পুরনো সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের আলাদা আলাদা কক্ষে বসিয়ে পরীক্ষা নিতে হবে। প্রশ্নপত্র বিতরণে কোনো অনিয়ম কিংবা বিশৃঙ্খলা হলে এর দায় কেন্দ্র সচিবদের ওপর বর্তাবে। প্রায় একই কথা বলেছে অন্য শিক্ষা বোর্ডগুলোও।
রাজধানীসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, বরিশাল, বাগেরহাট, ময়মনসিংহ, নীলফামারীতে বিশৃঙ্খল অবস্থায় এসএসসি পরীক্ষা নেয়া হয়। যশোর, শেরপুর, ফরিদপুর ও গাইবান্ধায় ২০১৮ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র বিতরণেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ন্যূনতম চারটি শিক্ষা বোর্ডের শীর্ষ পদেই পদায়ন করা হয়েছে নানা কারণে অদক্ষ ও বিতর্কিত কর্মকর্তাদের। তাদের সঙ্গে নিষিদ্ধ নোট-গাইডের ব্যবসায়ী, কোচিং সেন্টারের মালিক, বাণিজ্যনির্ভর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা ব্যবসায়ীদের গভীর সখ্য রয়েছে। এ কারণেই এবারের এসএসসি পরীক্ষার শুরুতেই এক ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এছাড়া প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে অভিযুক্ত ব্যক্তি ও কর্মকর্তার কোনো শাস্তি না হওয়ায় পরীক্ষায় নানা ভুল হচ্ছে।
২০১৬ সালে জেএসসি পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে হুবহু প্রশ্ন তুলে দিয়ে বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্ন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ঘটনার জন্য দায়ী কর্মকর্তাকে স¤প্রতি একটি শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে গাইড বই থেকে রাজশাহী বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়নের অভিযোগ ওঠে। এর আগে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে এসএসসির ইংরেজি প্রশ্নপত্র ও পদার্থ বিজ্ঞানের ইংরেজি ভার্সনের প্রশ্নপত্র হুবহু গাইড বই থেকে তুলে নেয়া হয়। এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব এএস মাহমুদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্ত প্রতিবেদনটি আলোর মুখ দেখেনি। মূলত এসব গাফিলতির কারণেই পরীক্ষায় নানা ভুল হচ্ছে এবং বরাবরই ভুলের কারিগররা রেহাই পেয়ে যাচ্ছেন।