×

জাতীয়

পলাশের বনে আজ রঙের খেলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০১:৩৯ পিএম

পলাশের বনে আজ রঙের খেলা

ফুলের সঙ্গে বসন্তের মিতালি। ছবি: ভোরের কাগজ।

শুকনো পাতা ঝরে কদিন আগেই জন্ম নিয়েছে নতুন কচি পাতা। আজ সেই পত্রপল্লবে, ঘাসে ঘাসে, নদীর কিনারে, কুঞ্জ-বীথিকা আর পাহাড়-অরণ্যে বসন্ত এসেছে নবযৌবনের ডাক নিয়ে। সোনালি রোদের ছোঁয়ায় পলাশবনে জেগেছে রঙের খেলা। কোকিলের কুহুতানে মাতাল মহুয়া বন। আজ পহেলা ফাগুন। ফাল্গুনের প্রথম দিনের হাত ধরেই ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। বসন্ত মানেই গাছে গাছে নতুন ফুল, নতুন সবুজ কচিপাতা, পাখির সুর, সবমিলিয়ে প্রকৃতির নতুন রূপ। তাই বাসন্তী রঙা বসনে নগরবাসী বরণ করে রঙিন বসন্তকে। শুধু শহরেই নয়, বাংলার গ্রামীণ জনপদেও আজ ঝিরিঝিরি বাতাসে ধরা দেবে বসন্ত। অন্যদিকে আজ একইদিনে পালিত হবে ভালোবাসা দিবস। ফাগুন আর ভালোবাসা দিবস মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে লাল আর হলুদ রঙের ছোঁয়ায়। প্রেমিক মনে জাগবে সুরের ঝংকার ‘তোমার অশোকে কিংশুকে/ অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে/... তোমার প্রজাপতির পাখা/ আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন-স্বপন-মাখা।’ গবেষকদের মতে, প্রিয় সানিধ্যে ব্যাকুল হৃদয়ে গভীর প্রভাব ফেলে ঋতুচক্র। শীতের জড়তা শেষের আগেই অন্তরে বাজে কবিগুরুর তান, ‘কি জানি কিসের লাগি, প্রাণ করে হায় হায়।’ বসন্তের আগমনে উচাটন হয়ে ওঠে মন। পুরনো বেদনা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ভালোবেসে এর পেছনে আবারো ছুটতে প্ররোচনা দেয়। পাখিরাও নীড় খোঁজে। ঘর বাঁধে। মৌমাছিরা মধুর খোঁজে হন্যে হয়। এক ফুল থেকে ছোটে অন্য ফুলে। এভাবে হাত ধরে হাঁটে বসন্ত আর ভালোবাসা। বাউল কবি শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো, বসন্ত বাতাসে।’ সনাতন ধর্মের পৌরাণিক উপাখ্যান এবং লোককথাগুলোতেও বসন্ত উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন আমলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বসন্ত উৎসব পালিত হতো। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে বিশেষ নৃত্যগীতের মাধ্যমে বসন্ত উৎসব পালনের রীতি চলে আসছে। বাংলাদেশে ১৪০১ সাল থেকে ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপনের আয়োজন করে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ। আজও অনুরূপ কর্মসূচির ধারাবাহিকতায় সকাল ৭টায় চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বসন্ত উৎসবের আয়োজন করবে তারা। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশায় দিনটি বিশেষ উৎসবের আমেজে পালিত হয়। বাংলাদেশে এতদিন ফেব্রুয়ারি মাসের ১৩ তারিখে পহেলা ফাল্গুন পালিত হতো। আর ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় ভালোবাসা দিবস।বাংলা বর্ষপঞ্জিতে সংশোধনের কারণে এখন থেকে দুটি দিবসই বাংলাদেশে একইদিনে পড়বে। বাংলায় বসন্ত মানেই দ্রোহের আরেক নাম। সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর, সালাহউদ্দিনের রক্তে কেনা মাতৃভাষার নাম। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তি করে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়েছিল আগুনঝরা এই ফাগুনেই। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল রক্তঝরা ফাগুনেই। শাহবাগে তরুণ প্রজন্মের গণজাগরণের মূল দাবি ‘যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির’ রায় হয় দ্রোহের ফাগুনেই। এদিকে ভালোবাসার জন্য মানুষ পাড়ি দিতে চেয়েছে কালাহারি। দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে কালো কাপড় বেঁধে আনতে চেয়েছে একশ ৮টি নীল পদ্ম। সম্রাট শাহজাহান প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজের জন্য বানিয়েছেন ‘তাজমহল।’ রাধা-কৃষ্ণ, লাইলী-মজনু, ইউসুফ-জুলেখার প্রেমকাব্য এখনো মানুষের মুখে মুখে। ভালোবাসার মানুষের পায়ে হৃদয়ের সবটুকু উচ্ছ্বাস ঢেলে দিতে উদগ্রীব চিত্ত গেয়ে ওঠে কবিগুরুর গান ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে/জীবন মরণ সুখ-দুঃখ দিয়ে বক্ষে ধরিব জড়ায়ে।’ আর প্রিয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে শহীদ কাদরী দৃপ্ত উচ্চারণে বলে দিয়েছেন, ‘ভয় নেই/ আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী/গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে/মার্চপাস্ট করে চলে যাবে/এবং স্যালুট করবে/কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।’ তবে প্রিয় বিরহে আক‚ল হৃদয়েও রয়েছে হারানোর ভয় ‘মনে হয় তবু বারে বারে/এই বুঝি এলে মোর দ্বারে/সে মধুর স্বপ্ন ভেঙ্গো না কো।’ অবশ্য আত্মপ্রত্যয়ী মনেই রয়েছে এর উত্তর। কবি নির্মলেন্দু গুণের ভাষায়, ‘হেমের মাঝে শুই না যবে/প্রেমের মাঝে শুই/তুই কেমন করে যাবি?/পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া/আমাকেই তুই পাবি।’ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উদযাপনের ইতিহাস বেশ পুরনো। এ নিয়ে প্রচলিত রয়েছে অনেক কাহিনি। তবে সবচেয়ে বেশি যে গল্পটি প্রচলিত সেটি হচ্ছে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে একজন রোমান ক্যাথলিক ধর্মযাজকের ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের একটি ঘটনা। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামে ওই ধর্মযাজক চিকিৎসকও ছিলেন। তখন রোমান সম্রাট ছিলেন দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। বিশ্বজয়ী রোমানরা একের পর এক রাষ্ট্র জয় করে চলেছে। যুদ্ধের জন্য রাষ্ট্রে বিশাল সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলা দরকার। কিন্তু লোকজন বিশেষ করে তরুণরা এতে উৎসাহী নয়। সম্রাটের ধারণা ছিল পুরুষরা বিয়ে করতে না পারলে যুদ্ধে যেতে রাজি হবে। তিনি তরুণদের জন্য বিয়ে নিষিদ্ধ করলেন। কিন্তু প্রেমপিয়াসী তারুণ্যকে কী নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করা যায়! এগিয়ে এলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। ভ্যালেন্টাইন প্রেমে আবদ্ধ তরুণ-তরুণীদের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু এক দিন ধরা পড়ে গেলেন ভ্যালেন্টাইন। তাকে জেলে নেয়া হলো। দেশজুড়ে এই খবর ছড়িয়ে পড়লে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। অনেকেই ভ্যালেন্টাইনকে জেলখানায় দেখতে যান। ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে আসেন। কারাগারের জেলারের একজন অন্ধ মেয়েও ভ্যালেন্টাইনকে দেখতে যেত। চিকিৎসক ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির অন্ধত্ব দূর করলেন। তাদের মধ্যেও সৃষ্টি হলো হৃদয়ের বন্ধন। ধর্মযাজক হয়েও নিয়ম ভেঙে তিনি প্রেম করেন। আইন ভেঙে তিনিও বিয়ে করেন। খবর যায় সম্রাটের কানে। তিনি ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড দেন। দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে রোমের রাজা পপ জেলুসিয়াস এই দিনটিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে এবারো নগরজুড়ে নানা অনুষ্ঠানমালা রয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস আর টিএসসি চত্বরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বইমেলা, চারুকলার বকুলতলা, শিল্পকলা একাডেমি, ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবর, উত্তরা, বনানীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে নানা অনুষ্ঠান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App