×

মুক্তচিন্তা

বিজয়ী ট্রাম্পের আরো অনাচারী হওয়ার সম্ভাবনা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:০০ পিএম

বিশ্বজুড়ে এখন মনে হয় রক্ষণশীলতার জোরালো হাওয়া বইছে। মাঝেমধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় মৃদুমন্দ হাওয়া অর্থাৎ রাজনৈতিক উগ্র জাতীয়তাবাদ বা প্রভুত্ববাদের মাঝামাঝি পর্যায়ের পরিবেশ। ব্যতিক্রম সামান্য। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও নানা ধর্মের, নানা বর্ণে জনবিরোধী, মানবতাবিরোধী চেতনারই প্রাধান্য। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা হিসেবে পরিচিত ব্রিটেন ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে তার সর্বজনীন সম্মিলিত অবস্থান মানিয়ে নিতে পারেনি। পারেনি তার জাতীয়তাবাদী শ্রেষ্ঠত্ববোধের কারণে। উপনিবেশবাদী ব্রিটেন বোধহয় ভুলতে পারছে না তার বিশ্ব শাসনের স্মৃতি ‘রুল ব্রিটানিয়া, রুল’-এর মধুগন্ধ এবং সুমিষ্ট স্বাদ। তাই ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতা। পার্লামেন্টে বিজয়ী জনগণের কী মিত্রতা আরেক উগ্র শে^তাঙ্গ জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে! নির্বাচনী পর্বে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যে মানুষটি তার উদ্ভট পরস্পরবিরোধী কথাবার্তায় বিশ্বব্যাপী মানুষকে চকিত-চমকিত করে দিয়েছে, তার অবিশ্বাস্য ও বিতর্কিত বিজয় অসংখ্য আমেরিকানকে অবাক করে দিয়েছে, সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউসের মসনদে বসে কত রকমারি স্ববিরোধী রাজনৈতিক প্রলাপই না বকেছেন। নির্বাচনকালে তার রিপাবলিকান দলেও তাকে নিয়ে বিতর্ক কম ছিল না। তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে পরস্পরবিরোধী কথাবার্তার কারণে। প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হয়েই তার প্রথম জনবিরোধী পদক্ষেপ হলো পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট উদারপন্থি বারাক ওবামার জনবান্ধব স্বাস্থ্য সেবানীতি বাতিল করা এবং একের পর এক বিতর্কিত পদক্ষেপ গ্রহণ। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন যুদ্ধবাজ, আগ্রাসী মনোভাবের প্রেসিডেন্ট। সেইসঙ্গে চরম ইহুদি তোষণনীতির ধারক-বাহক এবং মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবপন্থি গোড়া ইসলামপন্থিদের সমর্থক, অবশ্য তেলসম্পদ স্বার্থের বিনিময়ে। বিশ্ব শাসনের আকাক্সক্ষা তারও কোনো অংশে কম নয়। অসম্ভব মাত্রার একজন আত্মকেন্দ্রিক এবং দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তার লক্ষ্য ফিলিস্তিনবিরোধী ভূমিকা নিয়ে ইসরায়েল তোষণ, শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদী স্লোগান তুলে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করা। এ লক্ষ্যে যে কোনো লঙ্কাকাণ্ড ঘটাতে একপায়ে খাড়া ট্রাম্প। সেক্ষেত্রে আঞ্চলিক যুদ্ধে জড়াতে বা উসকানি দিয়ে তেমন কিছু শুরু করতে তার আপত্তি নেই। সেজন্য চতুর ইসরায়েলি গোয়েন্দার সাহায্য নিয়ে ইরানের ক্ষমতাশালী সামরিক ব্যক্তিত্ব কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ড নিঃশব্দে সম্পন্ন করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ ব্যাপারে কংগ্রেসকে অন্ধকারে রাখা হয়েছে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি অমান্য করে। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমনিতেই অসীম ক্ষমতা রাজনীতির মধ্যেই। তা সত্তে¡ও নিয়মকানুন ভেঙে ক্ষমতার অপব্যবহার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের কাজে বাধাদান তার জন্য নিত্যদিনের ঘটনা। রিপাবলিকান দলের আইন প্রণেতারা নীরবে এসব অপকর্ম হজম করে চলেছে। দুয়েকজন, যেমন মিট রমনি আপত্তি সত্তে¡ও দলীয় প্রধানদের কারণে প্রতিবাদহীন। আর সে কারণে উল্লিখিত দুই অভিযোগে ডেমোক্রেট দলের আনীত ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন (্ইমপিচমেন্ট) প্রস্তাব প্রতিনিধি পরিষদে গৃহীত হলেও সিনেটে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে তা বাতিল হয়ে গেল। এমনটাই আশঙ্কা ছিল রাজনীতিমনস্ক মানুষের। তবু কারো কারো প্রত্যাশা ছিল তার যুক্তিহীন, নৈরাজ্যিক আচরণে বিরক্ত কিছুসংখ্যক রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। কিন্তু না সে আশা পূরণ হয়নি। দলীয় প্রধানরা হয়তো ভেবেছেন, ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় তাদের দলীয় প্রেসিডেন্টের অভিশংসন আসন্ন নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হওয়ার কারণে। কাজেই উন্মাদ হলেও তাকে স্বপদে আসীন রাখতে হবে। তাই সিনেটে অভিশংসন প্রস্তাব খারিজ। তবে মনে রাখতে হবে যে, ট্রাম্প জয়ী হলেও ভোটের ব্যবধান অতি সামান্য। প্রথম অভিযোগের ফলাফল ৫২-৪৮, দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ৫২-৪৭। সামান্য ব্যবধানে জয়ী হওয়ার পরও ট্রাম্পের সে কী উল্লাস হোয়াইট হাউসে উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের। এ যাত্রায় মরতে মরতে বেঁচে গেলেন তিনি। ভোটের ফলাফল যেমনই হোক, বিজয়ের আনন্দ-অনুষ্ঠান তো করতেই হবে। কারণ আর কিছুই নয়, এ মানুষটার নাম তো ডোনাল্ড ট্রাম্প নাৎসি জার্মানির উত্তরাধিকারসূত্র তথা যুদ্ধবাদী জিনবহনকারী ব্যবসায়ী, রাজনীতিতে যার আগমন অশুভ সংকেত দিয়ে চলেছে। দুই. আমাদের বিশ্বাস মার্কিন সিনেটের এ রায় বিশ্ব শান্তি তথা বিশ্ব রাজনীতির জন্য এক অশুভ সংকেত বহন করছে। কারণ আমাদের আরো বিশ্বাস, দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আরো ভয়ঙ্কর চরিত্র নিয়ে দেখা দিতে পারেন। তখন তাকে দেখা যাবে আরো প্রভুত্ববাদী, আরো অনাচারী এক প্রেসিডেন্ট রূপে। তাকে গণতান্ত্রিক নিয়মনীতির আওতায় রাখা আইন পরিষদগুলোর পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। তার প্রকৃতিটাই এ ধরনের। তাই আপাতত আনুষ্ঠানিক বিজয়ের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কেই আমাদের একটি দৈনিকের সংবাদ শিরোনাম : ‘আরো কর্তৃত্বপরায়ণ ট্রাম্প’। এমন ধারণা ওয়াশিংটনের কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের। তাদের ধারণা, এটা ট্রাম্পের জন্য বড় বিজয়। এর প্রভাব পড়বে দলে, দলীয় কর্মীদের ওপর এবং ভোটারদের মতামত তৈরির ক্ষেত্রেও। তাতে আগামী নির্বাচনে সুফল আসতেও পারে। আমরা ঢাকায় বসে মার্কিন ভোটাদের মনস্তত্ত¡ বিশ্লেষণের সুযোগ পাব না। তবে ভোটার রাজনীতি ও ভোটার মানসিকতার একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, যার চরিত্র সর্বজনীন, সেদিক বিচারে অভিযুক্ত একজন প্রেসিডেন্টকে, তাদের নিজস্ব শাসনে অভিযোগ থেকে ‘বেকসুর খালাস পাওয়া’কে কতটা সাদা মনে মেনে নেবে বা নিতে পারে মানুষ, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবে আমেরিকার নির্বাচনী ব্যবস্থাটা এমনই জটিল যে ইতোপূর্বে পরাজিত প্রার্থীর জিতে যাওয়ার মতো ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। বিশেষ করে অনেকেরই মনে পড়তে পারে জুনিয়র বুশ বনাম ডেমোক্রেট প্রার্থী আল গোরের প্রেসিডেন্ট প্রতিযোগিতার বিস্ময়কর ঘটনাটি, যেখানে বুশের পক্ষে বিজয় ঘোষণাটি যুক্তিসঙ্গত, ন্যায়সঙ্গত ছিল না। কিন্তু ওই যে পশ্চিমা নির্বাচনী বিশ্বের একটি ঐতিহ্য আছে, ত্রু টিপূর্ণ বিজয়কেও ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে মেনে নেয়া সেটাই ঘটেছিল আল গোরের ক্ষেত্রে। তবে ইতিহাস বড় বিচিত্র ঘটনাদি লিপিবদ্ধ করে রাখে। আল গোর প্রেসিডেন্ট হলে হয়তো ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি বেøয়ারের পক্ষে সম্ভব হতো না কুমন্ত্রণা দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ইরাক আক্রমণে উদ্বুদ্ধ করা। তবে সবই ঘটনা ও ভবিতব্য। তিন. সেক্ষেত্রে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম রক্তাক্ত নিকৃষ্টতম ঘটনাটি ঘটত না। ইরাক তথা বাগদাদ পুড়ে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের রেশ তৈরি করত না। এবার আগামী নির্বাচনে ট্রাম্পের সম্ভাব্য বিজয় তেমন কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনার জন্ম দেয় কিনা, বিশেষ করে ইরানকে নিয়ে তা কে বলতে পারে। তা যাই হোক সিনেটে ট্রাম্পের বিজয় উপলক্ষে ডেমোক্রেটদের প্রতিক্রিয়াও লক্ষ করার মতো। তাদেরই এক নেতা বলেছেন, ‘এই প্রথম একটি বিচার অনুষ্ঠিত হলো যেখানে নতুন সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করতে দেয়া হলো না। ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত নেই।’ তাদের অন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, আজ হোক কাল হোক, পুরো সত্য একদিন প্রকাশিত হবেই। ন্যায় বিচারের স্বার্থেই বোলটনের সাক্ষ্যের প্রয়োজন ছিল।’ পর্যবেক্ষকদের মতে, ‘চ‚ড়ান্ত শুনানিতে স্পষ্ট হয়েছে যে রিপাবলিকান পার্টির পুরো নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতেই রয়েছে।’ এর অর্থ একটাই। রিপাবলিকান পার্টির নেতারা সম্ভাব্য নির্বাচন সামনে রেখে মনোনয়নের স্বার্থে প্রেসিডেন্টের অবাধ ক্ষমতার যূপকাষ্ঠে নিজদের সঁপে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে যুক্তি, ন্যায়, নিষ্ঠা সব কিছু স্বার্থের টানে ভেসে গেছে। ক্ষমতার এমনই দাপট, এমনই জোর। এখানেই মার্কিন শাসন ব্যবস্থার দুর্বলতা, যা প্রকৃত গণতন্ত্রকে অতিক্রম করে যায়। অতীতেও গেছে, এখনো যাচ্ছে। উদাহরণ কম নয়। ভবিষ্যতেও যেতে পারে। এই বিজয় নিয়ে অবশ্য বিশ্লেষকদের মধ্যে ভিন্ন মতও লক্ষ করার মতো। তাদের কারো কারো মতে, বিচার প্রক্রিয়াটি বিজয়ের প্রকাশ নয়। এতে দেশের এবং গণতন্ত্রের ক্ষতি হলেও ডেমোক্রেটদের হাতে বারুদ তুলে দেয়া হলো। তবে এ ব্যাপারে বোমা ফাটালেন প্রিসটন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন রাজনীতির অধ্যাপক। তার মতে, ‘ডেমোক্রেটরা অভিশংসন বিচার প্রক্রিয়াকে তাদের অপকর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করবে। একই সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যুতে ট্রাম্পের দুর্নীতি ও অসততা সম্পর্কে ভোটারদের মনে সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে পারবে।’ বেশ বোঝা যায় মার্কিনি অধ্যাপক বুদ্ধিজীবীরা তাদের রাজনীতিকদের সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করেন। তবু তারা এ নিয়ে রাজপথে প্রতিবাদে নামেন না। আমরা কি সেই রাজনৈতিক ঐতিহ্য বহন করছি? আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App