×

সাময়িকী

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৬:২১ পিএম

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

[ শেষ পর্ব ]

বাণিজ্য ও পর্যটন মন্ত্রীদ্বয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিজ সান্দ্রা, মোসেস উলুডং আর লেখাই বাহুল্য মাননীয় প্রেসিডেন্ট মি. জনসন টরিবিওং। তিনি এলেন প্যান্ট আর হাওয়াই শার্ট পরে। প্যাসিফিকের দেশগুলোয় এই ধরনের পোশাক বোধহয় জনপ্রিয় ও আরামদায়ক। রেড গ্লাস উঁচিয়ে তার স্বাস্থ্য পান দিয়ে ডিনার শুরুর আগে আমি তাকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললাম, আমাদের মাননীয় রাষ্ট্রপতি ব্যক্তিগতভাবে আপনার সুস্বাস্থ্য ও পালাওয়ের সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। তিনি আশা করেন বাংলাদেশ ও পালাও দুটি বন্ধু প্রতীম দেশের মাঝে সম্পর্ক আরো জোরদার হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও পালাওয়ের গণতন্ত্রকামী জনগণের সুখ ও শান্তি কামনা করেছেন। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক শান্তিপ্রিয় দেশ। সারা পৃথিবীতে শান্তি রক্ষায় আমাদের প্রশংসনীয় ভ‚মিকাও রয়েছে। শুধু শান্তি রক্ষায়ই নয় বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা পেশায় নিয়োজিত থেকে সেসব রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও অবদান রেখে চলেছে। পালাওয়েও আমাদের কিছু নাগরিক কর্মরত আছে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস তারা স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে মিলেমিশে সুনাম ও আস্থার সঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে ওই আস্থায় সংকট দেখা দেয়ায় তা উত্তরণে আমি মাননীয় প্রেসিডেন্টের সদয় হস্তক্ষেপ কামনা করছি। আমি একে একে অত্যন্ত সংক্ষেপে বাংলাদেশিরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি তা মি. জনসনের গোচরে আনি। তিনি তা মনোযোগ দিয়ে শোনেন। যদিও আমার ধারণা এ সম্পর্কে মিজ সান্দ্রা আগেই তাকে অবহিত রেখেছেন। প্রচলিত প্রথানুযায়ী তিনি আমাদের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বললেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে আমি পালাওয়ে স্বাগত জানাই। আমরা আশা করব তার নাগরিকদের কল্যাণের লক্ষ্যে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে পালাওয়ে একটি ক‚টনৈতিক মিশন খোলার বিষয় বিবেচনা করবে। পালাও বাংলাদেশের সঙ্গে টেকসই সুসম্পর্ক প্রত্যাশা করে। সেই প্রত্যাশা রেখে আমি বলছি যেসব বাংলাদেশি বর্তমানে পালাওয়ে অবস্থান করছে তাদের ফেরত পাঠানো হবে না। দ্বিতীয়ত, ভিসার বেলায় যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তা আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠিয়ে নেব। তিনি রেড গ্লাস উঁচিয়ে ধরেন। রবার্টকে সাধুবাদ জানাতে হয়। ডিনার আয়োজনে সে কোনো কার্পণ্য রাখেনি। সে একজন সফল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ী হিসেবে রবার্ট ভালো করেই জানে তাজে প্রেসিডেন্টের ডিনার গ্রহণ তার রেস্টুরেন্টের সুনাম প্রসারে অনেক সাহায্য করবে। আমার প্রতিও সে যেন একটু কৃতজ্ঞ যে তাজকে আমি প্রেসিডেন্টের কাছে পরিচিত করিয়ে দিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা পানাহার চলল। প্রেসিডেন্টের ডানে আমি। বাঁয়ে উলুডং। সে অমবাডসম্যান নয় সাংবাদিক সুলভ তাড়নায় রেড গ্লাস সবার থেকে বেশি ঠোঁটে ছোয়াচ্ছে। আমার ডানে মিজ সান্দ্রা। প্রেসিডেন্ট সবার আগে উঠলেন। আমি তাকে শাইনপুকুর দিতে ভুললাম না। বললাম, এটি বাংলাদেশের তৈরি সিরামিক পণ্য। পৃথিবীর অনেক দেশে আমরা রপ্তানি করি। আপনার জন্য এটি সেই সুদূর ঢাকা হতে এসেছে। ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। পানাহার চলতে থাকল। আমি সান্দ্রাকে বললাম, প্রেসিডেন্ট যা বললেন তা কি পালাও ফরেন অফিস আমাদের লিখে জানাতে পারে? তিনি হাসলেন। বললেন, আমি অনুমান করেছিলাম প্রেসিডেন্ট ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই এমন একটি অনুরোধ পাব। আমিও হেসে উত্তর দেই, ফরেন অফিস হয়তো নিজ থেকেই লিখবে তবে আমার দিক হতে একটু স্মরণ করিয়ে রাখলাম। ঠিক আছে এ বিষয়ে তাড়াতাড়িই চিঠি পাবেন আপনারা। বাণিজ্যমন্ত্রী ও পর্যটনমন্ত্রী এখন নিজেদের মাঝে আলোচনায় নিমগ্ন। তাজে আমরা ছাড়াও আরো অনেক খদ্দের। বিদেশি। তাদের অধিকাংশ বারান্দার উপরে ছাদ। সারাদিন বেড়ানোর পর এখন আয়েশ করে ডিনার চলছে। উলুডং খালি করে চলেছে গ্লাস। মন্ত্রীগণ সে তুলনায় অনেক পিছিয়ে। প্রেসিডেন্ট উলুডংকে ডাকেন মোসেজ। যাবার আগে আস্তে করে ওর সম্পর্কে বললেন, হি ইজ মাই ম্যান। বাংলাদেশের অনারারি কনসাল হিসেবে সিনেটর সান্তির চেয়ে সে আরো ইফেক্টিভ হবে। একটু খেয়াল রাখবেন। অবশ্যই। কিন্তু তিনি নিজেই তো আমাকে সিনেটর সান্তির কথা বললেন। আমার মনে হয় মোসেজ ভালো হবে। আচ্ছা। মোসেজ আবার রেড গ্লাস তুলে ধরল। সান্দ্রাকে দেখিয়ে বলল, লেট সিক্সটিজে আমরা একসঙ্গে কোরোরের রাজপথে ছিলাম। গণতন্ত্র ও স্বাধীকারের দাবিতে কাজ করেছি আমরা। বলতে গেলে তারাই এখন পালাও পরিচালনা করছে। আমি তার কথা শুনছি আর ভাবছি বাংলাদেশের হবু কনসাল হিসেবে সে কতটুকু কার্যকর হবে। কতটুকু যোগাযোগই বা তার আছে গুরুত্বপূর্ণ লোকজনের সঙ্গে। প্রেসিডেন্ট নিজেই বললেন সে তার লোক। এরপর তো আর অন্য কোনো সুপারিশের দরকার হয় না। সান্দ্রা মোসেজের সঙ্গে দ্বিমত করলেন। বললেন, আমি ব্যবসায়ী মানুষ। কখনো আন্দোলন সংগ্রামে ছিলাম না। মোসেজ ঠিক বলছে না। হতেও পারে। একটু আবেগি লাগছে তাকে। সারাদিন প্যাসিফিকে কাটল। আমার ক্লান্তি লাগছে। কিন্তু আমার অতিথিরা না উঠলে কীভাবে আমি তাদের গুডবাই দেই। যথেষ্ট খাওয়া হয়েছে। একমাত্র সান্দ্রাই ডেজার্ট নিতে পারলেন। কালকে আমার ফেরা। প্যাসিফিকের এই বিন্দুতে আবার কি আসা হবে? হবে না। শুধু হৃদয়ের গভীরে থেকে যাবে পালাওয়ের কয়েকটি দিন। বড় স্মৃতিময় এই মানব জীবন। আমীন-শরীফেরা আমাকে প্লেনে তুলে দেবে। আমি বারণ করব এয়ারপোর্টে আসতে। বলব, কাজ ফেলে আসার প্রয়োজন নেই। তাই কি হয় স্যার? আর কি কেউ কোনোদিন আমাদের জন্য আসবে। দরকার হলে অবশ্যই আসবে। চিফ অব প্রটোকল আমাকে তুলে দেবেন। শুধু শুধু সময় নষ্টের প্রয়োজন কী? তারপরেও তারা আসবে। অনেকেই। দশ-পনেরো জন তো হবেই। ছোট্ট, অব্যস্ত বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়িয়ে বিদায়ী কথা হবে আমাদের। আমার মনে হবে তাদের পথ অনুসরণ করে আরও বাংলাদেশি আসবে পালাওয়ে। বহু বছর ধরে। সাত আট দশক পর আমীন-আজাদ-শরীফ-খারশেদ-সজীব-আওলাদ হেড কাঠমিস্ত্রিরা পরিণত হবে প্রবাসে অগ্রজ। তারা তখন বেঁচে থাকবে না। প্যাসিফিকে এক টুকরো বাংলাদেশ সৃষ্টিতে নিঃশেষ হয়ে যাবে তাদের রক্ত, প্রাণবায়ুও। তাদের অভিবাদন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App