×

মুক্তচিন্তা

বাংলা ভাষা প্রসারে আমাদের ভূমিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১০ পিএম

বাংলাদেশে জীবিকার জন্য আসছেন অনেক ভিনদেশি নাগরিক। ব্যবসায়িক ও দাপ্তরিক কাজ বাংলায় চালু করলে ভিনদেশিদের জীবিকার প্রয়োজনে বাংলা শেখা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। আমরা ইংরেজি শিখব না, তা নয়, অন্যদের বাধ্য করব বাংলা ভাষা শিখতে। নিজের ভাষার প্রসারের জন্য এইটুকু আক্রমণাত্মক হতে বাধা কোথায়?
নৃ-তত্তে¡র ছাত্র হিসেবে আমি প্রথম জেনেছিলাম যে প্রস্তর যুগে যখন শিকার ও আহরণের সাহায্যে মানুষ জীবন ধারণ করত, তখন তারা সৃষ্টি করেছিল ভাষা। উদ্দেশ্য পারস্পরিক ভাবপ্রকাশ। ক্রমে স্থান ও কালের নিরিখে তার আঙ্গিক হলো বহুবিধ। একইভাবে ভারতীয় উপমহাদেশীয় অঞ্চলে অনেক ভাষার সৃষ্টি হলো। কিন্তু সেই ভাষার উপস্থিতি চিহ্নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হলো যাকে বলা হয় লিপির প্রচলন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপির প্রচলন ছিল। এরও বহু পরে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ অব্দের প্রায় কাছাকাছি সময়ে সম্রাট অশোকের লিপি সৃষ্টি হয়েছিল। তারও পর কুণাললিপি, গুপ্ত আমলে গুপ্তলিপি, মৌর্যলিপি, আর্যলিপি, কুটিললিপি ইত্যাদির সৃষ্টি হয়েছিল। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের সময় নাগাদ প্রাচীন বাংলালিপির সৃষ্টি হয়েছিল। সৃষ্টি হলো বাংলা ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা। বিশ্বে প্রায় ৫ হাজার ভাষায় মানুষ কথা বলেন। যার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই হলো আফ্রিকার ব্যবহৃত ভাষা। এদের অনেকেরই বর্ণমালা নেই। তবে পৃথিবীতে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন, সেটি হলো চীনা ভাষা। চীনা শব্দে প্রায় ৭০ হাজার চিহ্ন ব্যবহৃত হয়। ১৫০০ শতক আধুনিক ইংরেজির সূচনা হয়। ১৬০৪ সালে প্রথম ইংরেজি শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে এখানকার আধুনিক ইংরেজি শব্দের প্রচুর ফারাক আছে। স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলেন পৃথিবীর প্রায় ৩৩ কোটিরও বেশি মানুষ। চিলি, মেক্সিকো, পানামা, আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কিউবা, গুয়েতামালা, গিনি, কিউবা, নিকারাগুয়া, প্যারাগুয়ে, ভেনেজুয়েলা, এল সালভাদর ইত্যাদি দেশের রাষ্ট্রভাষাই হলো স্প্যানিশ। এমনকি কানাডা মরক্কো ফিলিপাইন ও যুক্তরাষ্ট্রেও স্প্যানিশ ভাষার চর্চা হয়। ব্রাজিল, এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু অংশে এবং পর্তুগালে, পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলেন সাড়ে ১৩ কোটিরও কিছু বেশি মানুষ। ফরাসি ভাষায় বিশ্বে প্রায় ১০ কোটি মানুষ কথা বলেন। ফ্রান্স তো বটেই, সুইজারল্যান্ড, জার্মান, বেলজিয়াম, কানাডা, আফ্রিকা, ইতালি দেশের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রায় ফরাসি ভাষা ব্যবহৃত হয়। রোমান ভাষায় কথা বলেন বলকান ও রোমানিয়ার আড়াই কোটি মানুষ। স্পেন নানা দেশে তাদের উপনিবেশ বিস্তার করতে শুরু করার সঙ্গে তাদের ভাষাও ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে আমেরিকার প্রায় সব জায়গায়ই। মাতৃভাষাই সব গোষ্ঠীকে এক জাতিতে একত্রীভ‚ত করে। কবি একদা লিখেছিলেন, ‘মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা...’। আমাদের এই বাংলা ভাষা এমনই এক ঐতিহ্য আছে যা কিনা বৃহৎ এক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলকে আগলে রেখেছে নিজস্ব বনেদিয়ানায়। বস্তুত ভাষাকে মাধ্যম করেই একেকটি অঞ্চল বিশেষে একেকটি জনজাতির সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার ব্যবহার এখন পৃথিবীর এক বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর দ্বারা ব্যবহৃত ভাষা। পৃথিবীর জনসংখ্যার নিরিখে প্রায় ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। বিশে^ বহুল প্রচারিত ভাষাগুলোর মধ্যে সংখ্যানুসারে বাংলা ভাষার স্থান ৫ম। বাংলা ভাষাটি মূলত ইন্দো-আর্য ভাষা। সংস্কৃত পালি ও প্রাকৃত ভাষার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়েছে। খ্রিস্টায় প্রথম সহস্রাব্দের শেষদিকে মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর অপভ্রংশ থেকে যে আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলোর উদ্ভব হয়, তার মধ্যে বাংলা একটি। বাংলা ভাষার ইতিহাস ৩ ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ১. চর্যাপদ (৯০০-১০০০ থেকে ১৪০০ খ্রিস্টাব্দ), ২. মধ্য বাংলা (১৪০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)-এর মধ্যে চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ ধরা হয়। ৩. আধুনিক বাংলা (১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)। তবে ভাষারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। বাংলা ভাষার কথ্য রূপের জেলাভিত্তিক কিছু কিছু প্রভেদ থাকলেও বাংলা ভাষার লিখিত রূপ বিশেষ করে সাহিত্যে, ইতিহাস, সংবাদপত্রে, গান ইত্যাদিতে এই ভাষা ব্যবহারকারীকে বাঙালি বলে পরিচয় দেয়। সমসাময়িক বিশ্লেষণে এটা দেখা যায়, বাংলা ভাষার ঐতিহ্য সম্বন্ধে বাঙালির যে অতীত গৌরব ছিল, তা এখন অনেকখানি ইতিহাসে পরিণত। সমালোচকরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ভাবের ঘরে চুরি করার মতোই এই ‘মহান একুশে’ বা ‘উনিশে মে’ পালন করে সত্যিই কী বাংলা ভাষার ব্যবহার বা প্রয়োগের ব্যবহারিক দিক মসৃণ হচ্ছে। বিভিন্ন সাহিত্যসভা বা সেমিনারে প্রথিতযশা সাহিত্যিককে সংশয় প্রকাশ করতে দেখা যায় বাংলা ভাষাটাই আদৌ ‘মোদের গরব মোদের আশা’ আছে কিনা। গত শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের রফিক, বরকত, আব্দুল, জব্বারের মাতৃভাষার জন্য আহুতি দানকে এতগুলো বছর পরও স্মরণ করে, আবেগ আতিশয্যে প্রতি বছর ‘ভাষা শহীদ দিবস’ পালন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করি শুধু। কতই না উদার কণ্ঠে, সোচ্চারে বা ব্যানার লিখনে, পত্রিকার ক্রোড়পত্রজুড়ে ওই কিছু সময় চলে ‘আ মরি বাংলা ভাষা’র চর্বিতচর্বণ। হয়তো এই আকুল হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই বাংলাদেশেও মাতৃভাষার ব্যবহার সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। চালু হচ্ছে উদ্ভট বাংলা। বাংলা ভাষাটাই যেন কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এখন তো প্রকৃত বাংলার সঙ্গে ইংরেজি ভাষার মিশেল দেখে দেখে, শুনে আমরা এতটাই ধাতস্থ হয়ে গেছি যে এই জগাখিচুরির ব্যাপারে আর কোনো তাপ-উত্তাপ বোধ করি না। এই সর্বনেশে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া মানুষকে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে উন্নততর করলেও মানুষের বাংলা পাঠের অভ্যাসকে গ্রাস করছে। এমন একটা কথাও প্রায়ই ঘুরে ফিরে আসে বাঙালিই নাকি বাংলা ভাষাটাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিচ্ছে। ইংরেজি শিক্ষার মূল্য, কথন ও পঠনপাঠনেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইদানীংকালে বিশেষ করে বাংলা বইয়ের পাঠক সংখ্যা কিন্তু বাড়েনি। যদিও কলকাতা বইমেলার কিছু মানুষ ধুয়ো তোলে তারা এখানে প্রতি বছর কোটি টাকার ব্যবসা করেছে। তবে সেখানে বাংলা বই কত আদৌ বিক্রি হলো, তা জেনেও না জানার মতো ভান করে তারা এ কথা বলেন। তবে বাংলাদেশের ‘একুশের বইমেলার’ ব্যবসা বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ সহস্রাব্দের সূচনায় একুশে ফেব্রুয়ারিকে খাতায় কলমে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ রূপে উদযাপন করার ডাক দিয়েছে। এক যোগে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে, ভাষাপ্রেমী জনগণের কাছে যা প্রভ‚ত তাৎপর্যপূর্ণ। আমরা এই দিনটিকে যথাযথ মর্যাদাসহ পালন করছি নানা উৎসব-অনুষ্ঠান-সেমিনার-বক্তৃতা-কবিতা পাঠের আসর ইত্যাদির স্মরণে-বরণে। কিন্তু উত্তরণের পথ খুঁজি কতটুকু? বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে আমরা এখনো বাংলা ভাষায় ব্যবসায়িক ও দাপ্তরিক কাজ করতে দ্বিধাবোধ করি। আমরা উত্তর প্রজন্মকে শেখাই না শুদ্ধ বাংলায় একটা আবেদনপত্র লিখতে। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা তো বহু দূরের ব্যাপার। এখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে পারে অসম্ভবকে সম্ভব করতে। কীভাবে পারে? এ কথা সত্যি যে বাংলাদেশ আজ অর্থনৈতিক পটভ‚মিকায় ক্রমশ পেছনে ফেলছে ভারতকে। পশ্চিমবঙ্গ বহু ভাষাভাষী ভারতের অংশ। কাজেই তাদের চলতে হবে সর্বভারতীয় ভাষার পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশের ভাষা বাংলা। বাংলাদেশে জীবিকার জন্য আসছেন অনেক ভিনদেশি নাগরিক। ব্যবসায়িক ও দাপ্তরিক কাজ বাংলায় চালু করলে ভিনদেশিদের জীবিকার প্রয়োজনে বাংলা শেখা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। আমরা ইংরেজি শিখব না, তা নয়, অন্যদের বাধ্য করব বাংলা ভাষা শিখতে। নিজের ভাষার প্রসারের জন্য এইটুকু আক্রমণাত্মক হতে বাধা কোথায়? অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App