×

মুক্তচিন্তা

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত চীন বিশ্ব অর্থনীতি সম্ভাব্য হুমকিতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:১৫ পিএম

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে ভেদাভেদ ভুলে চীনের পাশে দাঁড়ানোর উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসা জরুরি। সেটি ঘটলে পিছু হটবে করোনা ভাইরাস, ফিরে আসবে স্বাভাবিক মানুষের জীবন। চীন আবার আগের মতোই কর্মব্যস্ত সচল দেশে পরিণত হবে, যেখানে আগের মতো পৃথিবীর সব দেশের মানুষ যাওয়া-আসা শুরু করবে, ব্যবসা-বাণিজ্য ফিরে আসবে।
অজানা করোনা ভাইরাসে চীন হঠাৎ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। এমনটি আগে কেউ কখনো দেখেনি, ভাবেওনি। পৃথিবীতে এর আগে নানা ভাইরাসের কথা শোনা গেছে, মৃত্যুর খবরও শোনা গেছে। দ্রুতই সেসব অঞ্চলে চিকিৎসার সুযোগ ঘটেছে। আক্রান্ত মানুষ মুক্ত হয়েছে। ছড়াতে পারেনি সেই ভাইরাস পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। ঘটেনি এমন আতঙ্ক যা চীনের করোনা ভাইরাস নিয়ে ঘটেছে। চীন থেকে এখন বিদেশিরা দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু ভাইরাসটি এমনই যে সরে যাওয়ারও উপায় নেই। মানব স্পর্শেই এই ভাইরাস দ্রুত সংক্রমিত হচ্ছে। যদিও এই পর্যন্ত মৃত্যু খুব বেশি ঘটেছে তা বলা যাবে না। আক্রান্তের সংখ্যাও এখনো পর্যন্ত অর্ধ লাখে পৌঁছায়নি। তারপরও পৃথিবীব্যাপী চীনা করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক এতটাই ছড়িয়েছে যে, মানুষ এখন ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ঝুঁকিতে আছে বলে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। কারণ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার খবর যেভাবে প্রচারিত হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে চিকিৎসক, নার্স, নিকটাত্মীয় কেউই স্বাভাবিকভাবে আক্রান্ত রোগীকে নিরাপদে রেখে চিকিৎসা দেয়ার কথা ভাবতে পারছে না। চিকিৎসা দেয়ারও কোনো স্বীকৃত ওষুধ, টিকা বা ব্যবস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত দিতে পারছে না। সে ধরনের চিকিৎসার উদ্ভাবন রাতারাতি ঘটানো সম্ভবও নয়। দিন যতবেশি গড়াচ্ছে করোনা ভাইরাসের বিস্তার ও আতঙ্ক ততবেশি দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। চীন এখন কার্যত করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত দেশ, রুদ্ধ হয়ে পড়া দেশ। গণমাধ্যমের কল্যাণে দেখা যাচ্ছে যে, রাজধানী বেইজিং এখন জনশূন্য হয়ে পড়ছে। আরো কিছু অঞ্চলেও এই রোগের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় মানুষ ঘরবন্দি জীবনযাপন করছে। অথচ চীন দেশটা মোটেও ছোট দেশ নয়, দুর্বল দেশও নয়। কিন্তু সেই পরাক্রমশীল চীন যেন অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই নিজের মধ্যে গুটিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। চীনের অনেক জায়গায় কাজকর্ম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জরুরি কিছু পণ্যসামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য বিশেষ ব্যবস্থায় চলছে। সমগ্র চীনে এমন পরিবেশ ছড়িয়ে পড়লে চীন কতদিন নিজেকে নিজে রক্ষা করতে পারবে সেই দুর্ভাবনাও মানুষকে পেয়ে বসেছে। চীন পৃথিবীর সবচাইতে বেশি জনসংখ্যার দেশ। পৃথিবীর ১৯.৪৮ শতাংশ মানুষ এই দেশে বসবাস করে। দেশটি পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশও। গেøাবার জিডিপির ৯.৩ শতাংশ এই দেশের কৃতিত্ব। সেই দেশে গত কয়েকদিনে করোনা ভাইরাস যেভাবে সুনামির মতো শক্তি নিয়ে হানা দিয়েছে তাতে শুধু চীনই নয় সারা পৃথিবীতেই সুনামির ধাক্কা আসতে শুরু করেছে বলে অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত, এই সময়ে এত বেশি যে সেগুলোর অনেকই ধীরে ধীরে বা দ্রুত বন্ধ হতে চলেছে। উড়োজাহাজ অনেকেই আর চীনমুখী করছে না। চীন থেকে নেয়ারও উড়োজাহাজ তেমন বেশি ভিনদেশে উড়ছে না। হাজার হাজার উড়োজাহাজ এই একটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করলে কত-শত কোম্পানি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, বন্ধ হওয়ার উপক্রম হচ্ছে, আবার লাখ লাখ ব্যবসায়ী ব্যবসা গুটিয়ে নিজ দেশে বা অন্য কোনো দেশে চলে যাচ্ছে যা তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যেও বড় ধরনের বিপর্যয় ঢেকে আনার ব্যবস্থা করছে বললে অত্যুক্তি করা হবে না। অনেক দেশের সঙ্গে চীনের পণ্য সামগ্রীর প্রাত্যহিক বাজার যেভাবে সচল ছিল তা কমে আসতে শুরু করেছে। অনেকেই জাহাজ চীনা বন্দরে নোঙর করতে সাহস পাচ্ছে না। চীনের বাতাস ও মানুষ করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের যে ধারণা সৃষ্টি করেছে তাতে কার সাহস আছে সেই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে চীনে যাতায়াত আগের মতো স্বাভাবিক রাখার। সবার মধ্যেই করোনা ভাইরাসের আতঙ্ক, মৃত্যুর আতঙ্ক! অথচ মৃত্যুর পরিসংখ্যান এখনো এমন নয় যে সবাই এভাবে নিজস্ব নিরাপত্তা নিয়ে সবকিছু গুটিয়ে বসে থাকবেন। কিন্তু থাকতে তো দেখা যাচ্ছে। অনেক দেশেই এখন করোনা ভাইরাসের প্রতিরোধে নানা ধরনের চেকআপ করা হচ্ছে। সর্বত্রই বাড়তি আয়োজন, বাড়তি খরচ, বাড়তি লোকবলের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ চীন থেকে কিছুটা দূরে হলেও আমাদের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী সেখানে অধ্যয়ন করছেন। তাদের অনেকেই এখন সেখানে আটকে পড়ে আছেন। প্রতিদিন তাদের অনেকেই দেশে ফিরে আসার জন্য আহাজারি করছেন। কিন্তু বিমান সংকটের কারণে তাদের আনা যাচ্ছে না। আবার অনেক ব্যবসায়ীও সেখানে রয়ে গেছেন। তারাও বিভিন্ন পথে আসার চেষ্টা করছেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে চীনের সঙ্গে আমাদের গার্মেন্টস পণ্যসামগ্রী নির্ভরশীলতা খুবই বেশি। দীর্ঘদিন এ সমস্যা বিরাজ করলে কিংবা যাতায়াত, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গার্মেন্টস শিল্প বড় ধরনের হুমকিতে পড়তে পারে। লাখ লাখ শ্রমিকের রুটি-রুজি এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। আবার বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স পণ্যসামগ্রী চীনা বাজার থেকে বাংলাদেশে অবাধে সরবরাহ করা হতো। সেটি বন্ধ হয়ে গেলে অসংখ্য ছোট-বড় ব্যবসায়ী বসে যেতে পারেন। চীনের সঙ্গে আমাদের বেশকিছু খাদ্যদ্রব্য কাঁচামাল আমদানি এমনভাবে রয়েছে যেগুলোর ঘাটতি দেশের অভ্যন্তরে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি শুধু করবে না, কর্মসংস্থানেও বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। বিষয়টি শুধু বাংলাদেশ চীনের ব্যাপার নয়। অন্যান্য দেশের সঙ্গেও চীনের বাণিজ্য আষ্টেপৃষ্ঠে এভাবেই জড়িয়ে আছে। সেটির ভবিষ্যৎ কী হবে তা কেউ এখনই বলতে পারছে না। তবে সময়টি যদি বেশি নেয়া হয়, করোনা ভাইরাস যদি আরো দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে শুধু চীনই নয় অন্যান্য দেশও এই রোগের প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। যদি দেশটি চীন না হয়ে ছোটখাটো কোনো দেশ হতো তাহলে বিশ্ব অর্থনীতিতে এতটা প্রভাব নাও পড়তে পারত। যেহেতু দেশটি চীন, তাই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের চাইতেও অর্থনীতির সংকট অধিকতরও দ্রুত সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে যাচ্ছে। সে কারণে অনেক দেশেই নানা দুর্ভাবনা সংশ্লিষ্ট মহলগুলোর ভেতরে শুরু হয়েছে। করোনা ভাইরাস একটি রোগ, এর আতঙ্ক সংক্রমণের, তাতে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু এই রোগের কারণে চীন যেভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে তাতে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে। চীনের সঙ্গে যুক্ত পৃথিবীর প্রায় সব ছোট-বড় দেশও অর্থনৈতিক সংকটে সংক্রমিত হতে যাচ্ছে এটি বড় বিপদের কথা। সম্ভবত নিকট অতীতে অর্থনৈতিক কোনো সংকটই পৃথিবীকে এতটা আতঙ্কিত করেনি যতটা করোনা ভাইরাসের কারণে এই মুহূর্তে বিশ্ব অর্থনীতি আঁতকে ওঠার মতো পর্যায়ে যেতে বসেছে। তবে বিশ্ব সংস্থা যত দ্রুত নিজেদের মধ্যকার দ্ব›দ্ব সংঘাত প্রতিযোগিতা, ‘বাণিজ্য-যুদ্ধ’ একপাশে টেলে রেখে যদি করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে যে সংকটের দুর্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে সেটি মোকাবিলায় সব প্রজ্ঞাবান মানুষ আত্মনিয়োগ করেন, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ ও পরিষেবা দ্রুত নিয়ে আসতে পারেন, একই সঙ্গে নিজেদের মধ্যকার বিভেদ ভুলে আর্তমানবতার সেবায় হাতে হাত রেখে এগিয়ে আসেন, তাহলে এই ভাইরাস বেশিদিন টিকে থাকার কথা নয়, এই সংকটও স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাবে না। সুতরাং পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোকে ভেদাভেদ ভুলে চীনের পাশে দাঁড়ানোর উদ্ভাবনী চিন্তা নিয়ে এগিয়ে আসা জরুরি। সেটি ঘটলে পিছু হটবে করোনা ভাইরাস, ফিরে আসবে স্বাভাবিক মানুষের জীবন। চীন আবার আগের মতোই কর্মব্যস্ত সচল দেশে পরিণত হবে, যেখানে আগের মতো পৃথিবীর সব দেশের মানুষ যাওয়া-আসা শুরু করবে, ব্যবসা-বাণিজ্য ফিরে আসবে। তাতে পৃথিবী বড় ধরনের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক সংকট থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হবে। এখন সেই চেষ্টাই বিশ্ব নেতাদের, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার করা দরকার। মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী : অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত), ইতিহাসবিদ ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App