×

মুক্তচিন্তা

বাংলা ভাষার শত্রু-মিত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:৫১ পিএম

একুশে ফেব্রুয়ারি তারুণ্য এবং বার্ধক্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। তারুণ্য এখানে বয়সের নাম নয়, তারুণ্য এখানে শক্তির নাম। আর তারুণ্যের গুণ যে সৃজনশীলতা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই গুণে গুণান্বিত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা দুঃসাহস দেখেছি মানুষের, দুঃসাহস দেখেছি তারুণ্যের। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা সৃজনশীলতা দেখেছি তারুণ্যের। সেইজন্য তারুণ্যের চিহ্নে একে চিহ্নিত করতে চাই।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে কি ঘটেছিল আমরা সবাই তা জানি। সেদিন যে আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনকে আমরা ভাষা আন্দোলন বলি। এবং সেই যে আন্দোলন হয়েছিল তা কোনো দুর্ঘটনার জন্য হয়নি, কারো ব্যক্তিগত ভুলের জন্য ঘটেনি। কেননা আন্দোলন অনিবার্য ছিল, আন্দোলন শাসক এবং শাসিতের মধ্যে যে দ্ব›দ্ব সেই দ্ব›েদ্বর একটা প্রকাশ। এটাও আমরা জানি। কিন্তু আমরা যখন একে ভাষা আন্দোলন বলি তখন এ কথা তো ভুলি না যে, ভাষার যতই মূল্য থাকুক ভাষা শেষ পর্যন্ত চিহ্ন মাত্র এবং যারা ভাষা ব্যবহার করে তাদের ওপরই ভাষার উৎকর্ষ নির্ভর করে। ভাষার জন্য আন্দোলন তো আসলে জীবনের বিকাশের জন্যই আন্দোলন ছিল। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি লাভ করেছে তখনো এ আন্দোলন থেমে যায়নি। আমরা এও জানি যে, যখন একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তখনো এ আন্দোলন থামেনি, এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বাঙালি জাতিসত্তার উপরে যে নিপীড়ন চলছিল, সে নিপীড়ন থেকে মুক্তির আন্দোলনে পর্যবসিত হয়েছিল এবং সেই আন্দোলনের পথ ধরেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। কিন্তু আজকেরও স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে একটা নতুন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পরেও, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে তাৎপর্যপূর্ণ, একুশে ফেব্রুয়ারি আজকেও আমাদের কাছে আবেদন জানায়, আজকেও আমাদের ডাকে, আমাদের মনে এক অনুভ‚তির সৃষ্টি করে। কেন করে? সে কি শুধু এই কারণেই করে যে, বাংলা ভাষা শিক্ষার সর্বস্তরের প্রযুক্ত হয়নি? সে কি শুধু এই কারণেই করে যে বাংলা ভাষা সরকারি সব কার্যে ব্যবহৃত হচ্ছে না? মনে হয় তার চাইতেও বড় তাৎপর্য এখানে আছে। সে হচ্ছে একুশে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ছিল শাসক শ্রেণির নিপীড়নের বিরুদ্ধে এবং সে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের নিপীড়নবিরোধী যে চেতনা তার প্রকাশ লাভ করেছিল। সে জন্যই নিপীড়ন যতদিন আছে, নিষ্পেষণ যতদিন থাকছে, অন্যায় যতদিন চলবে, ততদিন তো মনে হয় একুশে ফেব্রুয়ারি তাৎপর্যপূর্ণ দিন হিসেবে থাকবে। একুশে ফেব্রুয়ারি আন্দোলন মধ্যবিত্ত তরুণরা করেছিলেন। কিন্তু আন্দোলনের মূল শক্তি কোথা থেকে এসেছিল? আন্দোলন যতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, যতদিন রমনা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল, ততদিন প্রবল ছিল না। একুশে ফেব্রুয়ারির সেই গুলি চালনার দিনে যখন এই আন্দোলন রমনা পার হয়ে পুরান ঢাকায় এসে পৌঁছেছিল, যখন পুরান ঢাকা পার হয়ে সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেল, যখন এই আন্দোলনে কৃষকের বিক্ষোভ যুক্ত হলো, শ্রমিক অসন্তোষ এর সঙ্গে মিশে গেল, যখন রিকশাওয়ালা এসে যোগ দিল, যখন নিম্ন মধ্যবিত্ত এর সঙ্গে যুক্ত হলো তখনই সে অত্যন্ত প্রবল হলো। দুর্দমনীয় হয়ে উঠল। এর আগে পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা একবার আন্দোলন করেছিলেন বেতনের জন্য, ’৫২ সালের আগেই, কিন্তু সে আন্দোলন সামাজিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি এবং সমস্ত বাংলাদেশ ছড়িয়েও যায়নি। কেন যায়নি? পুলিশদের ওপর কম নির্যাতন হয়নি, পুলিশদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। আন্দোলন বিস্তৃত হলো না এই জন্য যে তা সীমাবদ্ধ ছিল সরকরি কর্মচারীর একাংশের মধ্যে। এবং এই যে একুশের আন্দোলন এত প্রবল হলো, দুর্দমনীয় হলো, সে যে এতদূর এগিয়ে এলো তার কারণ হচ্ছে এর সঙ্গে পূর্ববঙ্গের সব মানুষের বিক্ষোভ জড়িত ছিল। আমরা যদি আজকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে দাঁড়িয়ে আমাদের পুরনো ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব একুশে ফেব্রুয়ারির এই যাত্রাপথ ধরে নতুন সংগঠন গড়ে উঠেছে। নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, সে আমরা জানি। এর সামাজিক প্রতিক্রিয়া প্রবল হয়েছে, সেও আমরা জানি। কিন্তু এককভাবে এদের কোনোটাই একুশের একক অবদান নয়। একুশের মূল সৃষ্টি যদি চিহ্নিত করতে হয় তাহলে বলতে হবে, একুশে ফেব্রুয়ারি একটি চেতনার নাম। এবং সে চেতনাকে যদি চিহ্নিত করতে চাই, তবে তার পরিচয় দিতে হবে কতগুলো লক্ষণ দ্বারা সে ছিল ইহজাগতিক, ছিল গণতান্ত্রিক, সে চেতনা ছিল অন্যায়বিরোধী, বিদ্রোহী। এবং সর্বোপরি সে ছিল সৃজনশীল। এই যে ইহজাগতিকতা, গণতান্ত্রিকতার, এই যে বিদ্রোহের চেতনা, এই যে সৃজনশীলতা এর সমস্ত কিছুকে একত্র করেই একুশের পরিচয়। এতকাল আমাদের অনুভ‚তিগুলো নানা প্রকার আধ্যাত্মিক পথে বিচারণ করত। ধর্ম ছিল আমাদের একটা বড় সাংস্কৃতিক উপাদান। সেইখানে ভাষা এসে আমাদের বস্তুজগৎ ও চারদিকের পরিবেশ পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন করল। এবং যে গণতান্ত্রিক চেতনা এলো সেটা অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আগে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভাগাভাগি ছিল। হিন্দু সম্প্রদায় এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠানগুলো আলাদা, প্রতিষ্ঠানগুলো আলাদা এবং তারা আলাদা আলাদা থাকতেন। একুশে ফেব্রুয়ারি সম্প্রদায়িক ভিত্তিকে ভেঙে দিল। সব মানুষের গণতান্ত্রিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করল। একুশে ফেব্রুয়ারি অন্যায়ের, শোষণের এবং নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল! এই সমস্ত কিছুকে, এই ইহজাগতিকতাকে, গণতান্ত্রিকতাকে, বিদ্রোহকে সম্মিলিত করে সে একটা নতুন সৃজনশীলতার জন্ম দিল। সেই সৃজনশীলতার পথ ধরেই আমরা দেখেছি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ওই পথেই আমরা দেখেছি যে আমরা আরো এগুতে পারছি, একটা নতুন সমাজব্যবস্থা চাচ্ছি, একটা নতুন পৃথিবী গড়ে তুলতে যাচ্ছি। কাজেই একুশের প্রধান সৃষ্টি কোনো সংগঠন নয়, কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। কোনো একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে আমরা তাকে দেখব না। সে একটা নতুন চেতনার সৃষ্টি করেছিল। সেই চেতনা সৃষ্টিমুখর। একুশে ফেব্রুয়ারি আরো একটা কাজ করেছে, সে হচ্ছে এই যে, সে একটা বিভাজনের রেখা আমাদের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। বিভাজনটা হচ্ছে আলোর সঙ্গে অন্ধকারের বিভাজন। এ হচ্ছে তারুণ্যের সঙ্গে বার্ধক্যের, প্রগতির সঙ্গে প্রতিক্রিয়ার-বিভাজন। এবং সেইখানে দাঁড়িয়ে আলো এবং অন্ধকার, তারুণ্য এবং বার্ধক্য, প্রগতি এবং প্রতিক্রিয়া আলাদা হয়ে গেছে একুশের মানদণ্ডে । একুশে ফেব্রুয়ারিতারুণ্য এবং বার্ধক্যকে আলাদা করে চিহ্নিত করে। তারুণ্য এখানে বয়সের নাম নয়, তারুণ্য এখানে শক্তির নাম। আর তারুণ্যের গুণ যে সৃজনশীলতা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই গুণে গুণান্বিত। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা দুঃসাহস দেখেছি মানুষের, দুঃসাহস দেখেছি তারুণ্যের। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা সৃজনশীলতা দেখেছি তারুণ্যের। সেইজন্য তারুণ্যের চিহ্নে একে চিহ্নিত করতে চাই। এবং আমরা তখনই দুঃসাহসী হই, যখন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, যেমন আমরা ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় দেখেছি। আমরা যখন আলাদা, বিচ্ছিন্ন, যখন পরস্পর পরস্পরের শত্রু, তখন আমরা সবাই ভীরু, তখন সবাই সন্ত্রস্ত। যখন আমরা সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে পারি, যখন আমরা এক হতে পারি, যখন আমাদের চেতনা একসঙ্গে গ্রথিত হয়, তখনই আমরা দুঃসাহসী হয়ে উঠি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সেই দুঃসাহসকে আমরা দেখেছি। কাজেই আবার আমরা দুঃসাহসী হতে পারব, যখন আমরা সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারব। একুশে ফেব্রুয়ারি একটা প্রশ্ন রাখে আমাদের সবার সামনে। সেটা হলো আমরা কে কোন পক্ষে। আলোর, নাকি অন্ধকারের? যদি আলোর পক্ষ হই তাহলে কি আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি? দায়িত্ব পালন না করলে দেশ কেমন করে এগুবে। প্রশ্নটা শুরুতে ছিল, এখনো আছে, থাকবে আগামীকালও। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App