×

বিনোদন

ভালোবাসা বাঁচে বন্ধুত্বে...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:২৮ পিএম

ভালোবাসা বাঁচে বন্ধুত্বে...

বন্ধুত্ব ও ভালোবাসায় এখনো রঙিন ফারজানা ছবি ও তন্ময় সরকার। ছবি: ভোরের কাগজ।

ভালোবাসা বাঁচে বন্ধুত্বে...

দুই সন্তান অভিরূপ ও অনির্বাণকে নিয়েই অভিনেত্রী ফারজানা ছবি ও প্রফেসর তন্ময় সরকারের ভালোবাসার নীড়।

ঢাকা কমার্স কলেজের টিচার্স কোয়ার্টার। এর ১১তলায় থাকেন ফারজানা ছবি-তন্ময় দম্পতি। এই দম্পতির ভালোবাসার ঘটনা শুনতেই তাদের ফ্ল্যাটে যাওয়া। গেটে দাঁড়ানো সিকিউরিটি গার্ডের রাখা খাতায় নাম, ঠিকানা টুকে ১১তলায় পৌঁছাতেই দেখা গেল, দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন ফারজানা ছবি। কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে করতেই গৃহে প্রবেশ। ড্রইং রুমের সোফায় বসতে বলে ছবি ভেতরে গেলেন স্বামী তন্ময়কে ডাকতে। ডেকে এসেই তিনি বসলেন পাশের সোফায়। এই সুযোগে জানতে চাওয়া প্রেমিক তন্ময় সম্পর্কে!

ফারজানা ছবি নিজের ভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের সম্পর্কটা আর দশটা সম্পর্কের মতো নয়। একেবারেই আলাদা। আমরা ভেবে, পরিকল্পনা করে প্রেম করিনি। আমরা একসঙ্গে পড়াশুনা করেছি কমার্স কলেজে। সেই সূত্রে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সেই বন্ধুত্ব থেকে ধীরে ধীরে একটা বিশ্বাস, আস্থা, সম্মান থেকে আমরা বুঝতে পারলাম দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারব না। ঠিক তখন আমরা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে বিয়ে করি।’

ছবির কথা চলাকালেই ড্রইং রুমে এসে উপস্থিত হলেন তার স্বামী তন্ময় সরকার। ছবির কথা শেষ হতেই তন্ময় সরকারের কাছে জানতে চাইলাম, আপনি কখন মনে করলেন, ছবির প্রেমে পড়েছেন?

হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘ছবি আর আমি একই ডিপার্টমেন্টে পড়েছি। দুজনই নিজ নিজ অবস্থানে থাকতাম। গায়ে পড়ে বন্ধুত্ব করতে যাই নি কেউ-ই। ছবি অভিনয় করে, সুপরিচিত। আর আমি মফস্বলের একটা ছেলে, সে জায়গা থেকেও একটা সংকোচবোধ জন্মেছিল। যার ফলে কথা বলা হয়নি প্রথম দিকে। ছবি ভালো নোটস লিখতে পারে, সুতরাং পড়াশুনার সুবাদে আমাদের মধ্যে চেনাজানা, পরিচয় হলো। তো একদিন আমরা শিক্ষা সফরে নেপাল, দার্জিলিং ও কলকাতায় ট্যুরে গেলাম। সেখান থেকে ফেরার পথে কেমন যেনো একটা অনুভ‚তি তৈরি হতে লাগল! আমরা দুজন দুদিকে চলে যাবো, আর কি দেখা হবে? ঠিক তখন বুঝতে পারলাম আমাদের দুজনকে একসঙ্গে থাকা প্রয়োজন। এর আগে তথাকথিত প্রেম বা আমি তোমাকে ভালোবাসি ধরনের কোনো অনুভ‚তি হওয়া কিংবা কথাটা বলা হয়নি।’

[caption id="attachment_200992" align="aligncenter" width="666"] দুই সন্তান অভিরূপ ও অনির্বাণকে নিয়েই অভিনেত্রী ফারজানা ছবি ও প্রফেসর তন্ময় সরকারের ভালোবাসার নীড়।[/caption]

গতানুগতিক প্রেমের বাইরে যে সম্পর্ক গড়ে উঠে তার গভীরে প্রবেশ করার লোভ নিয়ে ফারজানা ছবির কাছে জানতে চাইলাম, কখনো কি আপনারা দুজনকে কেউ কিছু উপহার দিয়ে ভালোবাসার কথা বলেননি? সরলভাবেই ছবি জানালেন, ‘না। ভালোবাসি এ কথাটা আমাদের কেউ তখনো বলিনি। তবে তন্ময় আমাকে আংটি কিনে উপহার দিয়েছিল। তার একটি ঘটনাও রয়েছে। কলকাতায় যখন আমার গেলাম সেখানে তন্ময়ের একজোড়া জুতো পছন্দ হয়। কিন্তু তখন সে জুতো না কিনে আমরা দার্জিলিং চলে যাই। তন্ময় চেয়েছিল সেখান থেকে ফেরার পথে জুতো জোড়া কিনবে। দার্জিলিং গিয়ে আমার একজোড়া আংটি পছন্দ হলো। কিন্তু আমার কাছে তখন আংটি কেনার অত টাকা ছিল না। কিন্তু তন্ময় তার জুতো কেনার জন্য যে টাকা রেখেছিল সে টাকা দিয়ে আমার জন্য আংটিজোড়া কেনে। আমার গানের প্রতি ঝোঁক ছিল তাই সে ‘হিমালয়মন্ত্র ও ‘ভাদরা’ নামে দুটি গানের ডিস্কও কেনে। এ কথা তন্ময় তখন আমাকে জানায়নি। যার ফলে তন্ময়ের কাছে যে টাকা ছিল তা শেষ হয়ে যায়। ফেরার পথে দেখলাম তন্ময় তার পছদের জুতো জোড়া কিনছে না। তখন আমার কাছে যে টাকা ছিল তা দিয়ে তার জন্য জুতো জোড়া কিনি। পরবর্তীতে দেশে ফিরে তন্ময় আমার জন্মদিনে আংটি জোড়া ও গানের ডিস্ক দুটো যখন উপহার দিল তখন বুঝলাম কেন তার কাছে তখন টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনার অনুভূতিটুকু বলে কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়।’

এ কথা শেষ হতে না হতেই পাশ থেকে তন্ময় বললেন, ‘আমাদের সেই ট্যুরের একটি ঘটনা আছে যা আমার এখনো মনে গেঁথে আছে। ২০০১ সাল। আমরা তখন নেপালে। সেখানে তখন মাওবাদীদের ব্যাপক প্রভাব। আমরা সকলে মিলে ক্যাম্পফায়ার করছি। এমন সময় ছবি বলে উঠলো আমার ক্যামেরার রিল শেষ! আমাদের মধ্যে দুজনের ক্যামেরা ছিল। ছবির আবার ছবি তোলার খুব শখ। তো অপর জনের কাছে রিল আছে কিনা জানতে চাইলে জানালো আছে, কিন্তু দিবে না। তাহলে কি করা যায় এখন? এত রাত, কোথায় রিল পাওয়া যাবে? হোটেল বয়ের কাছে জানতে চাইলে সে জানালো একটা জায়গায় হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তবে পথে রিস্ক আছে অনেক! আমি তাকে বললাম যত রিস্ক থাকুক আমার রিল প্রয়োজন। পরে সেই ছেলেকে নিয়ে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। ঘণ্টাখানেক নিচের দিকে নামার পর একটি দোকান পেলাম যেখানে রিল আছে। পথে মাওবাদীদের ভয় নিয়ে ছবির জন্য রিল জোগাড় করার এ ঘটনাটি এখনো নস্টালজিক করে তোলে।’

স্বামীর এ কথার সূত্র ধরে ছবি জানালেন স্বামীর তার ও তার পরিবারের প্রতি দায়িত্বশীলতার কথা। বললেন, ‘তন্ময় আমার যতটা না বন্ধু ছিল তার চেয়ে বেশি বন্ধু হয়ে উঠেছিল আমার মায়ের। তন্ময়ের স্মৃতিময় কথা বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস ও দায়িত্বশীলতা কত গভীরে প্রোথিত তা পুরোপুরি না হলেও খানিকটা আঁচ করতে পারছি।’

এবার কোনো স্মৃতিময় ঘটনার কথা স্মরণ করে ছবি বললেন, ‘স্মৃতিময় ঘটনা অনেক রয়েছে। এখন কোনটা রেখে কোনটা বলব! কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ একটা ঘটনার কথা এই মুহূর্তেই মনে পড়ল। সেটা হলো আমি একবার শুটিংয়ে লালমনিরহাট যাই। যাওয়ার আগে তন্ময়ের সঙ্গে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়। যার ফলে আমি যাওয়ার সময় সে কথা বলেনি। কিন্তু যে বিষয়টা এখনো আমার হৃদয়ে থেকে গেছে তা হলো, আমি যখন শুটিং থেকে ফিরলাম, কল্যাণপুরে আমাদের ইউনিটের গাড়ি থেকে নামলাম। তখন শুনসান বাস স্টেশনে একটা মানুষ দাঁড়িয়েছিল। সেটা হলো তন্ময়। রাত তখন মধ্য রাত হবে। তন্ময় জানতো ওইদিন আমরা ফিরব কিন্তু কখন ফিরব জানত না। ফলে সে সারা রাত স্টেশনে আমার জন্য অপেক্ষা করেছে।’

ফারজানা ছবির দায়িত্বশীল, আস্থাভাজন বন্ধু তন্ময় সরকার। বারবার তার কথাগুলোতে সে ইঙ্গিতই লক্ষণীয়। কিন্তু তন্ময় সরকারের কাছে কম আস্থার, নির্ভরশীলতার নন ছবি সে কথা বলতে ভুলে যান নি তন্ময়। বললেন, ‘ছবি খুব ভালো নোটস লিখতে পারে। আমরা যখন একসঙ্গে পড়াশুনা করি তখন ছবির নোটস নিয়েই আমি পড়াশুনা করতাম। পরীক্ষায় আমি ভালো রেজাল্ট করতাম। ছবির হাতের লেখার জন্য সে আমার থেকে কম নম্বর পেতো। এই যে ছাত্রাবস্থায় ছবির প্রতি আমার নির্ভর করার ব্যাপার, এটাও আমাদের একসঙ্গে থাকার অন্যতম কারণ।’

ভালোবাসা দিবসের সে সময়ের কথা জানতে চেয়ে ফারজানা ছবির কাছে প্রশ্ন করলাম, বসন্তে কিংবা ভালোবাসা দিবসে তন্ময় আপনাকে কী উপহার দেয়? একটু মুচকি হেসে ছবি জবাব দিলেন, ‘তন্ময় আমাকে বসন্তে বা ভালোবাসা দিবসে এমন কিছু উপহার দেয় যা এই দিবসকে কেন্দ্র করে থাকে না। যেমন কিছুদিন আগে তন্ময় আমাকে একটা নাক ফুল উপহার দিয়েছে। যেটা পরবর্তীতে একটা শুটিংয়ের কাজে লেগেছে। অর্থাৎ সে এমন কিছু উপহার দেয় যেগুলো একবার ব্যবহারের পর অকেজো হয়ে না যায়। আমিও তন্ময়কে কিছু দেয়ার সময় সে কথা ভাবেই উপহার দেই যাতে সেটা তার পরে কাজে লাগে। যেহেতু তন্ময় শিক্ষক তাই কিছু দিলে সেভাবে দেই। আর তন্ময় কোনো কিছু একা একা কিনে আমাকে সারপ্রাইজ দিতে পারে না। আমাকে কোনো কিছু দিতে ইচ্ছে হলেই বলবে, ছবি চলো শাড়িটা কিনে আনি, ওটা কিনে আনি!’

বন্ধুত্বের মাঝে গড়ে উঠা প্রেম! শুনতে শুনতে নস্টালজিক একটা পরিবেশে মধ্যে ঢুকে যাওয়া। তাই তন্ময় সরকারকে প্রশ্ন করলাম, দুটি আলাদা ধর্মের হয়েও আপনারা কিভাবে চ‚ড়ান্ত একটি সিদ্ধান্ত নিলেন এবং আপনাদের পরিবার মেনে নিয়ে আপনাদের বিয়ে দিলেন? তন্ময় খুব গর্বিত হয়েই বললেন, ‘১৪ বছর প্রেমের পর আমাদের বিয়ে। বিয়ের পেছনে পুরো কৃতিত্ব ছবির মায়ের এবং ছবির বড় বোন ও তার স্বামী ফরিদ ভাইয়ের। আমরা যখন তাদের কাছে আমাদের প্রস্তাব জানালাম তখন তারা আমাদের সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দিয়েছে। আমার পরিবারের সঙ্গে ছবির পরিবার কথা বলে বুঝিয়েছে। আর এই যে বললেন দুই ধর্ম! আপনি বিষয়টি জানতে চাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের মনেই ছিল না আমরা আলাদা ধর্মে বেড়ে উঠেছি।’

এর সঙ্গে সঙ্গেই ছবি বললেন, ‘আমার মা হজ করেছেন। আমাদের বিয়ে নিয়ে মা কখনো ধর্মীয় গোঁড়ামি দেখাননি। বরং উনি আমাদের বিয়েতে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছেন। আসলে প্রেম তো হয় দুজন মানুষের কিন্তু বিয়েটা হয় দুটি পরিবারের। তাই তন্ময়, আমি চেয়েছি পরিবারকে নিয়ে আমাদের সম্পর্কটা গড়তে, পেরেছিও তাই। ধর্ম নিয়ে আমাদের কোনো বাড়াবাড়ি ছিল না এখনো নেই। আমি মানুষ হিসেবে তন্ময়কে চেয়েছি, সেও তাই চেয়েছে। ফলে আলাদা ধর্ম এ বিষয়টা নিয়ে ভাবি না।’

সংসার জীবনে ঝগড়া-কলহ নানা বিষয় থাকে। কিন্তু ফারজানা ছবি ও তন্ময় সরকারের জীবনের ঝগড়াও যেন প্রেম দিয়ে গড়া। এ বিষয়ে ছবি বলেন, ‘সংসারে ঝগড়া, রাগারাগি, মান-অভিমান থাকেই। কিন্তু তন্ময়ের সঙ্গে আমার যে ঝগড়া বা মান-অভিমান হয় তাও অন্য রকম। তন্ময়ের ওপর আমি রাগ করি সে আমার কথা কেন বুঝে না। তন্ময়েরও আমার উপরে এ নিয়ে রাগ। কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে আমরা কোনো চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব তেমন কিছু এখন পর্যন্ত ঘটেনি। আশাকরি ভবিষ্যতেও ঘটবে না। এ সময় তন্ময় বলেন, আপনারা দোয়া করবেন যাতে আমরা সারা জীবন এভাবেই একসঙ্গে কাটাতে পারি।’

দুটি সন্তান অভিরূপ ও অনির্বাণকে নিয়েই অভিনেত্রী ফারজানা ছবি ও প্রফেসর তন্ময় সরকারের ছোট্ট ভালোবাসার নীড়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App