×

মুক্তচিন্তা

সাংগঠনিক ‘দুর্বলতা’ কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে আওয়ামী লীগ?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:১৩ পিএম

আওয়ামী লীগ যদি নিজের সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে তাহলে সেটা দেশের রাজনীতির জন্যই একটি ইতিবাচক বিষয় হবে। কার্পেটের নিচে ময়লা ঢেকে রেখে পরিচ্ছন্ন থাকার অভিনয় করা ভালো লক্ষণ নয়। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বড় দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই দলের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই দলের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও বেশি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভোটের রাজনীতির প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। তিনি মনে করেন, রাজনীতির প্রতি মানুষের আগ্রহ আরো বেশি থাকা উচিত। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়া প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের আরো বলেছেন, আওয়ামী লীগের এত জনসমর্থন, সেখানে আরো ভোট আশা করেছিলাম। আওয়ামী লীগের যে ভোটের হার, সে তুলনায় উপস্থিতির হার আশানুরূপ নয়। ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ক. দুই-তিন দিন ছুটি থাকার কারণে অনেকে ঢাকার বাইরে গেছেন, খ. পরিবহন সংকট এবং গ. আগেভাগে শঙ্কা তৈরি। তারপরও তিনি মনে করেন, ‘একটি ভালো নির্বাচন হয়েছে’। ঢাকা সিটি নির্বাচন তার কাছে কোনো কোনো কারণে ‘ভালো’ মনে হয়েছে তা তিনি বলেননি। বললেও গণমাধ্যমে আসেনি। নির্বাচনে বড় ধরনের সন্ত্রাস-সহিংসতা না হলেই তাকে ভালো নির্বাচন বলা যায় না। ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্ভয়ে উপস্থিত হয়ে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে না পারলে তাকে ভালো নির্বাচন বলা যায় না। আওয়ামী লীগের ভোটাররাও ভোটকেন্দ্রে না যাওয়াটা দলের সাধারণ সম্পাদক স্বাভাবিক বলে মনে করেননি। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ‘দুর্বলতা’র কথাও তিনি পরোক্ষভাবে স্বীকার করে করেছেন। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য অবিলম্বে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক করার কথাও তিনি জানিয়েছেন। ভবিষ্যতে ভোটারদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করার জন্য সংগঠন শক্তিশালী করা দরকার বলেও ওবায়দুল কাদের উল্লেখ করেছেন। এগুলো অবশ্য আশার কথা। আওয়ামী লীগ যদি নিজের সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে তাহলে সেটা দেশের রাজনীতির জন্যই একটি ইতিবাচক বিষয় হবে। কার্পেটের নিচে ময়লা ঢেকে রেখে পরিচ্ছন্ন থাকার অভিনয় করা ভালো লক্ষণ নয়। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে প্রাচীন এবং বড় দল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এই দলের নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়েছে। এই দলের কাছে মানুষের প্রত্যাশাও বেশি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এখন ক্ষমতায়। একদিকে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার ইতিহাস যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি দলের মধ্যে কিছু সমস্যাও দেখা দিয়েছে। দলের মধ্যে দ্ব›দ্ব-কলহ আছে সব পর্যায়ে। শেখ হাসিনার ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতার কারণে দলের অনেকের মধ্যে এক ধরনের সুবিধাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দলের নাম ব্যবহার করে অন্যায়-অপকর্ম করার প্রবণতাও বেড়েছে। শেখ হাসিনা তার দক্ষতা, যোগ্যতা এবং উদারতা দিয়ে সব সংকট থেকে দলকে এবং দলের নেতাকর্মীদের ত্রাতা হিসেবে উদ্ধার করবেন বলে যে বিশ্বাস অনেকের মধ্যে তৈরি হয়েছে তা আওয়ামী লীগের জন্য এখন এক বড় দুর্বলতা। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মোহমুক্ত হতে হবে। না হলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। দলের সাধারণ সম্পাদক যেহেতু সাংগঠনিক দুর্বলতার বিষয়টি উপলব্ধি করেছেন সেহেতু এর সমাধানের উদ্যোগও হয়তো দেখা যাবে।

দুই. ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলে অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটেনি। ঢাকা উত্তরে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম। দক্ষিণে শেখ ফজলে নূর তাপস। বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে লড়ে পরাজয় বরণ করেছেন উত্তরে তাবিথ আওয়াল এবং দক্ষিণে ইশরাক হোসেন। এখন যে যাই বলুক না কেন, নির্বাচন নিয়ে প্রকৃত অর্থে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তেমন আগ্রহ তৈরি করা যায়নি। নির্বাচনী প্রচারণায় সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল না বললেই চলে। বাংলাদেশে নির্বাচন মানেই উৎসব। অথচ সিটি নির্বাচনে কোনো স্বতঃস্ফ‚র্ততা ছিল না কারো মধ্যেই। তাছাড়া এক প্রকার খামখেয়ালিপনা লক্ষ করা গেছে নির্বাচনসংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে। নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি নির্বাচনে কার কী আচরণ বা ভ‚মিকা হবে, সেটা ছিল অনেকটা পূর্বনির্ধারিত। নির্বাচনের আগে একাধিক লেখায় বলেছিলাম যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচন করছে জয়ের জন্য। আর বিএনপির লক্ষ্য নির্বাচনকে বিতর্কিত করা, বিজয় অর্জন নয়। দুই দলেরই টার্গেট পূরণ হয়েছে। আওয়ামী লীগ জয় পেয়েছে। বিএনপি পরাজিত হয়ে প্রমাণ করেছে ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি’। নির্বাচন-বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ভোটারের কম উপস্থিতি। এই যে ভোট দিতে মানুষের আগ্রহ কমে গেল, তার জন্য দায়ী কে বা কী, তা খুঁজে বের করা দরকার। ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা একদিনে কমেনি। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে, অনেক আত্মদান, রক্তদানের পর আমরা দেশে গণতন্ত্র কায়েম করলেও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও সংহত করার ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য নেই। বরং দিন দিন আমরা এক জটিল অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলো জনমতের প্রতিফলন ঘটিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার চেয়ে কৌশলের খেলায় মেতে উঠেছে। বিএনপি যেহেতু অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অর্থাৎ হত্যা-সন্ত্রাস-সহিংসতার মাধ্যমে সরকারকে নাকাল-নাজেহাল করতে চায় সেহেতু সরকার তথা আওয়ামী লীগও বিএনপিকে দাবিয়ে রাখতে শক্তি প্রয়োগের কৌশল নিয়ে অগ্রসর হয়। ক্ষমতায় না থাকলে লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়, তাই ক্ষমতায় থাকার জন্য নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন ব্যবস্থার আশ্রয় নিতে দ্বিধা করা হচ্ছে না। অবাধ নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ জিতবে না ক্রমাগত এই প্রচারণা আওয়ামী লীগকে অবাধ নির্বাচনের ব্যাপারে সন্দিহান করে তুলেছে। আওয়ামী লীগ এবং তার সমর্থকরা মনে করেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশে মৌলবাদ-ধর্মীয় উগ্রবাদের বিকাশ ঘটবে। বিএনপি-জামায়াতের অতীত শাসন এই ধারণার পক্ষে রায় দেয়। দেশকে সন্ত্রাসবাদ-জঙ্গিবাদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা দরকার এটা বাইরের দুনিয়ার অনেক দেশও মনে করে বলেই আওয়ামী লীগ তার পছন্দমতো ভোট ব্যবস্থা চালু করেও এক ধরনের মার্জনা পেয়ে যাচ্ছে। বিএনপি সময় ও পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে চলতে পারছে না। তাই জয়ের বন্দরে পৌঁছতে গেলে বিএনপিকে তার রাজনীতি বদলাতে হবে। জামায়াতের প্রশ্নে প্রকাশ্যে অবস্থান পরিবর্তন করতে হবে। নয়েও আছি, ছয়েও আছি করে বাংলাদেশের কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করা গেলেও জঙ্গিবাদ নিয়ে আতঙ্কিত বিশ্বসম্প্রদায়কে আশ্বস্ত করা যাবে না। যারা নির্বাচনের ফল অন্য কিছু ভেবেছিলেন, তাদের অবস্থান বাস্তবতা থেকে দূরে। যারা সরকার ও সরকারি দলের রাজনৈতিক কৌশল ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করেন তাদের এটা অজানা নয় যে, আওয়ামী লীগ এখনই পরাজিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। আবার বিএনপির ভেতর-বাহির যারা জানেন, তাদেরও অজানা নয় যে, বিএনপি যতই জনপ্রিয়তার বড়াই করুক না কেন, বাস্তবে তাদের পায়ের নিচে শক্ত মাটি নেই। তাছাড়া শুরু থেকেই বিএনপি প্রচারণা চালিয়ে এসেছে যে, তাদের জিততে দেয়া হবে না। তাদের বিজয় ‘ছিনিয়ে’ নেয়া হবে! এসব কথা বলে একদিকে তারা দলীয় কর্মী-সমর্থকদের মনোবল দুর্বল করে দিয়েছে, অন্যদিকে ভোটারদের মনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। ‘ভোট দিয়ে কী হবে, জিতবে তো আওয়ামী লীগ বা নৌকা’ এই প্রচারণা যদি অব্যাহতভাবে চালানো হয় তাহলে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে যেতে উৎসাহিত হয় কীভাবে? ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে ৩০ শতাংশের কম ভোট হওয়ার পেছনে বিএনপি এবং বিএনপি অনুরাগীদের নেতিবাচক প্রচারণার প্রভাবের কথা বললে তা অন্যায্য হবে না।

তিন. নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ায় দেশে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তাকে অবশ্য নির্বাচন কমিশনে বিএনপির প্রতিনিধি মনে করা হয়। বিএনপি যেমন সরকারের সব কাজে আপত্তি বা ভিন্নমত পোষণ করে, মাহবুব তালুকদারও তেমনি নির্বাচন কমিশনে ভিন্নমতাবলম্বী। তবে একটি সাংবিধানিক পদে থেকে তিনি যেভাবে ‘বিরোধী’ বক্তব্য দিয়ে থাকেন তা প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার পরিপন্থি কিনা, ভাববার বিষয় সেটিও। মাহবুব তালুকদার বলেছেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থা ব্যর্থ হলে ক্ষমতা হস্তান্তরের স্বাভাবিক পথ রুদ্ধ হয়ে যায়, সেই অবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সব রাজনৈতিক দল আলোচনার টেবিলেই নির্বাচন ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারে। তা না হলে অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে পা বাড়াবে বাংলাদেশ।’ অল্পকথায় অনেক কথাই বলেছেন মাহবুব তালুকদার। এ ধরনের ‘উত্তেজক’ কথাবার্তা বলে তিনি কারো কারো কাছে হয়তো বাহবাও পাবেন। তবে তিনি যেসব ‘ভালো’ কথা বলছেন, সেগুলো দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা সেটাও দেখার বিষয়। সব রাজনৈতিক দল আলোচনার টেবিলে বসে কোনো বিষয়ে একমত হতে পারবে? আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি একমতে আসার রাজনীতি করে? রাজনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি করাই তো মনে হয় বিএনপির একটি অন্যতম রাজনৈতিক কৌশল। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার যারা করতে চায়, তাদের কাছে পানি ঘোলা না করার পরামর্শ কোনো সদর্থ বহন করে কিনা, সেটাই এক বড় প্রশ্ন। সিটি নির্বাচনের পর এমন অনেক প্রশ্নই সামনে এসেছে।

বিভুরঞ্জন সরকার : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App