×

মুক্তচিন্তা

মাতৃভাষার শিক্ষা এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:০৭ পিএম

মাতৃভাষা হচ্ছে ভাষা-জ্ঞানের ভিত। নিজ ভাষার দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে অন্য ভাষা গ্রহণের যোগ্যতা। ভাষা জানা অপরাধ নয়। সেটা যোগ্যতা ও দক্ষতারই পরিচয়। তবে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করা অপরাধ। আমাদের তরুণেরা পাঠে নয়, দেখা ও শোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
আমাদের এই স্বাধীন দেশে তিনটি ভিন্নমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। একটি ইংরেজি মাধ্যম, একটি আরবি মাধ্যম, অবশিষ্টটি মাধ্যমিক স্তর। মাধ্যমিকে মাতৃভাষার প্রাধান্যে অপরাপর ভাষা ও বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয়। এই তিন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থাকে একমুখী এবং মাতৃভাষানির্ভর করা সম্ভব না হলে শিক্ষাক্ষেত্রে বিভাজন এবং বৈষম্য কেবলই বৃদ্ধি পাবে। সমাজে আরো বহুমাত্রিক বিভক্তি-বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করবে। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাই রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত। সে কারণে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার নিয়ন্ত্রক রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকার। মাধ্যমিকের শিক্ষার অগ্রগতি অতীতের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে হলেও, ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়কে ক্রমান্বয়ে সংকুচিত করা হয়েছে। অতীতে ইতিহাস, ভ‚গোল, পৌরনীতির পৃথকীকরণ ছিল এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ইতিহাস। এখন ইতিহাসকে সংকুচিত করে কোণঠাসা করা হয়েছে। জাতির মনন বিকাশে, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধকরণে ইতিহাসের বহুমাত্রিক গুরুত্ব অস্বীকার করা যাবে না। ইতিহাস জ্ঞানের অপরিহার্যতার বিকল্প নেই। পাশাপাশি দর্শন এবং মাতৃভাষার সাহিত্য-বিশ্বসাহিত্যের বঙ্গানুবাদও অতি আবশ্যিক। ইতিহাসবর্জিত জাতি কখনোই নিজেদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ধারণ করতে সক্ষম হয় না। ইতিহাস জ্ঞানের ঘাটতি অপূরণীয় বলেই বিবেচনার দাবি রাখে। আমাদের শিক্ষাক্রমে প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের অবদান অপর দুই ধারা থেকে স্বাতন্ত্র্য। ওই দুই ধারা প্রকৃতই জাতির জন্য কল্যাণকর অবদান রাখতে অসমর্থ। শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য প্রবল হয়ে পড়েছে। সমাজের সুবিধাভোগী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বঞ্চিতরা মোটা দাগে বিভাজিত। এই বিভাজন দূর করা সম্ভব না হলে জাতির শিক্ষা বিস্তারে অন্তরায়ের পাশাপাশি বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাবে। রাষ্ট্র ও সরকারের প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকে নিয়ন্ত্রণ থাকলেও অপর দুই মাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের সুযোগও। তারা রাষ্ট্র ও সরকারের হস্তক্ষেপ মুক্ত বলেই তাদের ইচ্ছানুযায়ী শিক্ষার্থীদের বিজাতীয় শিক্ষা প্রদানের সুযোগ পেয়ে বসেছে। শিক্ষা এখন মুনাফার হাতে বন্দি। শিক্ষা এখন ক্রয়-বিক্রয়ে পরিণত। রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রের ন্যায় শিক্ষাক্ষেত্র থেকেও দায়মুক্তি নেয়ার তালে আছে। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষার অধিকার সাংবিধানিক। সেই অধিকার সংকুচিত এবং বিভাজিত। জাতির শিক্ষা বিস্তারে রাষ্ট্রের ভ‚মিকা ও অবস্থান সঙ্গত কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের সমাজজুড়ে হিজাবের প্রচলন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও হিজাব পরিধান প্রবলতর এখন। এককথায় হিজার পরার হুজুগ পড়েছে দেশে। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি শাসনামলেও হিজাবের প্রচলন ছিল না। বয়স্কদের মধ্যে বোরকা পরিধানের রেওয়াজ ছিল। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বোরকার প্রচলন ছিল অতি নগণ্য। তাদের হাতে গোনা যেত। এখন চারদিকে হিজাব পরিহিতাদের ছড়াছড়ি। হিজাব কি তবে নারীর আত্মরক্ষার ঢাল কিংবা ফ্যাশন? আত্মরক্ষায় হিজাব যথেষ্ট নয়। কিশোরী তনু দেশের সর্বাধিক নিরাপদ স্থানগুলোর একটিতে নৃশংসভাবে ধর্ষিত ও খুন হয়েছে। তনুকে তার হিজাব রক্ষা করতে পারেনি। ফ্যাশনরূপে হিজাবের প্রচলন দেখা যায় পিরামিডের মতো উঁচু খোঁপায় হিজাবে আবৃত করে মাথার বিভিন্ন অংশে কারুকাজ খচিত ইমিটেশন জুয়েলারি আঁটানো। এই হিজাব পরিধানকে কেতাদুরস্ত হওয়া ছাড়া আর কী বলা যায়! আমাদের গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা সিলেবাসকেন্দ্রিক। এজন্য ব্যবস্থা দায়ী। শিক্ষার্থীরা নয়। সিলেবাসকেন্দ্রিক পাঠ্যক্রমের অধীনেই শিক্ষার্থীদের সীমানা নির্ধারিত। এর বাইরে যাওয়ার তো তাদের উপায় নেই। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের পক্ষে একমাত্র সাহিত্যানুরাগী ছাড়া মাতৃভাষার সাহিত্য পাঠের অবকাশ অন্যদের কোথায়? বিশ্বসাহিত্য বলতে আমরা ইংরেজি সাহিত্য বুঝি। বিষয়টি সঠিক নয়। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ এই ধারণার জন্ম দিয়েছে। ইউরোপের একমাত্র ইংরেজি ভাষী দেশ ইংল্যান্ড ছাড়া দ্বিতীয় কোনো ইংরেজি ভাষী দেশ নেই। এমনকি যুক্তরাজ্যের অপরাপর রাষ্ট্র স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলসও ইংরেজি ভাষী নয়। আমেরিকা, কানাডা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডই ইংরেজি ভাষী দেশ। এর বাইরে ক্ষুদ্র দুয়েকটি রাষ্ট্র থাকলেও তিন মহাদেশের ওই পাঁচটি দেশই কেবল ইংরেজি ভাষী। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক শাসন-শোষণে ইংরেজি ভাষার বিস্তার লাভ ঘটেছে। ইংরেজি প্রীতি সঙ্গত কারণে ঔপনিবেশিক মানসিকতা রূপেই গণ্য করা যায়। বিশ্বের অপরাপর রাষ্ট্রের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হলেও সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক শাসন-শোষণের অধীনে থাকা দেশগুলোতে ইংরেজি ভাষার প্রচলন ঘটানো সম্ভব হয়েছে। এবং বিকল্প ভাষা রূপে ইংরেজি ভাষাকে গণ্য করারও সুযোগ করে দিয়েছে। মাতৃভাষা হচ্ছে ভাষা-জ্ঞানের ভিত। নিজ ভাষার দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে অন্য ভাষা গ্রহণের যোগ্যতা। ভাষা জানা অপরাধ নয়। সেটা যোগ্যতা ও দক্ষতারই পরিচয়। তবে মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করা অপরাধ। আমাদের তরুণেরা পাঠে নয়, দেখা ও শোনায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারা সংবাদপত্র পাঠের চেয়ে স্মার্টফোনে, ল্যাপটপে, আইপ্যাড, টিভি মিডিয়ায় নির্ভরশীল। এই প্রবণতা ব্যক্তির নয়। তরুণ প্রজন্মের সমষ্টির। ইন্টারনেটে ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ম্যাসেঞ্জার, লিঙ্কইন, ইমু ইত্যাদিতে তারা মাদকাসক্তের মতো আসক্ত। এতে সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা এবং সর্বোপরি সময় অপচয়ের যে করুণ দশা আমরা দেখছি, তাতে হতাশ না হয়ে উপায় নেই। হাস্যকর হলেও মোবাইল ফোনে ওই সব ব্যবহারকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমরূপে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাসে, রিকশায়, গাড়িতে এবং পথে-ঘাটে যত্রতত্র তরুণদের স্মার্টফোন হাতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। রাত জেগে ফোন হাতে টিপাটিপিতেও তারা একপ্রকার নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এটা অবশ্যই আতঙ্কের বিষয়। বিশ্বের ধনপতিদের শীর্ষ এবং প্রযুক্তি ব্যবসার সেরা ব্যক্তি বিল গেটস সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, পরিণত বয়সের আগে তিনি নিজ সন্তানদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেননি। অথচ প্রযুক্তির এই ব্যবসায় তিনি বিশ্বের সেরা ধনপতি। আমাদের শিক্ষাক্রমে উন্নতি-অগ্রগতি যে হয়নি, সেটা সত্য নয়। উন্নতি-অগ্রগতি নিশ্চয় হয়েছে। বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে যে অবনতি ঘটেনি সেটাও মিথ্যা নয়। আমাদের শিক্ষাক্রমে মানবিক শাখা অবহেলিত। বিজ্ঞানও বাণিজ্যের দাপটে সর্বোচ্চ স্থানচ্যুত হওয়ার অপেক্ষায়। সাহিত্য বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ অনাবশ্যক হয়ে পড়েছে। সাহিত্যে উচ্চশিক্ষা লাভের পর সম্মানজনক পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। তাই সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহের ভাটির টান লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজি সাহিত্যের কদর থাকলেও, বাংলা সাহিত্যের কদর-মর্যাদা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এতে শিক্ষার্থীদের বাংলা সাহিত্যের আকর্ষণ ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। একটি জাতি কতটা অগ্রসর, সেটা নিরূপণ হয় জাতির শিক্ষার হারের ওপর। শিক্ষা জাতির জন্য সুযোগ নয়, অধিকার। এই অধিকার সাংবিধানিক। জাতিকে শিক্ষার অভিমুখে সার্বিক সহায়তা প্রদান রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার দায় রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র পরিচালনাকারী সরকারকেই বহন করতে হবে। এক্ষেত্রে দায়মুক্তির সুযোগ নেই। সব নাগরিকের অভিন্ন শিক্ষার মাধ্যম প্রচলন ও প্রতিষ্ঠার দায়ও তাদেরই। সবার জন্য শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সুস্পষ্ট নীতিমালা (শিক্ষানীতি) প্রণয়ন স্বাধীন দেশে হয়নি। যে ক’টি হয়েছে তাতে সব নাগরিকের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়নি। শিক্ষাক্ষেত্রে সামগ্রিক অনিয়ম-বিশৃঙ্খলা সর্বোপরি বৈষম্য দূর করা বিদ্যমান ব্যবস্থাধীনে সম্ভব বলে বিবেচনা করা যাবে না। ব্যবস্থাটির বদল না ঘটলে শিক্ষাক্ষেত্রসহ সব ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেটা অপসারণ সম্ভব হবে না। তাই ব্যবস্থা বদল অনিবার্য। এই সত্যটি আমাদের আমলে নেয়া ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App