×

অর্থনীতি

করোনায় আক্রান্ত অর্থনীতি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৫৪ এএম

করোনায় আক্রান্ত অর্থনীতি
করোনায় আক্রান্ত অর্থনীতি

করোনা ভাইরাসে দেশে এখন পর্যন্ত কেউ আক্রান্ত না হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিভিন্ন খাতে। প্রয়োজন থাকলেও আতঙ্কে চীন যাচ্ছেন না কোনো ব্যবসায়ী। সরকারের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মেগা প্রকল্পসহ অনেক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত চীনা নাগরিকদের নিয়ে বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। স্থবিরতা নেমে এসেছে চীনা জাহাজ দিয়ে পণ্য পরিবহনেও। এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

চীনের উহানে গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটে। অল্প সময়ের মধ্যেই এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে প্রাণহানি ঘটাতে শুরু করে। এ কারণে চীনসহ আক্রান্ত দেশগুলোর নাগরিকদের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বিশ্বজুড়ে। চীনের নাগরিকদের অন্য দেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। ওই দেশে অবস্থানরত নিজ দেশের নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার হিড়িকও পড়ে। ফলে কার্যত একঘরে হয়ে পড়ে চীন।

বাংলাদেশেও এর প্রভাবে নানা তৎপরতা শুরু হয়। ইতোমধ্যেই চীন থেকে ৩১২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আরো অনেকেই এখন চীন থেকে ফিরতে চাচ্ছেন। ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার খবরে বাংলাদেশ থেকে চীনে যাওয়া বন্ধ রেখেছেন এ দেশের নাগরিকরা। পুরান ঢাকার চকবাজারের ব্যবসায়ী হাজি আবদুর রহমান জানান, তিনি প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার চীন যেতেন। সেখান থেকে খেলনা, কসমেুিটকস, শোপিসসহ বিভিন্ন সামগ্রী আমদানি করে পাইকারি বিক্রি করতেন। প্রতি সফরেই নতুন নতুন পণ্যের খোঁজ করতেন তিনি। কিন্তু গত মাসে যাওয়ার কথা থাকলেও আর সে দেশটিতে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। তার মতো অনেক ব্যবসায়ীই এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বলে জানান তিনি।

এদিকে দেশের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে কর্মরত চীনা নাগরিকদের নিয়েও বিড়ম্বনা দেখা দিয়েছে। পদ্মা সেতু, পদ্মা রেলসংযোগ, কক্সবাজার-দোহাজারি রেলরুট, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অনেক প্রকল্পে কর্মরত চীনের ঠিকাদার, প্রকৌশলী ও শ্রমিক গত ২৫ জানুয়ারি চৈনিক নববর্ষ উপলক্ষে ছুটিতে নিজ দেশে যান। এখন করোনা আক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে অনেকের ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। আর যারা ছুটি কাটিয়ে ফিরে এসেছেন, তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখার পাশাপাশি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ফলে প্রকল্পের কাজের গতি কিছুটা শ্লথ হয়েছে বলে জানা গেছে।

পদ্মা সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আবদুল কাদের জানান, এ প্রকল্পে প্রায় ১১শ চীনা নাগরিক কাজ করছেন। তাদের মধ্যে কমপক্ষে আড়াইশ ছুটিতে আছেন। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের কারণে চীনা নাগরিকদের ওপর নজরদারি বেড়েছে। অনেককে বিশ্রামে রাখা হয়েছে। ছুটিতে যাওয়া সে দেশের নাগরিকদের ছুটি আরো বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি। একই কথা জানান পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ. চৌধুরী। তিনি বলেন, চীনা নববর্ষের ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন যারা, তাদের আপাতত দেশে আনা হচ্ছে না।

করোনা ভাইরাসের প্রভাবে পিছিয়ে পড়তে পারে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বোধন। আগামী মার্চে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এটি উদ্বোধন করার কথা। প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম জানান, চীনা স্টাফরা এ প্রকল্পে যুক্ত। তবে ভাইরাসের প্রভাবে অনেক কর্মীকে কাজ থেকে বিরত রাখা হয়। এর জেরে উদ্বোধনপর্ব পিছিয়ে যেতে পারে।

এদিকে পটুয়াখালী জেলার পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরা ২০ চীনা নাগরিককে কোয়ারেন্টাইন করে রাখা হয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ প্রকল্পে কর্মরত আড়াইশো চীনা কর্মীর মধ্যে ৭০ জন ছুটিতে রয়েছেন। তাদের আপাতত দেশে ফিরতে না করা হয়েছে। এ প্রকল্পের পরিচালক হারুন অর রশিদ বলেন, সবার আগে দেশের স্বার্থ। এতে প্রকল্পের কাজে কিছুটা প্রভাব পড়বে। তবু চেষ্টা করা হচ্ছে কাজ এগিয়ে নিতে। একইভাবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার (রামু) রেললাইন প্রকল্পের ৩১ চীনা নাগরিককে চিঠি আপাতত দেশে না ফিরতে নিষেধ করা হয়েছে।

চীনে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাশ পণ্য সমুদ্র পথে পরিবহন করা হয়। আর বিশ্বের ১০টি প্রধান সমুদ্রবন্দরের ৭টিই চীনে। এখন সেগুলোতে পণ্য ওঠানাম প্রায় বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। মার্স্ক, এমএসসি মেডিটেরানিয়ান শিপিংয়ের মতো বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো বলছে, চীন ও হংকং হয়ে ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম আফ্রিকার পথে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা তারা কমিয়ে দিয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও।

চীনের করোনা ভাইরাসের কারণে দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানিসহ সব ধরনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে নতুন এলসি (ঋণপত্র) খোলার কাজ। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিসিআই) হিসেবে ইতোমধ্যে ঝুঁকিতে পড়েছে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য। স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।

বিসিসিসিআইয়ের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট এটিএম আজিজুল আকিল জানান, এ অবস্থা চলতে থাকলে কাঁচামালের অভাবে অনেক ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির অভাবে অনেক নতুন ফ্যাক্টরি চালু করা সম্ভব হবে না। চীনা নাগরিকদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ রয়েছে। এতে কারিগরি কর্মকর্তারাও আসতে পারছেন না।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে চীনের সঙ্গে প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে। বর্তমানে সব ধরনের আমদানি-রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। সমস্যা দীর্ঘায়িত হলে এর নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়বে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App