×

সাময়িকী

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৫১ পিএম

[ পর্ব : ১০ ]

বোটে সবার সামনের এই পথে আগে কখনো গেছ? অনেকবার। তুমি আমাদের ক্যাপ্টেন। কারো কথা শুনবে না। তুমি যা ভালো মনে করবে তাই করবে। কারো পরামর্শের তোমার দরকার নেই। অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বললাম আমি। হ্যারল্ড ইঞ্জিন চালু করল। জীবন ফিরে পেল বোটটি। তার মাথা ঘুরে গেল কোরোরের দিকে। সী আরও রাফ এখন। হুইল ধরে টেউয়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে উঠছে হ্যারল্ডও। ন’বছর বয়স হতে বাবার সঙ্গে সাগরে আছে সে। একুশ বছর বয়সে উত্তাল সমুদ্রে ধরেছে বোটের হুইল। তাও তো আজ পনের ষোলো বছর আগে। জোর হাওয়া আসছে। ফুলে ফুলে উঠছে তার লম্বা চুল। তিরিশ-চল্লিশ ফিট উঁচু ঢেউয়ের মাথা থেকে আছড়ে পড়ছে বোট। নিচে। পানিতে। পানি তো পানি নয় মনে হচ্ছে পাথর। একেকটি মিনিট যেন একেকটি ঘণ্টা। খ্যাপা সাগরে ডুবু ডুবু বোট নিয়ে হ্যারল্ড যেন আমাদের ক্যাপ্টেন নয়- সে যেন এখন পাইরেট অব দি প্যাসিফিক। সাগরে গর্জন কিন্তু বোটে পিন পতন নিঃস্তব্ধতা। রাফ সী পেরুতে আমাদের আধঘণ্টা লাগল।

৬. সাগরে আমাদের কারো মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল না। কোরোরে জেটিতে বোট ভিড়তেই মোবাইল অন করলাম। কয়েক সেকেন্ড। কিউয়ে থাকা ম্যাসেজ এল। চিফ অব প্রটোকলের বার্তা। দু-তিন মিনিট। এবার তার ফোন। বলল, দুপুরের পর থেকে তোমাকে ধরতে চাইছি। পাচ্ছি না। আমি তো সাগরে ছিলাম। আমাদের বোট সবে ঘাটে ভিড়ছে। হ্যাঁ, তাই তো। সকালেই তো বললে রক আইল্যান্ডস ট্যুরে যাচ্ছ। যাক সময় মতো যে ফিরেছ, ভালোই হলো। প্রেসিডেন্ট তোমার দাওয়াত কবুল করেছেন। হ্যাঁ, তোমার ম্যাসেজ দেখলাম। ধন্যবাদ তোমাদের প্রেসিডেন্টকে। বল কখন তিনি ডিনারে আসতে পারবেন। সন্ধ্যা সাতটা। তা ভেন্যু কোথায় করলে। তোমাদের ফরেন সেক্রেটারির রেস্টুরেন্ট। তাজ। কি মনে নেই তোমার? আশা করি কোনো অসুবিধা হবে না। হবে না বলেই তো মনে হয়। হলে তোমাকে জানাব। সেক্ষেত্রে আমি প্রেসিডেন্টের পছন্দমতো জায়গায় আয়োজন করব। দরকার হবে না। রেস্টুরেন্টে যাবার জন্য তোমার কি গাড়ি লাগবে? প্যালেশিয়া আর তাজের দূরত্ব খুবই কম। পাশাপাশিই এক প্রকার। বললাম না। লাগলে বলো, তোমাকে আমি পৌঁছে দিয়ে আসব। না, না দরকার নেই। আমি ম্যানেজ করে নেব। আমার না করার কারণ চিফ অব প্রটোকলকে যতটা সম্ভব পেরেশান না দেয়া। এক অর্থে তিনি তো আমাদেরই সহকর্মী। ডাঙায় নেমে আমার প্রথম কাজ হলো রবার্টকে ফোন করা। সব শুনে সে বলল, কোনো অসুবিধা হবে না স্যার। তা ট্যুর কেমন হলো? ভালো। ট্যুর না করে ফিরে গেলে বড় একটি মিস হয়ে যেত। তোমাকে ধন্যবাদ। ওয়েলকাম স্যার। তবে একটি কাজ তুমি ঠিক করনি। ট্যুরের টিকেট তোমার একাউন্টে পারচেজ করা উচিত হয়নি। ইমপ্যাকের ওরা আমার বন্ধু স্যার। আমার আসলে হাফ পেমেন্টও লাগেনি। যাই লাগুক সন্ধ্যায় টাকাটা নিয়ে নিয়ো। সামান্য টাকা। রবার্ট আমতা আমতা করতে থাকে। কিন্তু আমার জোরাজুরিতে বলে, ঠিক আছে স্যার, ডিনারের বিলে পুষিয়ে নেব। তুমি কি আমাকে সাড়ে ছয়টায় হোটেল থেকে একটু তুলে নিতে পারবে। অবশ্যই। তাজে আমি হেঁটেই যেতে পারি। কিন্তু আমার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের জন্য একটি গিফট থাকবে। ম্যানিলা থেকে তা ক্যারি করছি আমি। শাইনপুকুর সিরামিকের টি সেট। দু-তিন মাস আগে ম্যানিলায় ইন্টারন্যাশনাল বাজার হলো। তখন বাংলাদেশ মিশনের লেডিজরা যেমন আন্দালিবের স্ত্রী সোহানি আর আমার বউ লীনা তাতে বাংলাদেশি পণ্য প্রদর্শন ও বিক্রি করেছিল। বিক্রির একটি অংশ দূতাবাস স্থানীয় চ্যারিটির জন্য আর একটি অংশ রেখেছে আগামীবার মেলায় অংশ নেবার জন্য। তখন স্কয়ার এবং প্রাণের প্রোডাক্টস ছাড়াও আমরা রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর মাধ্যমে আরো কিছু পণ্য সংগ্রহ করেছিলাম। শাইনপুকুর সিরামিকস্ সেভাবেই পাওয়া। এর উদ্দেশ্য হলো আমাদের পণ্য সামগ্রীর বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ঘটানো। প্যালেশিয়ায় ফিরে রুমে ফ্রন্ট ডেস্কের চিঠি পেলাম। তাতে লেখা, ‘ইওর ডিনার উইথ দ্য প্রেসিডেন্ট অব পালাও ইজ কনফার্মড অ্যাট সেভেন পিএম টুনাইট অ্যাট তাজ রেস্টুরেন্ট।’ ডিনারের আধঘণ্টা আগে সাড়ে ছটায় আমি তাজে পৌঁছুতে চাই। সাগরের জলে আমার পোশাক ভেজা অল্প। সমুদ্রে গেলে কোনো না কোনোভাবে বালি শরীরে, পোশাকে এসে যায়। আমি স্নান সেরে নিলাম। হট বাথ। গরম জলে শরীর ভিজিয়ে রাখায় আধঘণ্টায় তা ঝরঝরে হয়ে গেল। এবার সামান্য বিশ্রাম। কিন্তু বিশ্রাম চাইলেই তো পাওয়া যায় না। দরজায় টোকার শব্দ পাই। খুলে দেখি একজন বাংলাদেশি দাঁড়িয়ে। হাতে পলিথিনের ব্যাগ। বলল, চিনতে পারছেন স্যার। আপনার জন্য শিম নিয়ে এলাম। আমি তাকে চিনতে পারি। প্যালেশিয়ার অদূরেই তাদের গ্রোসারি। শরীফের সঙ্গে সেখানে গেছিও আমি। উত্তর দিলাম, ভেতরে আসুন। তা শিম কেন? আপনি সেদিন দোকানে কিনতে চেয়েছিলেন। ভালো ছিল না বলে দিতে পারিনি। এই শিম বাংলাদেশিদের কিচেন ফার্মে উৎপাদিত। জলের চাপড়ে তার তো এতক্ষণ খানখান হয়ে যাবার কথা। তারপরও সে মোকাবেলা করে চলেছে সমুদ্র দানবকে। জাপানি মেয়েদের এখন তীব্র চিৎকার চলছেই। হ্যারল্ড কী করবে বুঝতে না পেরে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। হালহীন কিংবা নিষ্প্রাণ জলযানের মতো তা ঢেউয়ের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল। আমি তো হতভম্ব। জিজ্ঞেস করলাম, বন্ধ করলে কেন? আমি কী করব? তারা তো চিৎকার করছে। চিৎকার করলেই তুমি ইঞ্জিন বন্ধ করবে। প্রায় ধমকে উঠলাম। আমি তো এখন বুঝতে পারছি না এই পথে আমাদের অগ্রসর হওয়া উচিত হবে কিনা। তোমরা বললে আমি বোট ঘুরিয়ে নেব। আরোহীদের আর্তচিৎকারে হ্যারল্ড আসলে কতকটা ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে এই অবস্থায় সে কখনো পড়েনি। কারণ তাকে দলের লোকেরা একেকজন একেক পরামর্শ দিচ্ছে। বিপদের সময় দশ মাথার বুদ্ধি আরো ভয়ানক বিপদের। হ্যারল্ডকে এখন ঠিক থাকতে হবে। তাকে এখন ঠিক রাখতে হবে। প্রতিটি মুহূর্ত এখন মূল্যবান। বললাম, তুমি এই পথ চেন? চিনি। আসনে আমি। ককপিটে হ্যারল্ড হুইল ধরে আছে। শক্ত হাতে। পোশাক আশাক, চেহারা, শরীরের কারণে তাকে আমার সব সময়ই লাগছে পাইরেট অব দি সি’র মতো। ককপিটের পাশে ওয়েট। দাঁড়ানো। তার পেছনেই আমি। আমি পেছন থেকে সহযাত্রীদের উচ্ছ¡াস শুনতে পাচ্ছি। আসলে তা উচ্ছ্বাসজনিত চিৎকার। একটু বড় ঢেউয়ে বোটটি দুলে উঠলেই কিংবা ভাইডেকের দুপাশ দিয়ে পানির ঝাপটা লাগলেই তারা চিৎকার করছে। জড়িয়ে ধরছে সঙ্গীকে। এ হলো প্যাসিফিক ভ্রমণে শেষ আনন্দ শুষে নেয়ার সর্বশেষ চিৎকার ধ্বনি। তাদের হুল্লোড়ে বাকিরাও মজা পাচ্ছে। বোট চলছে। বড় ঢেউয়ে দুলে দুলে উঠছে। সেই সঙ্গে হুইলে শক্ত হয়ে উঠছে হ্যারল্ডের হাত।

আমি তাকিয়ে আছি প্যাসিফিকের জলে। কোথাও তা কালো কোথাও তা নীল। আমার দৃষ্টি দিগন্তে সামনের দিকে। সেখানে অস্পষ্ট রুপালি স্কাইলাইন। অন্তত আমার কাছে তাই মনে হচ্ছে। ভাবছি ভালোই হলো তাড়াতাড়িই পৌঁছে যাচ্ছি কোরোরে। বোট চলছে। ক্রমশ সাগরকে রাফ লাগছে। উত্তাল হয়ে উঠছে তার ঢেউ। হুইলে হ্যারল্ড এখন যথেষ্ট মনোযোগী। ওয়েট ভাবলেশহীনভাবে পানিতে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে বিশাল বিশাল ঢেউয়ে ওর কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তাতে আমি মনে জোর পাই এই ঢেউ হয়ত কিছুই নয়। কিন্তু বিশ-পঁচিশ মিনিট পর আমার আর সেই জোর থাকে না। আমি যাকে রুপালি স্কাইলাইন ভেবেছিলাম আসলে তা ফুঁসে ওঠা ঢেউয়ের ফণা। সূর্যের আলোয় রুপোর মতো চকচক করছে। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে সী অত্যন্ত রুক্ষ হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমাদের সামনে বিশাল বিশাল ঢেউ ভাঙা অসমান সমুদ্রপৃষ্ঠ। পর্বতময় ভ‚ভাগ ওপর থেকে দেখতে যেমন লাগে কতকটা সেরকম। প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে সেসব ঢেউ আমাদের বোটকে ধাক্কা মারতে থাকল। আগের মতোই জাপানিরা ঢেউয়ের তালে তালে দু-চারবার আনন্দ চিৎকারের পর থেমে গেল। কারণ ঢেউ এখন ফুঁসে উঠছে। ধেয়ে আসছে। একেকটি ঢেউ তিন চারতলা ভবনের সমান উঁচু। আমি তখন আয়াতুল কুরসী পড়ছি। লাইফ জ্যাকেট আমরা পরে নিয়েছি আগেই। হাইড এবার সবার হাতে লাইফ বেল্ট ধরিয়ে দিতে থাকল। শক্ত করে ধরে আছি সিট আর ঢেউয়ের আঘাত সামলাচ্ছি। বোটটি যখন ঢেউয়ের মাথায় তখন নিচে তাকিয়ে আমার গলা শুকিয়ে আসছে। মনে হচ্ছে ওখান থেকে আমাদের বাহনটি আর ভেসে উঠতে পারবে না। শুধু কি তাই ওপর থেকে যখন বোটটি প্রচণ্ড বেগে নিচে পড়ছে মনে হচ্ছে পানিতে নয় তা আছড়ে পড়ছে রকের ওপর। এই মুহূর্তে জল যেন তরল কিছু নয় নিরেট পাথর খণ্ড। মনে হচ্ছে বোটটি ভেঙে টুকরো টুকরো হযে যাবে। জাপানি মেয়েগুলো চিৎকার করছে। না, কোনো আনন্দ চিৎকার ধ্বনি নয়। তা রীতিমতো ভয়ার্ত আর্তনাদ। প্রাণের মায়ায় অসহায় ভীত মানুষের চিৎকার। বোট যখন আছড়ে নিচে পড়ছে উপরে তাকিয়ে বিভীষিকাময় ঢেউ দেখে ভয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। মনে হচ্ছে ওই ঢেউয়ের আক্রোশে বোটটি তলিয়ে যাবে। আর কখনো জাগবে না। এত যে তার ওপর একটার পর একটা আঘাত আসছে তার পরেও তা টিকে যাচ্ছে। ছোট হলেও যথেষ্ট শক্তিশালী বোটটি- শক্তিশালী তার ইঞ্জিনও।

ম্যানিলায় সব্জিটি সেভাবে পাওয়া যায় না। আমি সেদিন তাই আগ্রহ দেখিয়েছিলাম দু-এক কেজি নেবার। ফ্রেশ ছিল না বলে তারা দেয়নি। বলেছিল হোটেলে পৌঁছে দেবে। আমি রাজি হইনি। ও তাই তো। কিন্তু আমি তো বারণ করেছিলাম। না স্যার, এ আর এমনকি। তা দাম কত? দাম লাগবে না। এক দুই ডলার যা দাম তা আপনার কাছ থেকে নিতে পারব না। আর এ তো আমাদের নিজেদের ফলানো জিনিস। সে ভেতরে বসল না- দামও নিল না। আমিও জোরাজুরি করলাম না। আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই সময়মতো ডিনারে এলেন। (চলবে)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App