×

অপরাধ

ক্যাসিনো মাফিয়াদের অঢেল সম্পদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:০৪ এএম

চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ও ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালদের অঢেল সম্পদের খোঁজ মিলছে দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধানে। বের হয়ে আসছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালেন্সের তথ্য। একই সঙ্গে নামে-বেনামে সম্পদ ও দেশের বাইরে পাচার হওয়া সম্পদ বের করতে নানাভাবে কাজ করছে দুদক টিম। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ তথ্যানুসারে এখন পর্যন্ত দুই শতাধিক আলোচিত ব্যক্তির অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।

দুদক সূত্র জানায়, ক্যাসিনো মাফিয়াদের অন্যতম ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সাবেক সভাপতি ইসমাঈল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের মালয়েশিয়ার আমপাং তেয়ারাকুন্ডতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে। এমনকি মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকে সম্রাটের অ্যাকাউন্টে লেনদেনের সুনির্দিষ্ট তথ্যও আছে গোয়েন্দাদের হাতে। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ব্যাংকেও তার লেনদেনের তথ্য মিলেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিআইএফইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে। অনুসন্ধানকালে পুলিশের ইমিগ্রেশন উইং, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ, পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস, সেকেন্ড হোমের এজেন্ট, মালয়েশিয়ান হাইকমিশন অনুমোদিত বিভিন্ন ভিসা এজেন্ট থেকে পাওয়া তথ্য, পাসপোর্টের কপি, সেকেন্ড হোম প্রকল্পে অনুমোদনপ্রাপ্তদের অনুমোদনপত্রের কপি ও ব্যাংক হিসাব বিবরণী যাচাই-বাছাইয়ে সম্রাটের মালয়েশিয়ায় অর্থপাচার ও ফ্ল্যাট থাকার তথ্য বেরিয়ে আসে।

ইসমাইল হোসেন সম্রাটের সহযোগী, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান ও যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের অঢেল সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক। দুজনের বিরুদ্ধে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ ও ব্যাংক ব্যালেন্সের তথ্য মিলেছে। দুজনের নামে বেনামি সম্পদ ও দেশের বাইরে পাচার হওয়া সম্পদ বের করতে দুদক টিম নানাভাবে কাজ করছে। ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে অন্য দুর্নীতিবাজ নেতাদের সঙ্গে তারা দুজনও আত্মগোপন করেন। দুদকের কর্মকর্তারা জানান, দুজনেরই বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।

প্রভাবশালী আনিসের বিরুদ্ধে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদের সন্ধান মিলেছে। তবে তদন্ত শেষে এই অংক অন্তত ৫০ কোটি টাকা হতে পারে বলে জানা গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, কাজী আনিসুর রহমান ২০১৮-১৯ করবর্ষ পর্যন্ত নিজের নামে ও বেনামে অর্জিত ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকার স্থাবর সম্পদ ও ১ কোটি ৭২ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ তার ট্যাক্স ফাইলে দেখিয়েছেন, যা তার আয়বহির্ভূত সম্পদের অংশবিশেষ মাত্র। বেনামি সব সম্পদ তিনি আড়াল করেছেন। রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে মাল্টিপ্লান সেন্টারে মার্কেট, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরে ৭৪, রসুলপুরে ২৪ দশমিক ৫০ শতাংশ জমি, ঢাকার আরকে মিশন রোডে আমিন বিলাস ভবনের পঞ্চম তলায় ১৩শ বর্গফুটের আলিশান ফ্ল্যাট ও কার পার্কিং, ঢাকার স্বামীবাগে ৫৪/১ নং রোডে একটি ফ্ল্যাট, ধানমন্ডির ১০-এ রোডে আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট, শুক্রাবাদের শের-ই-বাংলা নগরে ৭ তলা বাড়ি (বাড়ি নং : ৮/২, আরেফিন পার্ক), ধানমন্ডি ৪নং সড়কে ১৫/এ নং বাড়িতে ১৪শ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের সন্ধান মিলেছে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে। এসব ফ্ল্যাট ও জমির রেজিস্ট্রেশন মূল্য ৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা হলেও প্রকৃত মূল্য অন্তত ২৫ কোটি টাকা হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

একইভাবে আনিসের নামে মেসার্স আরেফিন এন্টারপ্রাইজ কোম্পানির শেয়ার মূল্য ৮৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, মেসার্স মা ফিলিং স্টেশনের শেয়ার মূল্য ৩৬ লাখ টাকা, প্রাইজবন্ড ৩০ লাখ টাকা ও দুটি গাড়িসহ তার প্রায় ২ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদের সন্ধান মেলে। এ ছাড়াও কাজী আনিসুর রহমানের নামে ব্যাংক এশিয়া, প্রাইম ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ইউসিবিএল, ঢাকা ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, ডাচ-বাংলা ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট, সেভিংস অ্যাকাউন্ট, এফডিআর, এসটিডিসহ বিভিন্ন ফর্মে ৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সন্ধান পাওয়া গেছে। এই টাকা কোন খাত থেকে তিনি অর্জন করেছেন তার কোনো উৎস নেই। এসব সম্পদের সপক্ষে কোনো সুনির্দিষ্ট বৈধ উৎস নেই, যা তার জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণভাবে অর্জিত সম্পদ বলে মনে করছে দুদক।

এদিকে ক্যাসিনো ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ঢাকা মহানগর যুবলীগের (দক্ষিণ) সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধেও দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। দুদকের ১১৮ জনের নামের তালিকায় মাকসুদের নাম ৯১ নম্বরে। জানা গেছে, ক্যাসিনো কারবার, জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণ করে তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। ক্যাসিনো কারবারের মূল হোতা ছিলেন ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তাদের অনেক অবৈধ টাকাও জমা থাকত মাকসুদের কাছে। এ কারণে তাকে ক্যাশিয়ার মাকসুদ বলা হয়। একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, সম্রাটের চাঁদাবাজির প্রধান সৈনিক ছিলেন মাকসুদ। তিনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের টেন্ডার, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও দুর্নীতির টাকায় মতিঝিল ও পুরান ঢাকা এলাকায় তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তবে তার বেনামি সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও দুদক কর্মকর্তারা ধারণা দেন।

ক্যাসিনো ব্যবসায় আঙুল ফুলে কলাগাছ দুই ভাই : দেশে ক্যাসিনো কারবার চালুর পেছনের হোতা তারা দুই ভাই। নেপালিদের মাধ্যমে দুই ভাই বিদেশ থেকে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম নিয়ে আসেন। তারপর তা ছড়িয়ে দেয়া হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এই কারবারে দুই ভাই ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ’ বনে যান। গত বছরের শেষ দিকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে ক্ষমতাসীন বলয়ে থাকা এই দুই ভাই থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। অবশেষে তারা ধরা পড়ে সিআইডির হাতে। এই দুই ভাই হলেন, রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক এনু ও সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া।

সিআইডি সূত্র জানায়, মামলার তদন্তে ও গ্রেপ্তারের পর তাদের জিজ্ঞাসাবাদে দুই ভাইয়ের সম্পত্তির বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। এই দুজনের মোট ২২টি জমি ও বাড়ি রয়েছে, যার অধিকাংশই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। এ ছাড়া সারাদেশে ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ৯১টি অ্যাকাউন্টে তাদের মোট ১৯ কোটি টাকা জমা রয়েছে। ব্যক্তিগত পাঁচটি গাড়িও রয়েছে দুই ভাইয়ের। সেপ্টেম্বরে দুজনের বাড়িতে অভিযানের সময় ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা উদ্ধার করেছিল র‌্যাব।

শত কোটির মালিক গণপূর্তের প্রকৌশলী মঈনুল : ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, দুর্নীতি আর অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে শত কোটি টাকারও বেশি সম্পদ ও নগদ অর্থের মালিক হয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুল ইসলাম। গণপূর্তের মাত্র তিনটি প্রকল্প থেকে এই সম্পদ গড়েছেন তিনি। র‌্যাব সদর দপ্তর নির্মাণ কাজের টেন্ডার আহ্বান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ সংশ্লিষ্ট ভবন নির্মাণ এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের আবাসিক ভবনের মালামাল কেনাকাটায় এই দুর্নীতি করেছেন প্রকৌশলী মঈনুল ইসলাম। দুদকের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কথিত যুবলীগ নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীমের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন প্রকৌশলী মঈনুল ইসলাম। গত ৫ জানুয়ারি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। দুদকের ঊর্ধ্বতন সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে গণপূর্তের প্রকৌশলী ও ঠিকাদার সিন্ডিকেট নিয়ে নানা তথ্য দিয়েছেন তিনি। ইতোমধ্যে মঈনুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। অভিযোগের পক্ষে যথেষ্ট নথিপত্রও পাওয়া গেছে বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে।

গণপূর্ত ঠিকাদার সমিতির পক্ষে গত ২০ নভেম্বর সোহেল রানা ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারদের পক্ষে গত ৫ ডিসেম্বর মো. বদরুদ্দীন ওমর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ড. মঈনুলের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক প্রধান কার্যালয়ে পৃথক অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে তার ছাত্র জীবন, রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থসম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App