×

সাময়িকী

কবি বুলান্দ জাভীরের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কথন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৮:২০ পিএম

কবি বুলান্দ জাভীরের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কথন
কবি বুলান্দ জাভীরের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কথন

একজন কবির কাছে তার প্রতিটা কবিতাই শ্রেষ্ঠ। কবি তাই একটা কবিতা লেখা হয়ে গেলে পরে ওই কবিতাটিকে আর একটি নতুন কবিতা লেখার আগ পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রাখেন (রূপকার্থে বললাম)।

বুক পকেটে, কখনো কাঁধের ঝোলা বেগে, কখনোবা কম্পিউটারের হার্ডডিস্কে সংরক্ষণ করেন। অতঃপর খসড়া কবিতাকে ঘষামাজা করে একটা ধোপদুরস্ত প্যাটার্নে দাঁড় করিয়ে শেষে স্বস্তি। তাই বলছিলামÑ কবির কাছে তার সব কবিতাই প্রিয়। সব কবিতাই শ্রেষ্ঠ। তারপরও কথার ফাঁক গলিয়ে কথা এসে যায়। যে কথার কান্কোতে, ফুল্কায় ঝল্কানি দিয়ে ওঠে রৌদ্রকিরণ। আর ওই কিরণের আলোর প্রপাতে কিছু কবিতা নিজের আলস্য ভেঙে জেগে ওঠে ভোরের কহ্লারের (স্থলপদ্ম) মতো। কহ্লারের মতো ওই কবিতাই একটা ভিন্ন ইমেজ, ভিন্ন ডাইমেনশন নিয়ে নিজেদের ছাড়িয়ে গিয়ে চিবুকের ভাঁজে শ্রেষ্ঠত্বের পেট্রোম্যাক্স জে¦লে সন্ধ্যার সুনসান স্ট্রিটে ঝাপসা মেঘের মতো ঘুরে বেড়ায়।

পঞ্চাশের দশকের পর থেকে অদ্যাবধি অনেক কবিরই এমন চন্দ্রাঙ্কিত মেঘেডোবা কবিতা নিয়ে বেরিয়েছে শ্রেষ্ঠ কবিতা গ্রন্থ। আলোচ্য গ্রন্থটিও এমন এক ‘শ্রেষ্ঠ কবিতার’। কবি বুলান্দ জাভীর। আশির দশকের অন্যতম প্রধান কবিদের একজন তিনি। অত্যন্ত মেধাবী, মেলোডি আর সিম্ফনিয়ান তার কবিতা।

স্যুররিয়েলিজমের এক বিনম্র টোন তার কবিতাকে দিয়েছে বিশেষ বিশিষ্টতা। কখনো কখনো তার কবিতা ট্যুরিস্টের মতো পাঠককে পরিভ্রমণ করিয়ে আনে সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য, মাঠ, নদী, নষ্টালজিক কৈশোর আর তারুণ্যের পাতাঝরা আবছায়া পথ।

যে পথের শেষ মাথার কুয়াশাডোবা বাড়ির রেলিঙে ঝুঁকে থাকে কোনো এক কিশোরীর বৃষ্টির গুঁড়োজ¦লা রুপোঝুড়ি অ্যাপ্লিকের কারুকার্যময় নির্জন বিকাল। কবি বুলান্দ নিরন্তন ভালোলাগার মতো কবিতাই রচনা করে আসছেন দীর্ঘ সময় ধরে। নতুন করে আর তার কবিতাকে মূল্যায়নের কিছু নেই। আশির দশকের প্রধানতম কবি বুলান্দ জাভীর স্বকীয় শৈল্পিকতায় ইতোমধ্যে এক নিজস্ব স্বরের অভিনিবেশ করেছেন। যা একান্তই কবি বুলান্দ জাভীরের। তার প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতার’ সনির্বন্ধ উপস্থাপনাও তাকে নতুন করে এক অনশ^র মায়াময়তার এচিঙে রাঙিয়ে দেবে। বুলান্দ জাভীরের কবিতায় নগর জীবনের গল্প যেমন সাবলীলভাবে এসেছে। তেমনি নৈসর্গিক কনসেপ্টের ভায়োলিনও বেজে ওঠে থেমে থেমে।

গুঞ্জরণ জাগা বলরুমে উদ্বেল ব্যালেরিনাদের বুকে বুকে যে নিঃসঙ্গ ক্রন্দিনের তরঙ্গ আছড়ে পড়ে মোজেইকজ¦লা ফ্লোরে আর পিয়ানোর সকরুণ স্বরের মিহিন মোড়ে মোড়ে বুলান্দ জাভীরের কবিতার পঙ্ক্তি, শব্দ, উপমা, চিত্রকল্প, উৎপ্রেক্ষা অঝোর বৃষ্টির মতো ঝরে। নিদারুণ আবেগ মথিত স্ফুরণে বুলান্দ জাভীরের বাছাইকৃত শ্রেষ্ঠ কবিতার ঝাউবাগানে স্থলপদ্মের খোঁজে গিয়ে কবি লেখেন- ‘স্বপ্নের নীল কুয়াশায় ঝাপসা তোমার মুখ আসে/ স্পর্শের মধ্যে যে নয়/ চাইলেই অবাধ্য ঘোড়ার মতো যায়/ গহন কপাট ছেড়ে সীমাহীন দূর অন্তপুরে/ শুধু আসে যায়/ স্বপ্নের ভেতর আলতো পায়/ টুলবেঞ্চি মাতানো সময়/ বনবাছাড় তোলপাড় করা দিন/ (স্থলপদ্মের জন্য রোদন)’ উল্লিখিত কবিতাটিতে চিত্রকল্পের এক অনবদ্য ইশতেহার জেগে উঠেছে। উল্লেখ্য, কবি বুলান্দ জাভীর তার কবিতাকে উপমা, চিত্রকল্পের পুনরাবৃত্তি থেকে বরাবরই মুক্ত রেখেছেন। এক্ষেত্রে তার বৈশিষ্ট্যের তীক্ষ্ম বোধেরই উদ্ভাস ঘটে। বৃষ্টির অনুরণনের মতো বুলান্দের কবিতা স্বদেশীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিকতার আকাশেও উড়িয়েছেন অজ¯্র মেঘপুঞ্জবীথি। এক্ষেত্রে তার ‘মিস টরন্টো, মিস মেলবোর্ন, মিস প্যারিস, হাডসন রিভার, ওরল্যান্দো’র মতো কবিতাগুলোর কথা চলে আসে যথার্থভাবেই। আর বুলান্দ জাভীরের কবিতার গভীরতাকে ছুঁয়ে আসা মানে নীলাভ জল রাশির প্রশান্ত মহাসাগরের মর্মতল ছুঁয়ে আসা।

‘তুমি কি আমাকে কিছু বললে/নাকি কিছুই বলনি/আইফেল টাওয়ারের ইস্পাত চারুকলার ছায়ায় বসে/ লুই বুনুয়েল ক্যামেরা প্যান করেছেন/ মুখর পর্যটকের চলমান গ্রুপ ছবির ফ্রেমে/ ইংলিশ, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, সুইডিশ, আফ্রিকান, স্প্যানিশ, ইতালি, জাপানিজ, চাইনিজ, থাই, ইন্দোনেশিয়ান, ভারতীয়/ গ্লোবাল ফেসবুকের ভেতর অযুত মুখ, নিযুত চোখের ভেতর/ মনে হলো পাখি তুমি আমার দিকে তাকিয়ে আছ।

উদ্ধৃত কবিতায় ‘পাখি’ টাই অবশেষে ছলকে দিয়েছে ক্রিস্টালের অস্ফুট ভোরের আকাশ। প্রণয়ের ডিওডোরান্টভেজা একটি মুখ কি তখন প্যারিসের দিগন্ত জোড়া ক্যানভাসে ফুটে উঠেছিল। যা এ কবিতার ‘পাখি’ শব্দের গহিনে মর্মরিত হয়ে উঠেছে। আর এখানেই কবি বুলান্দ জাভীর হয়ে উঠেছেন অন্য কবিদের থেকে আলাদা। পোয়েট্রিসিজম তার কবিতাকে বরাবরই দিয়েছে অন্য এক মাত্রা। প্রকৃতি ও প্রেমের কবিতায় বুলান্দ জাভীর দেশাত্মবোধ এবং মানবতার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন স্বভাবগতভাবেই।তার কবিতা সব সময় যান্ত্রিকতাকে উপেক্ষা করে ভিজে উঠেছে অ্যালোভেরার মৃদু নির্যাসে।

কখনো তার কবিতার ভেতর ঘুরে যায় নিঃসঙ্গ ট্রেনের নির্জন ব্যুফেকারের টেবিলে মুখোমুখি বসা উষ্ণ বার্গারের মতো নিদাঘ দুপুর কিংবা তার কবিতার রানওয়েতে থামে এসে বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যাডোবা মেঘের এ্যারোফ্লট। আর এয়ারহোস্টেজের স্লিভলেস উজ্জ্বল বাহুর মতো ভোরের লাউঞ্জ বুলান্দের কবিতার রেশমি কিংখাবে জেগে ওঠে স্বর্ণোজ্জ্বল শিশিরের ঝলকানি নিয়ে। মধ্য রাতের বিজন পেভমেন্টের মতো বুলান্দ জাভীরের কবিতা কখনো কখনো এক রহস্য নিবিড় নৈসঙ্গের পাতা যায় ঝরিয়ে। নক্ষত্রের মার্বেল ছড়িয়ে যেতে যেতে কবি বুলান্দ জাভীর তার শ্রেষ্ঠত্বের সুবাস যান বিছিয়ে অনর্গল। আর এখানেই কবি বুলান্দ জাভীরে সমকালীন বাংলা কবিতার আর্শিতে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন নিজেরই প্রতিবিম্ব। ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বুলান্দ জাভীরের স্বকীয়তাকে আরো স্পষ্ট করেছে। করেছে উজ্জ্বলতর।

বুলান্দ জাভীরের ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ প্রকাশ করেছে আলোঘর প্রকাশনী। চমৎকার চাররঙা প্রচ্ছদ এঁকেছেন এই সময়ের অনিন্দ্য প্রচ্ছদ শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। প্রকাশকাল নভেম্বর : ২০১৯। মূল্য ২৫৫।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App