×

সাময়িকী

সময়ের স্বাক্ষর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:০৫ পিএম

সময়ের স্বাক্ষর

সাহিত্য মনের খোরাক ও সময়ের বার্তাবাহক। যদি তাতে সমকালীন সমস্যা সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি, রাজনীতি প্রকৃতি মানবীয় রূপসৌন্দর্য বিদ্যমান থাকে। সাহিত্য আবার সৃজনশীল ক্রিয়াকৌশলের খেলাও বটে। এ খেলায় যারা কাজ করেন তারা সৃজনশিল্পী। তাদের সৃজনকর্মে উদ্বুদ্ধকরণে মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদানে দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সংস্থা সম্মাননা প্রদান করে। তাতে সৃজনশিল্পীরা আরো মনোযোগী হয়। বাংলা একাডেমি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্যশিল্পের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ সাল বাৎসরিক সাহিত্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে। প্রতি বৎসর অমর একুশে গ্রন্থমেলা উপলক্ষে এ পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। কবিতা উপন্যাস নাটক প্রবন্ধ ছোটগল্প, শিশুসাহিত্য ভ্রমণকাহিনী এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক লেখনীতে প্রাজ্ঞজনকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৯ পেয়েছেন- মাকিদ হায়দার (কবিতা), ওয়াসী আহমেদ (কথাসাহিত্য), স্বরোচিষ সরকার (প্রবন্ধ), খায়রুল আলম সবুজ (অনুবাদ), রফিকুল ইসলাম (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা), ফারুক মঈনউদ্দীন (আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী) রতন সিদ্দিকী (নাটক), নাদিরা মজুমদার (কল্পবিজ্ঞান), রহীম শাহ (শিশুসাহিত্য), সাইমন জাকারিয়া ফোকলোর সমকালীন শিল্প ও সাহিত্যের বিবিধ শাখায় প্রত্যেকেই স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল।

১. মাকিদ হায়দার গল্পস্বরের কবি। লেখালেখির প্রথমে ছড়া দিয়ে শুরু হলেও কবিতায় তিনি স্বকীয়তা ধারণ করেছেন। তাঁর কবিতা গদ্যভাষার আদলে লেখা। নাড়া দিলেই দেশকাল, মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী হতাশা, সমাজ পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা, রাজনীতির ডামাডোল প্রেমাননুভ‚তি এবং জলসংলগ্ন মাটির কথাচিত্রের প্রকাশ খুঁজে পাওয়া যায়। সৃজনশীল মানুষেরা সমাজ বিনির্মাণে মুখ্য ভ‚মিকা রাখে সেক্ষেত্রে তাদের সমাজের দিকে চোখ রাখতে হয় তিনি নিভৃতচারী হলে সমাজের দিকে মনোনিবেশী ছিলেন। সহজ-সুন্দর ও সাবলীল ভঙ্গিতে ভাবকল্পনাকে উপস্থাপন করেছেন কাব্যিক চিন্তাকৌশলে। তাঁর সাহিত্যজগৎ- রোদে ভিজে বাড়ি ফেরা, রবীন্দ্রনাথ : নদীগুলো, বাংলাদেশের প্রেমের কবিতা, প্রিয় রোকনালী প্রভৃতি।

মুক্তিযুদ্ধ এবং চেতনার বাহক তিনি। মুক্তিনেশায় জাগ্রত বাঙালির সামনে ভীন শকুনের পদলেহনের সাথে সাথে এ দেশের সুবিধাভোগী গোষ্ঠীরাও হাত মিলিয়েছে। তাদের নাম হরেক রকম- রাজাকার, আলবদর আবার কী যে শান্তি কমিটি। সে শান্তি কমিটির কথা কবিতায় চিত্রভাষ্যে এরকম- “আমার উপর হামলাকারী/একাত্তরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের/ভ‚মিকার কথা পাড়ার সকলকে ডেকে বললাম।”

“প্রিয় রোকনালী” কাব্যে মুক্তিযুদ্ধের সমকালীন ঘটনার প্রকাশ রয়েছে। চারদিকে পতনের শব্দ সব কিছু নৈমিত্তিক নিয়মে বদলেও যাচ্ছে। ভাষাহীন মানুষের ক্রিয়াকল্প ব্যক্ত করেছেন। আজকের সুবিধাভোগীদের চিত্র রয়েছে। তারা সব জায়গায় তেলের মিশ্রণ ঘটিয়ে টিকে থাকে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে যারা হৈহুল্লোড় করেছে তারা এখন সমাজপতি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করছে। গুছিয়ে নেয় নিজের আখের। কবির চিত্তে বেদনা ধড়ফড় করে। দীর্ঘ সময় পেছনে পড়ে থেকে ক্লান্ত কবি ফিরে যান মুক্তিকামী মানুষের অবয়বে। জাতীয় পতাকা তুলে ধরেন কবিতায়। পাকসেনা ত্রাস নারী নির্যাতন ও খন্দকার মুশতাকের বুদ্ধিজীবী হত্যার ক‚টকৌশলের চিত্র একে স্মরণ করেছেন মুনীর চৌধুরী ও আব্দুল আলীমের মুখ। কবিতার ভাষ্য- টকটকে রক্ত যেন ছিটকে পড়ছে টেবিলের চারদিকে মুনীরের আলিমের চোখগুলো যেন তাকিয়ে আছে সকলের দিকে। (রোকনালী ৬০-ক) কবিতায় প্রকৃতির চিত্র চুম্বকীয় শক্তি হিসেবে ধরা দিয়েছে। পূর্ণিমা রাতের চিত্র হলে তো কথাই নেই টেনে নেয় হৃদয়শয্যায়। আলোকিত করে মনের দুয়ার। দেহে আগুনের সমাগম ঘটে। সহজাত কবিবৈশিষ্ট্যে তার কবিতায় এসেছে জ্যোৎস্না রাতের প্রভা। প্রেম ধরা দিয়েছে কবিতা পাঠকের মনে। সুখ-দুঃখের বিরহ যন্ত্রণা ধরা দিয়েছে চোখের তারা, হাত ইশারা ও দুঃখী প্রেমিক সংলাপে-

“বলতে পারে মনের কথা/চোখের তারায়/হাত ইশারায়/ঐ যে দেখ দুঃখী প্রেমিক” (যে আমাকে প্রেম শেখালো) মাকিদ হায়দার সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিবারের সন্তান হয়ে সে পথেই রেখেছেন শিল্পের হাত। সমকালীন কবিদের স্নেহ ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ করেছেন। তাই লিখেছেন নিবেদিত কবিতা। তাঁর কবিতার বিষয় শিল্পশৈলী সম্পূর্ণ নিজস্ব। নাগরদোলা ডাঙা সামাজিক উৎসব, রূপক নৌকা, মোহটানে দৌড়াদৌড়ি খেলা, পর্যবেক্ষক দল, গুড়ের বাতাসা অসাধারণ শব্দ ব্যবহার দেখলে মনে হয় সাহিত্য- শিল্পসরোবর তিনি।

২. ওয়াসী আহমেদ আশির দশকের কথাকার। কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু হলেও কথাসাহিত্যে পাঠকের মনোরঞ্জন করেছেন। তাঁর প্রথম কবিতার বই শবযাত্রী স্বজন। প্রথম গল্প সংকলন ছায়াদণ্ড ও অন্যান্য (১৯৯২) তার প্রথম উপন্যাস মেষপাহাড় (২০০০) তলকুঠুরির গান প্রভৃতি। তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করেছেন।

সৃষ্টিশীল গদ্যলেখকদের মাঝে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশে লেখালেখির মাঝে যে কজন নিয়মিত ছিলেন তিনি অন্যতম। স্বাধীনতা উত্তর স্বাধীনতার আশাভঙ্গ, হতাশা স্খলনকে চিহ্নিত করে সাম্প্রতিক অনুষঙ্গকে ধারণ করেছেন। গল্প অস্তিত্বের মোড়কে আবৃত তাঁর কথাশিল্প। তাই পাঠক জীবনযুদ্ধের বিন্যাস খুঁজে পায়।

৩. স্বরোচিষ সরকার জীবন্ত কিংবদন্তি তিনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যসাধক ও প্রমিতরীতিকার হিসেবে কাজ করছেন। তাঁর হাত ধরে প্রতিভার জন্ম হয়নি বাংলাভাষার বিবর্তন আর্ট ও শৈলীবিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। অধ্যাপক লেখক প্রাবন্ধিক ও আভিধানিক বহু অভিধায় খ্যাত শ্রদ্ধাভাজন পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৯। এ প্রাপ্য তাঁর বহু আগেই ছিল কারণ তিনি ভাষা সংস্করণে সুন্দর কাজ করেছেন। তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন যে কোনো কাজকে নিজের মতো করে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করেন। বলা চলে সমকালীন বাংলাসাহিত্যে ভাষার সৌকর্য নির্মাতা তিনি। বাংলাভাষার অবয়ব নির্মাণে ব্যাকরণের ব্যবহার অনস্বীকার্য। কারণ ব্যাকরণ ভাষাকে শ্রুতিমধুর ও প্রমিত করে। সে কঠিন কাজের বোদ্ধা হলেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত অভিধানসমূহ অনেক যা পাঠককে ভাষার বিবর্তন সম্পর্কে ধারণার পাশাপাশি আগ্রহী করে। বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ, বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান অন্যতম।

এছাড়াও রয়েছে- মুকুন্দদাস (জীবনীগ্রন্থ), বাংলাদেশের ফসল (১৯৯৪), বাংলাসাহিত্যে সংস্কারচেতনা : মুসলমান সমাজ (১৯৯৫), অস্পৃশ্যতা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ (২০০৫), বিশ শতকের মুক্তচিন্তা (২০০৮), বাংলাদেশের কোষগ্রন্থ ও শব্দসন্ধান (২০২০), অকারণ ব্যাকরণ (শোভা প্রকাশ, ২০১১)।

৪. খায়রুল আলম সবুজ অভিনয়শিল্পী ছিলেন। বরিশালেরর পূর্ব নারায়ণপুরের উজিরপুর তার জন্ম। তিনি পেয়েছেন দর্শকের ভালোবাসা তাতেই জীবনোচ্ছ্বাস হয়েছিল তাই অন্যকিছু ভাবেননি। বারো বছর বয়সে মঞ্চ নাটক সূর্যমুখীর মধ্য দিয়ে তাঁর আবির্ভাব। পিটিবি ছেড়ে তিনি ঢাকায় এসে নাট্য আন্দোলন শুরু করেছেন। তিনি সমকালীন বিখ্যাত নাট্যজনের নাটকে অভিনয় করেন। সেলিম আল দীন আল মনসুর, সৈয়দ শামসুল হক, আতিকুল হক চৌধুরীর জলের রঙে লেখা এবং সেক্সপিয়রের ওথেলো নাটক। নিজের অনূদিত ফরাসি নাটক আন্টিগোনে দলের প্রধান হয়ে দিকনির্দেশা প্রধান করেন। এভাবে তিনি অভিনয়শিল্পী হিসেবে দর্শকের কাছে জনপ্রিয় হয় ওঠেন। অভিনেতা হলেও সাহিত্যের পরিমণ্ডলে ছিলেন জীবনশিল্পী। ঠাণ্ডা মেজাজে সাহিত্যের শাখায় লেখালেখি করেছেন। তিনি মনে করেন সাহিত্য অন্যান্য কর্মের মতো সমানুপাত রয়েছে।

প্রকৃতির মতো সবুজ তিনি। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসংগ্রামশীল হিসেবে যত সফল বেশি সফল হয়েছেন কর্ম অঙ্গনে। নিজের মেধা মননকে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি অভিনয় ও অনুবাদের শিল্পদক্ষতায় নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছেন। তাঁর অনূদিত গ্রন্থগুলো হলো- এ এনিমি অব দ্য পিপল, দ্য লিগ অব ইয়থ, আকাশের কাছে বাড়ি, গাংচিল ইউরিডাইস, ভালোবাসা বোঝেনি পাখি এবং বুড়ো বট ও শকুন প্রভৃতি। তিনি কাজ করেন ভালোবেসে আনন্দের মাঝে বেঁচে থাকার স্বপ্নে শিল্পবোধ তার মধ্যে প্রবল হওয়ায় সব শাখায় সফল হয়েছেন।

৫. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম মুক্তিযুদ্ধের সিংহপুরুষ। চাঁদপুরের শাহরাস্তি নাওড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। স্বাধীন মানচিত্র ও ভূখণ্ড অর্জনে ১নং সেক্টর কমান্ডের দায়িত্ব পালনে বীরত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনাকালীন সাংবাদিকতা পেশায় আগ্রহ থাকলেও ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধকালীন দক্ষতার সৃজনধর্মী কর্মস্পৃহা ও নানান বিষয় নিয়ে লিখেছেন। তা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের যথার্থ ইতিহাসকে রক্ষা করে তিনি লেখালেখি করেন। তাঁর মূল গ্রন্থ এ টেল অব মিলিয়নস (১৯৭৪) পরবর্তীতে কলেবরে বৃদ্ধি পেয়ে অনূদিত হয়ে ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ নামে প্রকাশ পায় এ নামে তার নিজ উপজেলা শাহরাস্তিতে ম্যুরাল রয়েছে। পাকবাহিনীর হিং¯্ররূপ ও বাঙালির বেদনাবহ যাপিত জীবনের বাস্তবচিত্র নিয়ে লেখা মুক্তির সোপানতলে (২০০১) এছাড়াও তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সমকালীন প্রেক্ষাপটকে নিয়ে লেখালেখি করেন। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি এবং স্বনির্ভর সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিনি সততার সাথে কাজ করছেন। সবচেয়ে বড় কথা স্বাধীনতার ইতিবৃত্ত গ্রন্থিত করে প্রজন্মকে জানান দিচ্ছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে’ বইটি যুদ্ধের দালিলিক খণ্ড। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশ-অনন্যা। প্রকাশকাল-১৯৮১-এ গ্রন্থের প্রতিটি নিবন্ধ সিরিয়াসভাবে পাঠককে আকর্ষণ করে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিবন্ধ নির্বাচন করে উপস্থাপন করলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ শিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভ‚মিকা এবং সীমাহীন দুঃখের দেশ।

ইতিহাসের বোদ্ধা তিনি। ইতিহাসের জ্বলন্তভাষাকে আক্ষরিক করে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধে আপামর জনসাধারণের পাশাপাশি শিল্পী সাহিত্যিকদের ভ‚মিকা প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন। মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য মুজিবনগর বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। অনুষ্ঠানগুলো ছিল নিম্নরূপ- অগ্নিশিখা, বজ্রকণ্ঠ, রক্ত স্বাক্ষর, দর্পণ, জাগরণী, ঐকতান, চরমপত্র, বহির্বিশ্ব ও বিদেশি নাগরিকদের জন্য ইংরেজি অনুষ্ঠান, খবর। বজ্রকণ্ঠের কাজ ছিল বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করে জনসাধারণকে মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত করা এবং বিশ্ব জনমতের কাজ হলো বিদেশিদের জনমত আদায়ে পত্রপত্রিকার সংবাদ প্রকাশ করা। সে সময়ে বিশটির মতো পত্রিকা প্রকাশ হয়েছে। সাহিত্যশিল্প কবিতা গান সংবাদ গণহত্যার চিত্র, বাঙালির কাছে ছিল বেদনা, কখনো অনুপ্রেরণার উৎস। তিনি মনে করেন- “পাকিস্তানিদের অবিশ্বাস্য নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ডের অগণিত ঘটনার বিস্তারিত জানতে পেরে প্রতিশোধের তীব্র দহনে যখন আমাদের সমস্ত সত্তা জ্বলছে অহর্নিশ, তখনই এই সব ছবির আবেদন হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য।”

মুক্তিযুদ্ধে কণ্ঠশিল্পীদের গান কতটা হৃদয়কে স্পর্শ করেছে তা তিনি ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ ও ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’ গানের কথা টেনে নতুনভাবে চেতনার মননকে আবেগতাড়িত করেছেন। মহান মুক্তি সংগ্রামে তার ভ‚মিকার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস প্রণয়ন ও বাস্তবচিত্র উপস্থাপনে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণা শিল্পশাখার মহাপুরুষ হিসেবে প্রজন্মের কাছে নিরবধি থাকবেন।

সাহিত্য মনের খোরাক ও সময়ের বার্তাবাহক। যদি তাতে সমকালীন সমস্যা সমাজ সংস্কৃতি অর্থনীতি, রাজনীতি প্রকৃতি মানবীয় রূপসৌন্দর্য বিদ্যমান থাকে। সাহিত্য আবার সৃজনশীল ক্রিয়াকৌশলের খেলাও বটে। এ খেলায় যারা কাজ করেন তারা সৃজনশিল্পী। তাদের সৃজনকর্মে উদ্বুদ্ধকরণে মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদানে দেশে-বিদেশে রাষ্ট্রীয় ও বিভিন্ন সংস্থা সম্মাননা প্রদান করে। তাতে সৃজনশিল্পীরা আরো মনোযোগী হয়। বাংলা একাডেমি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সাহিত্যশিল্পের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬০ সাল বাৎসরিক সাহিত্য পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছে।

৬. ভ্রমণকাহিনী বিষয়ক লেখক ফারুক মঈনউদ্দীন। সাহিত্যশিল্পে ভ্রমণকাহিনী নতুনমাত্রার সংযোগ হলেও পাঠককে একগেঁয়েমি মুক্ত করে তৃপ্তি দেয়। টেনে নেয় নতুনের সন্ধানে। তিনি সে মাত্রার সংযোগ সাধন শিল্পী। দেশে-বিদেশে ঘুরে ঘুরে সমাজ বাস্তবতা ইতিহাস ঐতিহ্য জীবনধর্মকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিরিয়াস পাঠকের খোরাক হিসেবে উপস্থাপন করেন। সম্প্রতি তিনি নিজস্ব সৃষ্টিসক্ষমতায় পাঠকের মন আঁকড়ে ধরেছেন। তিনি ভ্রমণের স্থান-কালের ব্যাখ্যার চেয়ে বাস্তবতাকে পুঁজি করে সাহিত্যকাঠামোয় তুলে ধরেন। ভ্রমণকাহিনী শিল্পীদের মাঝে তাঁর স্বতন্ত্রস্বভাব রয়েছে তিনি প্রভাবমুক্ত হয়ে তা গড়ে তুলতে আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : সেই সব শেয়ালের, সীমান্তহীন ইউরোপের প্রান্তদেশে, সুদূরের অদূর দুয়ার, সীমান্তহীন ইউরোপ, কেনিয়ার সাফারি, সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর, বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং বেহিসাবীর হিসাব প্রভৃতি। এভাবে তিনি সাহিত্য ও ব্যাংকিং অর্থনীতি নিয়ে লেখে পাঠক সমাজ অর্থনীতি এবং বাস্তবতাকে প্রণোদনা দিয়েছেন।

বহুমুখী সৃজনশীলতার স্বাক্ষর তিনি। চার দশক ধরে সাহিত্যের সঙ্গে তার বসবাস। সব শাখায় তিনি মুখরিত ও আলোকিত। কর্পোরেট কর্মজীবী হয়েও সৃষ্টি সুন্দরের প্রার্থনায় মগ্ন হয়ে ছুটে বেড়ান। লেখেন আত্মজীবনী স্মৃতিকথা, বিশেষত ভ্রমণকাহিনী। তিনি যেখানে যান সাহিত্যের অনুষঙ্গ খুঁজে বেড়ান, স্থল ও জলের মানুষের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব বজায় রেখে তাদের কথা সহজ ও সাবলীল ভাব প্রয়োগ করে ক্লাসিক ফর্ম তৈরি করেন। নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনপ্রবাহ, চালচিত্র, কথাবার্তা কখনো গল্পে কখনো প্রবন্ধ নিবন্ধ স্মৃতিকথা ভ্রমণকাহিনী আকারে সাহিত্যে সংযোগ করেন।

৭. সমকালীন জীবনবোধের নাট্যজন রতন সিদ্দিকী। কর্মচঞ্চল নিখুঁত শিল্পী তিনি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মতো তাঁর সাহিত্যজগৎ নিবিড় ও সুন্দর। অহংকারহীন মানুষ হাসিমুখে বরণ করেন মন ও মনন তার আচরণে নিটোল আর্ট রয়েছে সাহিত্যে রয়েছে শিল্পসৌন্দর্য। আলোর পথে হেঁটে হেঁটে সুন্দরের পথিক তিনি। তিনি বৃক্ষ, সাগর ও সুদূর আকাশের মতো উদার কষ্ট ও যন্ত্রণা ন্যুব্জ না হয়ে সাহিত্য সংস্কৃতি নাট্যপ্রেম প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনাকে ধারণ ও লালন করছেন। জীবন সংকটের জটিল গিটসমূহ নিখুঁতভাবে খুলে ধরেন। তার শিল্পসাহিত্যে পরিমিত শব্দবোধ বিদ্যমান। প্রতিটি পাঠ পাঠককে কাছে টানার মতো। তার ভাষা ব্যবহার চমৎকার হওয়ায় পাঠকের মন আকুল হয়ে যায়।

সাহিত্যের বিবিধ শাখায় তার পদচারণা রয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনবৈচিত্র্য, চিন্তা চেতনা, শিল্প সুষমা, জীবনের সাথে মেলবন্ধন রয়েছে। যুক্তির সাথে মুক্তির মন্ত্রতান তাঁর শিল্পকর্ম অনন্য। যেটি করেছেন মনোযোগী হয়েই উপস্থাপন করেছেন। ফাঁকফোকরহীন লেখক তিনি। খণ্ড বাক্য যা সংলাপ উপযোগী তিনি তা ব্যবহার করেন নান্দনিকতার স্পর্শে। আত্মবিশ্বাসী আপসহীন শিল্পী রতন সিদ্দিকী। নাট্যসাহিত্যে জ্যোতির্ময় ব্যক্তিপ্রাণ। তাঁর সহনশীলতা, মুক্তচিন্তা, মননশীল আবেগ সচ্ছলতা সমন্বয় শিল্পস্বর। তার নাটক পাঠককে বারবার অস্থির করে তাই তিনি শিল্পসফল ও নাট্যজন।

৮. নাদিরা মজুমদার বিজ্ঞানমনস্ক লেখক তিনি। নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তার চিন্তাজগৎ ব্যাপৃত। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন- “বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে যখন দেখি নাদিরা সাংবাদিকতা করছেন, তখনই মনে হয়েছিল তিনি অনেকদূর যাবেন। আসলেই তা হয়েছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ভেঙে তিনি এগিয়ে গেছেন। বিদেশ গেলেও তিনি বাঙালি ছিলেন। বিজ্ঞান ও বাস্তববাদী লেখক তিনি। বিজ্ঞানের রহস্যাদি সহজ ও বোধগম্য করে উপস্থাপন করা ছিল তাঁর লেখার কৌশল। এজন্য তিনি নারী হিসেবে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার ও বিজ্ঞানভিত্তিক লেখায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার ২০১৯ পেয়েছেন। সাহিত্য নতুন জগৎ বিজ্ঞান। এখানে তাঁর অবদান প্রশংসনীয়। তিনি ভেবেছেন এঁকেছেন মানুষ তার জীবনভিক্ষাকে ধারণ করতে আত্মপ্রত্যয়ী হয়েছেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সম্মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। এ জয়যাত্রা তার লেখনী মুখ্য ভ‚মিকা রেখেছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ : এই আমাদের পৃথিবী, একমেরু বনাম বহুমেরু, মহাবিশ্বে আমরাও আছি, বিমান কৃত্রিম উপগ্রহ, আগ্নেয়গিরি ও ভূমিকম্পের কাহিনী, নানা রঙের বিজ্ঞান, আইনস্টাইন সুপার স্টার সময় তুমি কে? প্রভৃতি।

৯. শিশুদের মাঝেই সুপ্ত প্রতিভা লুকিয়ে থাকে। যত্নশীল হয়ে তাদের পরিচর্যা করতে হয়। বাঙালি জন্মগতভাবেই গল্প কবিতা কাহিনী পছন্দ করে ছড়া হলে তো কথাই নেই। দাদি-নানির কোলে মাথা রেখে দোল খেতে খেতে তারা শেখে জীবনের প্রথম পাঠ ছড়া। তরতর করে মুখস্ত করে দিনরাত্রি আওড়াতে থাকে। যেমন- ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গি এলো দেশে ইত্যাদি ছড়া ইতিহাস ঐতিহ্য সমাজ বাস্তবতার সাথে আনন্দের খোরাক হয়ে পাঠক মনে ধরা দেয়। ছড়া পেলে শিশুরা লুটোপুটি খায় এভাবে পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়তে থাকে। ছড়া সাহিত্যের সূচনাকার হলেন দক্ষিণারাঞ্জন মিত্র মজুমদার। সমকালীন সময়ে যারা ছড়া সাহিত্যে শিল্পী রয়েছেন তারা হলেন সুকুমার বড়ুয়া লুৎফর রহমান রিটন, ফয়েজ আহমদ, আমিরুল ইসলাম, ফারুক হোসেন, ফারুক নওয়াজ এবং রহীম শাহ প্রমুখ।

সাহিত্য মর্যাদা লাভ করেছে স্বতন্ত্রসাফল্যে রহীম শাহ তাঁর ছড়াগ্রন্থ শিশু ও বোদ্ধাশ্রেণির মনে রেখাপাত করেছে। ছড়ার বার্তা অনেক দীর্ঘপ্রচলিত- “আব্বু বলে পড়রে সোনা/আম্মু বলে মন দে/কেন আমায় পড়তে হবে/আমি আছি ধন্দে” রং ছবি কবিতায়- “আমি এসে বলি, আমি পৃথিবীর কবি/এই দেখো এক কবিতা লিখেছি আজ/যেখানে রয়েছে ফুল পাখি মেঘ রবি/যেখানে রয়েছে স্বপ্নের কারুকাজ।” প্রকৃতি ও বাস্তবতার নিটোল অবয়বে তিনি ছড়া ছন্দের মেলবন্ধন রক্ষা করে ভবিষ্যদ্বাণী প্রচার করেছেন। এখানেই তাঁর শৈল্পিক সার্থকতা বিদ্যমান। লড়াই লাগার ঘণ্টা, রাতের কপালে জোনাকির টিপ, সবার আগে কুসুম বাগে, পাখির ছড়া পাখির ছড়া, দুধমাখা ভাত কাকে খায় ইত্যাদি। এছাড়া তিনি সম্পাদনা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ : পঁচিশ বছর, পঁচাত্তরের সেদিন এবং বঙ্গবন্ধুকে নিবেদিত ১০১ কিশোর রচনা ইত্যাদি। তাঁর সৃজনকর্ম সুচারু ও রুচিবোধসম্পন্ন। সব বয়সী পাঠকের মন চেতনা ও শক্তিসঞ্চয়ের আঁধার কল্পনা করেছেন তিনি।

ছড়াশিল্পে রহীম শাহ সকলের চেনামুখ। তিনি দীর্ঘদিনের সারথি। কিশোরের মুখে মুখে তাঁর নাম ইতোমধ্যে সমাধৃত হয়েছে কারণ তিনি তাঁর লেখনীশক্তি দিয়ে তা পুঁজি করতে সমর্থ হয়েছেন। সাহিত্য পাঠকশ্রেণির মনোরঞ্জন না হলে টিকে না। তিনি গল্প কবিতা নাটক উপন্যাস ভ্রমণকাহিনী, বিজ্ঞান অনুবাদ সাহিত্যসৃজন করলেও ছড়া সাহিত্য সাফল্যের অংশীদার। শতকের কাছাকাছি তাঁর ছড়ার বই রয়েছে। সাহিত্যের মজার জগতে তাঁর বিচরণ। সমকালের ধারায় আরো ধাবমান হবে এ কথা অনস্বীকার্য।

১০. ফোকলোর সাহিত্যের সমকালীন শিল্পী সাইমন জাকারিয়া। তিনি লোকজ্ঞান সম্পর্কিত অনুষঙ্গ গবেষণা ও উদ্ভাবনে সমকালে কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। ফোকলোর বিষয়ে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর জন্ম লালনশাহের চিরনিদ্রাস্থল কুষ্টিয়া কুমারখালী জুঙ্গলি গ্রামে। পৈতৃকা নিবাস ঝিনাইদহ শৈলক‚পা বসন্তপুর গ্রামে। লোকসাহিত্যে তাঁর অবাদ বিচরণ রয়েছে। বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকসংস্কৃতিকে লোকসাহিত্যে সংযুক্ত করা তার গবেষণা কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের দেশে দুধরনের লোকসাহিত্য রয়েছে লৌকিক ও মৌখিক, ব্যক্তিগত ও বস্তুগত এগুলো আবহমান গ্রামবাংলা ঐতিহ্যগতভাবে বিস্তৃত। মৌখিক লোকসংস্কৃতি হলো- কিচ্ছা, কাহিনী, যাত্রা পালা, নাট্য গীতি, কথা, পুঁথি এবং ধাঁধা প্রভৃতি। অন্যদিকে বস্তুগত হলো- নকশিকাঁথা, কাঠের পুতুল, কাগজ কাটা কারু ও চারুশিল্প এগুলো গ্রামীণ লোকজ উপাদান। যা বাঙালির ঐতিহ্যিক জিনিসপত্র বাংলা সাহিত্যের গ্রামীণ ও লোকজ উপাদান। যা প্রজন্মকে ধারণা আনন্দ ও আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের গ্রামীণ লোকসংস্কৃতি চর্চা ও গ্রন্থিত করা কঠিন কারণ এ অনুষঙ্গগুলোর পরিসর বৃহৎ। চিন্তা-চেতনাকে ধারণ করে পুঙ্খানুপুঙ্খ তুলে এনে পাঠক ও দর্শক সমেত পরিবেশেন করা শ্রম ও ধ্যানের ব্যাপার। সে দুঃসাধ্য কাজে তিনি হাত দিয়ে সফল হয়েছেন। তা সত্যিই আশ্চর্যের বিষয়। আশা করা যায় বাংলাদেশের ফোকলোর সাহিত্য সংগ্রহ, বিকাশ ও পরিবেশনে তিনি আন্তরিক লোকজশিল্পী।

সাহিত্যের রূপরীতি ও কলাকৌশলের অভিভাবক তিনি। সাহিত্যশিল্পী রচনা করেন তিনি তা রচনা ও সৌন্দর্য আনয়নের কৌশল শেখান। তাঁর নিবেদিত পথপরিক্রমায় সৃজনকর্মী খুঁজে পায় রচনার নিয়ম পাঠক মোহিত হয় শিল্পে আসে সার্থকতা। তিনি ভাষানীতি ও ভাষার গঠনশৈলী নিরূপণে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। তাতে বাংলাভাষাভাষী তাদের উৎস এবং ভাষার রূপান্তর সম্পর্কে সঠিক বার্তা লাভ করে। সাহিত্যচর্চা ও সংস্কারশিল্পী হিসেবে রৌদ্রময় হয়ে থাকবেন তিনি।

বাংলা একাডেমি ২০১৯ সৃজনশিল্পের কারণে যাদের পুরস্কৃত করছে তাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব শিল্পস্বর রয়েছে। নিজ অবস্থান থেকে প্রত্যেকেই পাঠক দর্শক এবং বোদ্ধাশ্রেণির মাঝে সময়ের স্বাক্ষর হয়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App