×

মুক্তচিন্তা

রাজনীতিহীনতার কুলক্ষণ

Icon

nakib

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৭:৩৭ পিএম

হরতাল ডেকে নিজেরাই মাঠে গরহাজির। হাতেগোনা কিছু লোক নিয়ে নয়াপল্টনে স্লোমোশন। হরতালের সমর্থনে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানরত দলটির নেতাকর্মীদের সরে যেতে ৩০ মিনিটের আল্টিমেটাম দিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের দেয়া আল্টিমেটামের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই তারা রাস্তা ক্লিয়ার করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চলে যান। জিহ্বার অটোব্রেকে আমতা আমতা।
ভোটে জাল-জালিয়াতির অভিযোগে বিএনপি ঢাকায় ২ ফেব্রুয়ারির সকাল-সন্ধ্যা হরতালকে সফল করার চেষ্টায় কমতি করেছে? মোটেই না। মানুষ সাড়া দেয়নি। একইভাবে এর আগের দিন ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সিটি নির্বাচনকে উৎসবমুখর-অংশগ্রহণমূলক করার চেষ্টাও কম করেনি ক্ষমতাসীনরা। সেই চেষ্টাও সফল হয়নি। মানুষকে কেন্দ্রমুখী-ভোটমুখী করতে পারেনি। মানুষ কেন এভাবে নির্বাচনবিমুখ, হরতালবিমুখ সর্বোপরি রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ল? অকারণে মানুষের এই বিমুখতা? অথবা মানুষকে রাজনীতিবিমুখ করার মধ্য দিয়ে বিরাজনীতির কোনো চেষ্টার ফল? ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে না পারা রাজনৈতিক দল দুটি মানুষকে হরতালের পক্ষে বা বিপক্ষে রাজপথে নামাতে পারেনি। এর মধ্যে নানা প্রিয়-অপ্রিয় তথ্য ও প্রেক্ষিত লোকানো। ঠিকমতো ভোট না হওয়া, ঠিকমতো হরতালও না হওয়ার নতুন ধারার এ রাজনীতি ও গণতন্ত্র অনেক কিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। উঁকি দিচ্ছে নানা শঙ্কাও। সিটি নির্বাচন নিয়ে সিইসি কে এম নুরুল হুদার কিছু মন্তব্য ব্যাপক প্রচার হলেও ছোট একটি মন্তব্য উপেক্ষিত থেকেছে। উত্তরার আইইএস স্কুল এন্ড কলেজে ভোট দিয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, এমন নির্বাচন তিনি চাননি। তা হলে কেমন নির্বাচন চেয়েছিলেন? এ ধাঁচের প্রশ্ন তাৎক্ষণিক তাকে করা হয়নি গণমাধ্যম থেকে। শেষ পর্যন্ত মাঠে থেকে নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ভোট না দিয়ে বিএনপি একদম ঘরে বসে থেকেছে? হরতাল ডেকেও কি চুপ করে বসে থেকেছে? রাজপথে না নেমে কোথায় আনাগোনা করেছে? তাদের পরিকল্পনা ছিল, ‘ভোট দিয়ে কী হবে; আওয়ামী লীগ তো এমনিতেই পাস’- এ প্রচারণা জোরদার করা। সেটা তারা পেরেছে। ভোট দিলে যা হবে, না দিলেও তা-ই হবে, কাজেই কষ্ট করে ভোট দেয়ার দরকার কি? এমন বোধ ও প্রশ্ন সমাজের প্রায় সব স্তরে প্রতিষ্ঠিত হতে আর বাকি নেই। বিএনপি বা মহলবিশেষ এ চেষ্টায় সফলকাম হয়েছে। সাধারণ মানুষই নয়, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও ভোটের তাগিদ নষ্ট হয়েছে- এটা প্রমাণের বাকি নেই। তারা নিজেদের ভোটটা নিজেরা দিলেও ভোটের চিত্র এমন হয় না। এ নিয়ে অবান্তর বা গায়ের জোরে তর্ক করা যাবে। সেই তর্কে জেতার সামর্থ্যও কারো কারো আছে। কিন্তু বাস্তবতা বড় নির্মম। মূল্যহীনের প্রতি মানুষের টান বরাবরই কম। ভোটকে মূল্যহীন করার ষোলোকলা পূরণ হতে আর কত বাকি- সেটা আর প্রশ্নের পর্যায়ে নয়। প্রায় নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ভোটকে বলা হয় মানুষের অধিকার। সেই অধিকার লোকসানের আইটেম হয়ে গেলে সেই ঝুঁকিতে যাওয়ার ঠেকা লেগেছে ক’জনের? এতে প্রকারান্তরে অধিকারটা পর্যবসিত হয়েছে ঘৃণার বিষয়ে। সাধারণ বলা হলেও এই বোধ-বুদ্ধি রাখেন অধিকাংশ মানুষই। অর্থাৎ তারা সাধারণ মানুষ নন, উপলব্ধিতে অসাধারণ। এ সত্যতা না মেনে নানা যুক্তিতে মানুষের ভোটবিমুখিতাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা হালে পানি পাচ্ছে না। বরং হাস্যকর হচ্ছে। একশ বছরের সেরা ভোট, আমেরিকার চেয়ে বেশি ভোটার উপস্থিতি, বিএনপির উল্টাপাল্টা বক্তব্যে ভোটার কমেছে, দেশ উন্নত হয়ে গেছে, ভোট দেয়ার দরকার নেই ভেবে মানুষ কেন্দ্রে যায়নি, ফেসবুকে ব্যস্ত ছিল, শীত ডিঙ্গিয়ে ঘুম থেকে ওঠেনি, দেশে খাদ্য সংকট না থাকায় পোলাও-কোরমা খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, যানবাহনের অভাব ছিল- এ ধরনের কথাবার্তায় মানুষকে খুচরা বিনোদন দেয়া গেছে। নিজেদের তাচ্ছিল্যের নিশ্চয়তা মিলেছে। কিন্তু মূল সত্যকে আড়াল করা যায়নি। সচরাচর জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে সিটি করপোরেশনের মতো স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বেশি থাকে। কারণ সেখানে কাউন্সিলর প্রার্থীরা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনতে ভ‚মিকা রাখেন। এবার সেটাতেও ভিন্নতা। দুই সিটি মিলিয়ে ভোট পড়েছে মাত্র ২৭.১৫ মাত্র। ১৬-১৭ শতাংশ জনসমর্থনেই মেয়র। মোট ভোটারের ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ আওয়ামী লীগের ভোটার। এই পরিমাণ ভোট আওয়ামী লীগ সব সময়ই পেয়ে থাকে। সেই হিসাবে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের ভোটার ন্যূনতম ১৯ লাখ। সেখানে এবার আওয়ামী লীগের দুই মেয়র প্রার্থী মিলিতভাবে ভোট পেয়েছেন এর অর্ধেকের চেয়েও কম। একেবারে ডাইহার্ড ভোটারদেরও এমন ভোট ও রাজনীতিবিমুখ হওয়া যে কোনো দলের জন্য হলুদ সংকেত। ভোটের এমন লাইনচ্যুতি ভাবনার বিষয়। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালের ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকার দুই সিটিতে গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। ওই নির্বাচনের মধ্যে বিএনপি ভোট থেকে সরে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ঢাকার দুটি আসনে ইভিএমে ভোট হয়। এই দুই আসনে ভোট প্রায় ৪৩ শতাংশের মতো পড়ে। বাকি আসনগুলোয় ভোটার উপস্থিতি ছিল ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশের মতো। এর বিপরীতে এমন নির্বাচনবিরোধী আন্দোলনও মাঠে মরেছে। অথবা মাঠ পর্যন্ত আসতেই পারেনি। অক্কা গেছে তার আগেই। মানুষ তাদের পিঠ দেখিয়েছে অনেক আগেই। হরতাল ডেকে নিজেরাই মাঠে গরহাজির। হাতেগোনা কিছু লোক নিয়ে নয়াপল্টনে স্লোমোশন। হরতালের সমর্থনে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানরত দলটির নেতাকর্মীদের সরে যেতে ৩০ মিনিটের আল্টিমেটাম দিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের দেয়া আল্টিমেটামের মাত্র তিন মিনিটের মধ্যেই তারা রাস্তা ক্লিয়ার করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চলে যান। জিহ্বার অটোব্রেকে আমতা আমতা। কিছু করতে না পেরে গুডবয় পলিটিক্স। নির্বাচন, আন্দোলন সর্বোপরি রাজনীতিকে এমন রম্য-রসিকতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার খেসারত কে কীভাবে দেবেন- এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার হলেও আলামত ভালো কিছুর সায় দিচ্ছে না। সাধারণ নামে সম্বোধন করা মানুষের পাশাপাশি অসাধারণ মহলের মতিগতিও কিছু বার্তা দিচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সিটি নির্বাচনের দিন বিভিন্ন জায়গায় কয়েক সাংবাদিকের নিপীড়িত হওয়ার কথা। পেশাগত কাজের সময় সাংবাদিকরা হামলার শিকার হয়েছেন। পিটুনিতে রক্তাক্ত হয়েছেন। তাও ঘটনার পর্যায়ে পড়েনি। এমনকি সাংবাদিক মহলেও নয়। এমনকি সাংবাদিক সংগঠনগুলো গা মাখেনি। কিছু বলেনি। সবকিছুতে তাচ্ছিল্য-অগ্রাহ্য, গা বাঁচানো অথবা গাসহা ভান করার মধ্য দিয়ে আরো নিশ্চিত হচ্ছে অসুরের জয়জয়কার। অবশ্য সব মানুষের নয়। রাজনীতিসহ বিভিন্ন সেক্টরের ধড়িবাজ-চতুর শ্রেণি এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ছাড়ছে। জনগণের অংশ হিসেবে এরা বেদম তৎপর এদিকে-ওদিকে। রাজনীতিহীনতার সুযোগে কখনো কখনো অবস্থান বদলায় মাত্র। উন্নয়নের সুযোগ নেয়। উন্নয়নের সমালোচনার সুযোগও নেয়। ভিন্ন ভিন্ন নামে, একই কামের এ কামলারা জনগণের বাইরে কেউ নন। পদ, প্রশাসন, পুলিশ, পয়সা- সব প-এর প্যাঁচে ভাগ বসানো গুণধররাও জনগণেরই অংশ। হতে পারে এটা অল্প মানুষের হাতে বিপুল সম্পদ কেন্দ্রীভ‚ত হওয়ার রাজনৈতিক অর্থনীতির জের। কিন্তু ভাগের মোহ কম নয় জনগণের কাতারে থাকা এই শ্রেণিরও। রাজনীতির জন্য কি এটা ভালো লক্ষণ? মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App