×

অর্থনীতি

বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১০:২১ এএম

বেসরকারি বিনিয়োগে ভাটা

বেসরকারি বিনিয়োগ।

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হচ্ছে বেসরকারি বিনিয়োগ। অথচ বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি দিন দিন নিচের দিকে নামছে। একটানা ৬ মাস ধরে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমে নভেম্বরে এক অঙ্কে এসে ঠেকেছে।

এদিকে বড় প্রকল্পগুলোর কারণে হু হু করে বাড়ছে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ। ব্যাংক ঋণে উচ্চ সুদহার, খেলাপির ঋণের উর্ধ্বগতি, ব্যাংকের তারল্য সংকট ও সরকারের ঋণের প্রভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি বাড়ছে না বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সংশোধন এনেছে তা ব্যবসাবান্ধব হয়নি বলে মনে করেন তারা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের নভেম্বরের তুলনায় সদ্যবিদায়ী ২০১৯ সালের নভেম্বরে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ- যা আগের মাস অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। জুলাই শেষে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ। জুনে ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে যা ছিল ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের মাস এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে ছিল ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ব্যাংকাররা তারল্য সংকটে ভুগছে। সরকার বেশিরভাগ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নিয়েছে। এদিকে ব্যাংকের আমানত কমে যাচ্ছে। সুতরাং ব্যাংকগুলো এখন বড় বড় গ্রহীতা ছাড়া ঋণ দিতে আগ্রহী হচ্ছে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা হয়েছে সেখানে সরকারি বিনিয়োগ বাড়বে দেখানো হয়েছে। ব্রডমানি বাড়বে কিন্তু সেটা সরকারের। সুতরাং এটা কোনো ব্যবসাবান্ধব মুদ্রানীতি হয়নি। ব্যাংকের জন্যও ভালো কিছু হয়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

চলতি (২০১৯-২০) অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সংশোধন এনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংশোধিত মুদ্রানীতিতে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। এর মধ্যে ডিসেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত লক্ষ্য ঠিক করেছে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ; যা গেল অর্থবছরের জুন পর্যন্ত ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে এ খাতের ঋণপ্রবাহের লক্ষ্য ছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু গত জুন শেষে এ খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল মাত্র ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ। এটি গত অর্থবছরের ঘোষিত মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৫ শতাংশ কম। অন্যদিকে চলতি অর্থবছর (জুলাই-জুন) পর্যন্ত সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ৯০ শতাংশ। অথচ সরকারি খাতে ঋণ বাড়তে বাড়তে নভেম্বরে তা ৫১ শতাংশ ছাড়িয়েছে।

জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে ৪৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকা। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাস ১৫ দিনেই (১ জুলাই, ২০১৯ থেকে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত) ৫০ হাজার ৮৪২ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে সরকার। অর্থাৎ পুরো অর্থবছরে (১ জুলাই থেকে ৩০ জুন) ব্যাংক থেকে সরকারের যে টাকা ধার করার কথা

ছিল তার চেয়ে ৩ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা বেশি ছয় মাসেই নিয়ে ফেলেছে। সবমিলিয়ে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে নেয়া সরকারের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯৩৭ কোটি টাকা। বিশ্লেষকদের মতে, এখনো বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে আস্থার সংকট রয়েছে, বিশ্বব্যাংকের ইজি অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে এখনো কাক্সিক্ষত উন্নতি হয়নি, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ না থাকা, অবকাঠামো দুর্বলতাসহ নানা প্রতিবন্ধকতায় বাড়ছে না বেসরকারি বিনিয়োগ।

সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক খাতের উন্নয়ন ঘটাতে বেসরকারি বিনিয়োগের গতি বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আমাদের প্রথম ৬ মাসের যে প্রবৃদ্ধি সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের যে মুদ্রানীতির প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক কম। বর্তমানে যে মুদ্রানীতি সংশোধন করা হয়েছে, সেখানে আরো কমানো হয়েছে। কিন্তু এটা তো কোনো সমাধান নয়। তিনি বলেন, আমরা এ প্রবৃদ্ধিটাকে আরো কিভাবে বাড়াতে পারি, সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।

এ দিকে মনোযোগ দিতে গেলে ব্যাংকিং খাতে যে অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে, অর্থাৎ খেলাপি ঋণ দিন দিন বেড়ে চলছে, প্রভিশন ঘাটতি অধিকাংশ ব্যাংকের। এসব সমস্যা সমাধান না করে আমরা ঋণের সুদের হার কমাতে পারব না। আর সুদের হার কমাতে না পারলে বেসরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধিও বাড়ানো সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়ত, সরকারও এখন ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বেসরকারি খাতের ওপর এটারও একটি প্রভাব পড়েছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে সেগুলো চিহ্নিত করা, খেলাপি ঋণ কমানো না গেলে বেসরকারি বিনিয়োগের যে স্থবিরতা সেটা কাটানো সম্ভব হবে না। এ জন্য আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো যথাসময়ে সঠিকভাবে সম্পন্ন করা হলে, আমাদের কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস কমানো হলে, আমাদের অর্থনৈতিক খাতের যে টালমাটাল অবস্থা, সেইসঙ্গে শেয়ার মার্কেটের ধস- এগুলো যদি চিহ্নিত করে সমাধান করা যায় তবেই বেসরকারি বিনিয়োগে গতি ফিরে আসবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App