×

সাময়িকী

প্যাসিফিকে পাঁচ রজনি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:১০ পিএম

[ পর্ব : ৯ ] ভ‚মধ্যসাগরের খোলা হাওয়া মাখামাখি করছিল শরীরে। তখন একজন মেয়ে মানুষের দালাল আমার ঘনিষ্ঠ হতে চাইল। পৃথিবীর প্রায় সবখানেই আবাসিক হোটেলের ধারেকাছে কিছু লোকজন তাদের নারীদের জন্য খদ্দের খুঁজে বেড়ায়। লোকটি মিশরীয়। বুঝতে পারি সে আমাকে অনুসরণ করছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলে সেও থেমে পড়ে। দিক পরিবর্তন করলে সেও দিক বদলিয়ে আমার পিছু নেয়। রাস্তায় বেশ লোকজন। ভয়ের কিছু নেই। নির্বিকার কিছুক্ষণ হেঁটে চললাম তাই। এক সময় ঘুরে দাঁড়িয়ে ভালো করে তাকালাম অনুসরণকারীর দিকে। মিশরীয়টির বয়স ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে হয়তো। একটু এগিয়ে এসে সে তখন সঙ্কোচের সঙ্গে বলল, কয়টা বাজে? সময় বলে রাস্তা পেরুনোর জন্য জেব্রা ক্রসিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। যুবকটিও রাস্তা পেরিয়ে আমার পিছু নিল। না, এখন আর আড়াল রাখা চলে না। ঘুরে সরাসরি জিজ্ঞেস করি, কী চাও তুমি? মনে হলো একটু থতমত খেল সে। জবাব দিল, আমার কাছে একটি জিনিস আছে। কী? খাওয়ার। যুবকটি মনে হয় এই প্রাচীন লাইনে নতুন। কীভাবে ওর কথাগুলো বলবে জানে না। ইংরেজিও ভয়ানক দুর্বল। বললাম, যা বলবে ঠিকমতো বলো। একটু হুইস্কি আছে একসঙ্গে খেতাম। ও গ্রেট। পৃথিবীতে এত মানুষ থাকতে আমাকেই তোমার উপযুক্ত সঙ্গী মনে হলো। যুবকটি কথা পাচ্ছে না। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন বিদেশিকে সে বিনে পয়সায় মদ্যপানের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এর পেছনে কী যুক্তি আছে তা তার মাথা কিংবা ভাষা কোনোটাতেই নেই। লোকটির ইঙ্গিতে বুঝতে আসুবিধা হয় না সে আসলে দালাল। কিন্তু চৌকশ নয়। প্রস্তাব পেশ করতে তাই বøা বøা করছে। একবার প্যারিসে হোটেল হিলটনে এক মাদমোয়াজেল লক্ষ্যবস্তু করেছিল আমাকে। হোটেল লবিতে একটুখানির জন্য বসেছি সবে। পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী লা সেইন। দেখি সামনে সোফায় সুবেশী এক ফরাসিনী। তরুণী। হাতে নিউ ইয়র্ক টাইমস। যতবারই চোখাচোখি হয় ঠোঁটে হাসি ধরে তাকিয়ে থাকে- থাকে না। এরপর সে যা করে তাতে আমি হতচকিত হয়ে যাই। মেয়েটি চোখে স্পষ্ট ইশারায় যেন বলে, ‘আমি ডাকানো জোয়ারের সেইন। চল আমাতে আজ সাঁতার কাটবে।’ প্রচÐ ব্যস্ততায় আমার তখন মরার সময় নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই মুহূর্তে হিল্টন হোটেলে। হুপো বোয়াগনি শান্তি পুরস্কার নিতে তিনি প্যারিস সফর করছেন ইউনেস্কোর আমন্ত্রণে। এর বাইরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক এবং সামনের কাতারের দৈনিক ল্য মন্দের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। আমরা ওঁর সফর আয়োজন, সমন্বয় ও বাস্তবায়ন করছি। মাদমোয়াজেলের আহ্বান আমার জন্য ভয়ানক বিপদের। আমার মতো একজন বাদামির সাড়া না পেয়ে সাদা মেয়েটি খুব অপমানিত বোধ করে। বুঝতে অসুবিধা হয় না সে আসলে একজন টপ এসেলোন কলগার্ল। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে রেস্তোরাঁর দিকে চলে যায় মেয়েটি। পৃথিবী জুড়ে সেক্স আজ বিলিয়ন ডলার বিজনেস। প্যারিসের চার পাঁচ বছর পরে হ্যানয়ে এরকম যৌন সন্ত্রাসের মুখে পড়েছিলাম একবার। ব্যাংকক মিশন হতে সেখানে গেছি এশিয়া-প্যাসিফিক এলাকার একটি আঞ্চলিক কেন্দ্রের গভর্নিং বডির বৈঠকে। থাকছি হোটেল মেলিয়া হ্যানয়-এ। স্প্যানিশ বিনিয়োগের মেলিয়া আন্তর্জাতিক চেইন হোটেল। রাজধানী হ্যানয়ের অন্যতম অভিজাত এলাকায় অবস্থিত। ফরাসি, ভারতীয়, তুর্কি, কিউবান দূতাবাসসহ অনেকগুলো রাষ্ট্রের মিশন এখানে। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে বর্তমানের গুটিকয়েক সমাজতান্ত্রিক দেশ এখন আর কট্টর ভাবধারানুযায়ী পরিচালিত হতে পারছে না। এখন তাদের বাজার, আকাশ, বিনিয়োগক্ষেত্র প্রায় উন্মুক্ত। পুঁজিবাদী জীবন স্যাটেলাইট টিভির সুবাদে তাদের ঘরে সহজেই দৃশ্যমান। ভালোর সঙ্গে মন্দটিও তাই সংগোপনে প্রবেশ করেছে তাদের জীবনাচারে। এর একটি হলো সেক্স ট্রেড। সমাজতান্ত্রিক দেশে পেশা হিসেবে পতিতাবৃত্তি কখনো ছিল না। কিন্তু বিশ্বায়ন সেক্স ট্রেডকে বিস্তৃত করেছে সর্বত্র। ভিয়েতনামেও। আমরা যখন মেলিয়া হ্যানয় থেকে বের হই দু-একজন মাঝেমধ্যে পিছু নেয়। মোটর বাইকে। ফুটপাত ঘেঁষে চলতে চলতে আস্তে করে বলে, লাগবে নাকি হাফ রেটে ফাইভ স্টার গার্ল। আমরা জবাব দেই না। আছে সায়গন থেকে আসা ফ্রেঞ্চ কাটিং মাল। আমরা চলতে থাকি। পুলিশের ভয় নাই। আমরা দূরে সরে যেতে যেতে শুনি, নীল ছবির সঙ্গে জীবন্ত নীল নায়িকা। হ্যালো, হ্যালো ভিলেজ গার্লও আছে। সাড়া না পাওয়ায় তারা মোটর বাইক ঘুরিয়ে নেয়। বাংলাদেশও এই পেশায় যথেষ্ট এগুনো। আমার ঢাকার জীবনে বহুকাল প্রায় প্রতিদিনের যাতায়াত ছিল রমনা এলাকা দিয়ে। একবার পার্কের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি অপরাহ্নের পর, হাত কচলানো ভাব নিয়ে এক প্রৌঢ় পাশে হাঁটতে থাকল। কিছুক্ষণ পর বলে, ভাইসাহেব কিছু লাগবে? কী? কচি খিরা। কই? খিরা তো দেখছি না। আছে। বাসাবোর ফ্ল্যাটে। যে রকম চান- কলেজ গার্ল থাইকা একেবারে ঝুনা মাসি পর্যন্ত। মানে? একেক জনের খিদা, রুচি একেক রকম। আমি মানুষটিকে ভালো করে দেখি। পরনে প্যান্ট শার্ট, ধুলোয় ঢাকা জুতো। গালে দু-একদিনের দাড়ি। লোকটি তাহলে মেয়েদের জন্য খদ্দের ধরে দিন পার করে। একজন সত্যিকার পুরুষ এই পেশা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। আর দালালটির আমাকে দেখেই কিনা মনে হয়েছে আমি কচি খিরার তৃষ্ণায় কাতর। হাঁটতে থাকি। লোকটি আমার বুকের ক্ষরণ দেখতে পায় না। আমি জানি, প্রতি সন্ধ্যায় রমনার কিনারে শরীর কেনাবেচায় দরদাম চলে। অনেক দেহপসারিণী পুরো এলাকায় শ্যাওলার মতো ভেসে বেড়ায়। তারা নানা বয়সের নানা রূপের। তাদের মাঝে আছে একজন মা পতিতা। দুটো ছেলে তার। বড়টির বয়স পাঁচ-ছয়- ছোটটির দুই হবে হয়তো। রাতে সড়ক ভবনের উল্টো গেটে বসে। সাজগোজ করে। খদ্দেরের আশায়। রিকশায় আসতে যেতে তার চোখে কোনো লজ্জা, ভীতি দেখি না। খদ্দের তার আশপাশের মজুর, দারোয়ান, রিকশাওয়ালা হবে হয়তো। যখন কাজে যায় বড় ছেলেটি ছোটটিকে সামলায়। ফুটপাতে লাইট পোস্টের নিচে তারা খেলা করে। ছোটটি রাস্তায় নেমে গেলে বড়টি আগলায়। ষোলো বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধ করেছি। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলা আজো হয়নি। চোখ আমার অশ্রুতে ভরে ওঠে। উত্তর দিলাম, লোকাল গার্লও আছে নাকি এই ব্যবসায়। আমি তো মনে করেছি শুধু ফিলিপিনোরাই। আছে স্যার। কিন্তু ফিলিপিনোদের সঙ্গে টিকতে পারছে না। রেট কম আর তারা ব্যবসার পরিবেশও খারাপ করে ফেলছে। আমার অনুসন্ধানমূলক প্রশ্নে ওয়েটকে উদ্দীপ্ত মনে হলো। পরিবেশ নষ্ট করছে মানে? এই নানা রকম অসুখ বিসুখ আর কি? লোকাল গার্লদের মধ্যে ওসব পাবেন না স্যার। সলিড জিনিস। সুইট সলটি বডিতে কিছু ঢুকতে পারলে তো। তা তুমি এই পেশায় কতদিন আছ? একদম নেই স্যার। আপনাকে দেখে ভালো লাগছে তাই মনে করলাম কোনো দরকার আছে কিনা। আমি তখন ভাবছি তাহলে এই জন্য ওয়েট সারাদিন আমার পেছনে অধ্যবসায়ী দালালের মতো লেগে আছে। আমার নিরাপত্তার জন্য ওর উদ্বেগ ঘনিষ্ঠ হবার একটি সুযোগ খোঁজা হয়তো। রসিকতা করে বললাম, তা তুমি তো অনেক দেরি করে ফেলেছ। আমি তো সকালেই বলতে চেয়েছিলাম স্যার। সকালে নয়, বছর তিরিশ-বত্রিশ আগে বললে হয়তো চিন্তা করে দেখা যেত। ওয়েট বোঝার চেষ্টা করছে আমি কী বলতে চাইছি। একটু হতাশ লাগছে তাকে। উত্তর দিল, কিন্তু তখন তো আমার জন্মই হয়নি স্যার। তাহলে বোঝ এমন একজন বয়স্ক মানুষকে এমন একটি প্রস্তাব করা ঠিক হচ্ছে কি না। আমার কথা ওয়েটের মনঃপূত হলো না। কারণ সে তো ভালো করেই জানে এসব ব্যাপারে বয়সিরাও কম আগ্রাসী নয়। তবে এ নিয়ে সে আর কোনো কথা বলল না। আমি তাকে দশটি ডলার দিলাম। যা খদ্দের ধরার কমিশন থেকে হয়তো অনেক কম। রক আইল্যান্ডস ট্যুর থেকে ফেরাটা ছিল আমাদের জন্য ভয়ংকর। সারাদিনের আনন্দ তখন আর কারো মধ্যে নেই। থাকার কথাও নয়। সাত ঘণ্টার ট্যুর শেষে হ্যারল্ড আমাদের কোরোরে ফিরিয়ে আনছিল। অন্য পথে। ফিরতি যাত্রা যখন শুরু হলো তখন স্বস্তি পেলাম চারটে সাড়ে চারটের মধ্যে ফিরতে পারব বলে। সে স্বস্তি যে আধা ঘণ্টা পরেই উধাও হয়ে যাবে কে জানত। (আগামী পর্বে সমাপ্ত)

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App