×

সাময়িকী

কামাল চৌধুরীর কবিতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জানুয়ারি ২০২০, ০৬:৩৮ পিএম

কামাল চৌধুরীর কবিতা

কামাল চৌধুরী

কামাল চৌধুরী বাংলাদেশের কাব্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন সত্তরের দশকের মাঝামাঝি। প্রথম কবিতার বই বেরোয় ১৯৮১ সালে। তারপর আরো সাতটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ বেরোলো তার কবিতা সংগ্রহ। কবিতা সংগ্রহটি আগাগোড়া পড়ার পর আমার মনে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কামাল চৌধুরী লিখতে চেয়েছেন সর্বার্থে আধুনিক কবিতা। এ কালের একজন কবি- যার বয়স এখনো ষাট হয়নি, তিনি এমনটাই চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আধুনিকতার তো নানা মাত্রা আছে। বিভিন্ন কাল পর্বের আলাদা বৈশিষ্ট্য দ্বারা তা চিহ্নিতও। রবীন্দ্রনাথও আধুনিক, কল্লোল যুগের কবিরাও আধুনিক, পরবর্তী একাধিক প্রজন্মের প্রাগ্রসর কবিরাও তাই। সেক্ষেত্রে কামাল চৌধুরীর মতো কবিদের আধুনিকতা প্রকাশিত হয়েছে কীভাবে? তারা কি নতুন কোনো চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটাতে পেরেছেন তাদের কাব্যসাহিত্যে?

খুব অসাধারণ মাপের সাহিত্যিক ছাড়া নবচেতনার উন্মেষ হয় না কখনো। মামুলি রীতিতে কবিতা লিখেছেন। অথচ ব্যতিক্রমী চিন্তা ধারণ করেন- এমনটা দেখা যায় না। অন্যদিকে কামাল চৌধুরীর মতো কবিরা সচরাচর পুরনো ভাবধারাটিই নিজস্ব ভঙ্গিতে পরিবেশন করে চলেছেন। হঠাৎ হঠাৎ দু-চারটি কবিতায় নতুন বিষয়বস্তু এসেছে। আরো ভালো হতো- যদি সেসব লেখা দেহে ব্যতিক্রমী শৈলী ধারণ করতে পারত। দৃষ্টান্ত ‘নিরুত্তর শব্দবাক্য’ পৃ. ৬৩, ‘যমজ’ পৃ. ৭৬, ‘চ‚ড়া’ পৃ. ১৩৩, ‘কাবুলিওয়ালা আমি শুধু আজ রাতে’ পৃ. ১৪৮, ‘ছাত্রীনিবাস’ পৃ. ২৬৩, ‘প্রসারণ’ পৃ. ২২৬, ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো’ পৃ. ২০২, ‘জলবায়ু পরিবর্তন : কিয়োটো সম্মেলনের ডায়েরি থেকে’ পৃ. ১৮৮ প্রভৃতি।

ব্যক্তিগত ভাবনা, আত্মগত ভাবোচ্ছ্বাস, অপরিশুদ্ধ আবেগ এবং শব্দ ব্যবহারে কাক্সিক্ষত পরিমিতির অভাব কামাল চৌধুরীর প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থে বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তার পরকালের কবিতাগুলোয় এসব জিনিস একদম নেই, তা নয়। তবে বয়স ও অভিজ্ঞতার কারণে পরবর্তী অর্থাৎ চতুর্থ, পঞ্চম কাব্যগ্রন্থে সেগুলো আশাপ্রদভাবে কমে এসেছে। শেষের দুটি কবিতার বইয়ে দেখতে পাচ্ছি পরিণত ভাব-কল্পনার ও নিয়ন্ত্রিত আবেগের সুচারু প্রয়োগ। পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে আমি প্রথম দিকের কবিতা থেকে দুটি এবং শেষের দিকের বইগুলো থেকে দুটি করে উদ্ধৃতি দিচ্ছি- এক. সবকিছু আজ ভুলতে পারি নদীর নাচন, নোংরা বচন, প্রেমের পচন তুই সেখানে মাতম নগর, কিশোর শহর-ভুলতে পারি? (শৈশবের জন্য মাতম/মিছিলের সমান বয়সী) দুই. আজ বাতাসের মন খুব ভালো আজ তার বেড়াবার শখ মাঝরাতে নক্ষত্র জ্বেলেছে আলো জোছনা ঠিকরে পড়ে রাত্রির উদ্যানে পাতা নড়ে নিজের মর্মরে ঝড়ো বাতাসের টানে। (আজ বাতাসের মন/এই পথ এই কোলাহল)

ক. প্রতিটি মুহূর্ত থেকে সময়ের সুধাবিন্দু তুলে প্রতিটি মুহূর্ত থেকে অপার্থিব লতাগুল্ম তুলে রাতজাগা পাখিদের নিমন্ত্রণ ডানায় লুকিয়ে আকাশে উড়বো আমি হিমবাহ পাহাড় চ‚ড়ায় (পর্ব-১৩ ‘ভ্রমণকাহিনী’/এই মেঘ বিদ্যুতে ভরা) খ. ওভারকোটের ভেতর ঢুকে থাকা শীত ঘাপটি মেরে বসে থাকল মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ওজোন স্তরের সবগুলো ফুটো কচ্ছপের উঁচু পিঠে সমুদ্র ধাবিত হচ্ছিল পৃথিবীর দিকে সেও অকস্মাৎ লজ্জা পেয়ে পিঠ ডুবিয়ে দিল জলে। (... কিয়োটো সম্মেলনের ডায়েরি থেকে/ধূলি ও সাগর দৃশ্য)

কবিতায় ব্যক্তিক ভাবানুষঙ্গ (ঝঁনলবপঃরারঃ) দোষের বিষয় নয়। তবে পাঠকের প্রত্যাশা এমন যে, ওই আত্মঅনুভব রাশি অনেকের ব্যক্তি অনুভব হয়ে উঠুক। এ রকম ঘটলে সেই কবিতার দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং কামাল যখন বলেন, ‘এ শহরে অনেক পিঁপড়ের ভিড়ে আমি বাস করি’ কিংবা ‘সব রোকেয়ার সাখাওয়াত দরকার’- তখন মনে হয় তার এ ধরনের কিছু পঙক্তি অনেক দিন পরও সজীব থাকবে। কিন্তু ‘জেনেছি বিরহে পোড়ানো রূপের ধর্ম’, অথবা ‘আলিঙ্গন তীব্র হলে ভালোবাসা শ্বাসকষ্টে ভোগে’ জাতীয় চিরকালীক উপলব্ধি ঋদ্ধ উচ্চারণ ‘কবিতা সংগ্রহ’-এ মাত্র অল্প কয়টি। যে রোমান্টিকতার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া হিসেবে আধুনিক কবিতার জন্ম, এর ভেতরেও আমরা রোমান্টিক কবিতার অসংখ্য উপাদান দেখতে পাচ্ছি। বরং কারো কারো কবিতায় রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্যই বেশি করে প্রতিভাত হতে দেখেছি। সেই শতাব্দী প্রাচীন ফুল, চাঁদ, নদী, জ্যোৎস্না, শৈশবকাতরতা, নস্টালজিয়া, আবেগাপ্লুত নারী প্রেম, যুদ্ধ, বাউণ্ডেুলেপনা ইত্যাকার থিম প্রধানত, রোমান্টিক কবিতার কুলক্ষণ হিসেবে ষাটের দশকে এবং ব্যাপকভাবে সত্তরেও চর্চিত হয়েছে। ওই সনাতন বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেননি কামাল চৌধুরীও। অবশ্য ব্যক্তিগত কুশলতার কারণে সত্তরের প্রজন্মের অল্প কয়েক কবি কিছুটা স্বাতন্ত্র্য দেখাতে পেরেছেন। কামালের বেলায় ওই লিপিকুশলতা কীভাবে চেহারা পেয়েছে দেখুন-

১. নারীদের চেয়ে বড় কোনো পাখি নেই (পৃ.২৩)। ২. বৈশাখ আসুক ফের ফেরিঘাটে আমাদের যোগাযোগ হবে (পৃ. ৫২)। ৩. পথ শুধু চা বাগান, দিন শুধু পরিচিত টিলা (পৃ. ৫৯)। ৪. বোনের আঁচল থেকে ধ্রুবতারা খসে খসে আলো জ্বেলে যাবে (পৃ. ৯৬)। ৫. জানতে চেয়েছি শুধু পাখি কেন চাঁদ সন্ধ্যাতারা কেন ফুল-নক্ষত্র কেন প্রবাহিত নদী আকাশ কেন এত অন্তহীন তবে? (পৃ. ১৩০)। ৬. আমি আড়িপেতে শুনে ফেলি শালিকের চুম্বনের শব্দ (পৃ. ২৫২) ৭. প্রতিদিন একটি আকাশ নেমে যাচ্ছে দূর ধানক্ষেতে (পৃ. ২৫২) ৮. উখিয়ায় এক রাত্রি। সমুদ্রের উচ্ছ্বাসের নেশা পানপাত্র ঢেলে দিয়ে মৎস্যকন্যা তারস্বরে ডাকে (পৃ. ১৬২)। ৯. হেভি মেটালের শব্দে মৃত রবীন্দ্রনাথের পাশে ঘুমিয়ে পড়ে আমাদের সব নদী (পৃ. ২৭০)। ১০. পাহাড় ঘুমায় কবিদের পাশে অন্ধকারে আমি দেখতে পাই ফর্সা মেয়ের কালো চুল আমি জানি বীজ কেমন করে হয়ে ওঠে পাতা (পৃ. ১৩৭)। ১১. খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পাচ্ছি বহুজাতিক আগুন (পৃ. ২৫০)।

কামাল চৌধুরীর কবিতা মিশ্র অনুভূতির জন্ম দেয়। তিনি প্রধানত রোমান্টিক আবার আধুনিকও। মূলত প্রথানুগ এই কবি কখনো কখনো প্রথাগত কাব্যের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে তা পেরেছেনও। ছন্দ তার কবিতার এক উল্লেখযোগ্য দিক। তবে বিশুদ্ধ গদ্যকেও তিনি অনেকবার ব্যবহার করেছেন। ওই গদ্য যখন সৃজনী মাত্রা অর্জন করেছে, কেবল তখনই তা হয়ে উঠেছে ফলপ্রসূ। কয়েকটি অসাধারণ কল্পচিত্রও আমরা পাচ্ছি তার কবিতায়। ক. তখন বিন্দুকে মনে হয় প্রসারিত, স্তব্ধতাকে মনে হয় অন্তর্গত পরিব্যাপ্ত নদী। তখন একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গের মাঝখানে দিগন্তের দীর্ঘ হাতঘড়ি ক্রমাগত ছুটতে থাকে সঙ্গীতের উৎসের দিকে। (প্রসারণ/রোদ বৃষ্টি অন্ত্যমিল) খ. মরে গেলে মানুষেরা হাড় হাড় থেকে তীব্র তাজা ফুল এই দেশে অনেক বকুল মুক্তি চেয়ে মরণে অসাড় (শহীদ জননী/এসেছি নিজের ভোরে) গ. বহুবার ঘুমে আমার মৃত্যু হবে- বহুবার বকুলের গন্ধে আমি জেগে যাব... আমাকে জানতে হবে কতটা উপরে চ‚ড়া আমার মাথার চেয়ে কত উঁচু? (চূড়া/ঐ)

কবি কি কেবল কল্পরাজ্যের বাসিন্দা? তা কখনো কখনো হতে পারে বৈকি। সামগ্রিকভাবে এটি উনিশ শতক বা এরও আগের ধারণা। আধুনিক কবিকে তার যাবতীয় রোমান্টিক ভাব-কল্পনা সত্ত্বেও জীবনের সত্য তুলে আনতে হয়। কখনো বা প্রাত্যহিক জীবনের অভিজ্ঞতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওই সত্য। কামালের কবিতায় এর রূপায়ণ ঘটেছে এভাবে-

এক. কোনদিকে যাই আকাশ অনেক দূর সুদূর এখন স্বাস্থ্যবতী গাই এক বাজারে মাসের পকেট ফুটো আর ক’টা দিন আশার বাণী খাই। (দ্রব্যমূল্য/টানাপড়েনের দিন) দুই. প্রতিটি মুহূর্তজুড়ে এক নারী ভালোবেসে তার চতুর্পার্শ্বে অনতিক্রম্য এক বৃত্ত এঁকে রাখে (নিরুত্তর শব্দবাক্য/ঐ)। হ্যাঁ, আশার বাণী খেয়েই তো আমরা বেঁচে আছি এই ভাগ্য বিড়ম্বিত বাংলাদেশে। আর যারা একই সঙ্গে গৃহী ও বাউল স্বভাবী, তারাও কি সংসারের সুতা ছিন্ন করে একেবারে চলে যেতে পেরেছেন ওই এঁকে রাখা বৃত্তের বাইরে? গত শতাব্দীর চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে, বিশেষত চল্লিশে মার্কিনি এবং ইংরেজ কবিদের কেউ কেউ চালু করেছিলেন স্বীকারোক্তিমূলক কবিতার ধারা। এক্ষেত্রে রবার্ট লাওয়েল, জন বেরিম্যান প্রমুখ হচ্ছেন অগ্রপথিক। পুরো ইউরোপে, এমনকি এশিয়াতেও পরে জনপ্রিয় হয়েছে কবিতার এই বিশেষ ভঙ্গি। কামাল চৌধুরীর কোনো কোনো কবিতায় স্বীকারোক্তির ওই ঢঙটি আমরা প্রত্যক্ষ করি- কেবল বাঁচার জন্য আমার কবিতা খঞ্জ মানুষের মতো অসম্পূর্ণ থেকে গেল কেবল বাঁচার জন্য মলমূত্র ত্যাগী মানুষের ভিড়ে আমি একজন কেবল বাঁচার জন্য রমণীর সান্নিধ্যে গিয়েছি কেবল বাঁচার জন্য অংশ নিয়েছি প্রজনন প্রক্রিয়ায় (যমজ/টানাপড়েনের দিন) শব্দ প্রয়োগের বেলায় লেখক ক্ষেত্রবিশেষে নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ‘পাথরের মন’, ‘বহুজাতিক আগুন’-এর মতো ফ্রেজ প্রযুক্ত হয়েছে। তেমনি ‘ক্যাঁচাল’-এর মতো আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহারও আমাদের চোখ এড়ায় না। একালের কবিদের জন্য কোনো বিশ্বাসের অটল আসন কিংবা আশ্রয়স্থল আর অবশিষ্ট নেই। তাই ভাবুককে স্বপ্নের ওপর ভর করেই আজ বাঁচতে হয়। সম্ভবত এ জন্যই কামাল চৌধুরী বলেন- ‘আজ হাওয়ার ভেতর তৈরি করেছি ঘর আমার আশ্রয়ের নাম আজ স্বপ্ন আমার প্রেমিকার নাম কবিতা।’ ২৭২ পৃষ্ঠার বৃহদায়তন ‘কবিতা সংগ্রহ’-এ ২৫টির মতো দীর্ঘ কবিতা আছে। এর অনেকটিই যথেষ্ট দীর্ঘ এবং পর্বে পর্বে বিন্যস্ত। বড় সাইজের উপন্যাসের মতো লম্বা কবিতাতেও থিমের একটা ব্যাপার থাকে। ওই থিমের পরিচ্ছন্নতা ও গোটা কবিতায় ভাবনা-কল্পনার ঐক্য বজায় রাখা রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। এক্ষেত্রে কামাল চৌধুরী প্রত্যাশিত মুনশিয়ানা দেখাতে পারেননি। তবে ওই দীর্ঘ কবিতাগুলোর কোনো কোনো ভার্স কিংবা এর ভেতরের কিছু স্তবক লেখকের সজীব সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করছে। ‘মেঘ ও ধূলি সম্পর্কের কবিতা’ (পৃ. ২১১) থেকে একটি স্তবক- ‘আকাশের অযুত স্বপ্ন খুলে গেলে ধূলির আয়তক্ষেত্রে প্রেম ও প্রার্থনার ভাষা একাকার শুধুই কাতরতা থাকে, ছিন্ন গানে, দহন দংশন চিহ্নে উৎসে বেদনায় মাটি খুঁড়তে জল আসে, জল থেকে তীব্র লবণ। প্রজ্বলন্ত মেধা খোঁজে অশ্রু কোটরে দেখতে পাই অন্ধকার ভেঙে পড়ছে, ধূলি থেকে জন্ম নিচ্ছে স্বচ্ছ স্রোতধারা শুনতে পাই দ্রবীভূত সমুদ্রের স্বর তখন তোমাকে আমি ঢেউ থেকে, পরমাণু থেকে তুলে আনি নেশাতুর চাঁদে তাতে, আমার এ শীতার্ত দেহ, চিরবস্ত্র কেবলি আর্দ্র হয় বিরহের মরীচিকা দ্বীপে।’ প্রথাবিরোধী কবিতা, কোনো সন্দেহ নেই, নতুন ধরনের সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষরবহ। কিন্তু এর ঝুঁকি এই যে, তা শেষ পর্যন্ত পাঠকের কাছে অগৃহীত থেকে যেতে পারে। অন্যদিকে প্রথাসম্মত কবিতার অনেক বেশি সম্ভাবনা থাকে পাঠকের কাছে পৌঁছানোর নিরীক্ষাপ্রধান ব্যর্থ কবিতার চেয়ে। তাই সফল প্রথানুগ কবিতা অনেক কাম্য পৃথিবীর কবিদের কাছে, পাঠকের কাছেও। তবে প্রথাগত কবিতার সিদ্ধি নির্ভরশীল তার অসাধারণ দক্ষতার ওপর। এ ধরনের দক্ষতা আমরা কমবেশি লক্ষ করি কামাল চৌধুরীর কবিতায়- ক. জলের কাছে ধার চেয়েছি স্রোত স্রোতে আমার খড়কুটো যায় ভেসে এক তমসা অনেক নদীর মুখে বিষাদ এসে রৌদ্র তীরে মেশে (বীজের ভাষা/হে মাটি পৃথিবীপুত্র) খ. মগজের কোষে কোষে হানা দিচ্ছে দিক চক্রবালা নাবিকের তীব্র নেশা হারপুনে গেঁথে নিচ্ছে লবণ সাগর প্রাচীন অসুখ থেকে উঠে এসে এখন ঘুরিয়ে দেব কম্পাসের কাঁটা তোমার ধুলোর দিকে, তোমার মাটির দিকে আর আমি সমুদ্রে যাবো না (ভাসমান/ঐ) গ. ভেতরে ঘুমিয়ে প্রথা ও পিতৃকাল তোমার আগুনে ভাসে বেহুলার তরী অধীনতা চেয়ে কলাভবনের গ্রামে নারীমুক্তির পোস্টার বিলি করি। (ছাত্রীনিবাস/ঐ) প্রথাগত ছন্দে ও শৈলীতে রচিত ‘কবিতা সংগ্রহ’-এর সেরা কবিতাগুলোর মধ্যে একটি এই ‘ছাত্রীনিবাস’। কবিতাটির নির্মাণ দক্ষতা প্রশ্নাতীত। কিন্তু কবিতা উৎকৃষ্ট হলেই শুধু চলবে না, শিরোনামটিও জুতসই হওয়া চাই। নারীবাদী ভাবনা ও ব্যক্তিগত ভণ্ডামি হচ্ছে কবিতাটির মূল সুর। কাজেই এর ছাত্রীনিবাস নামটি আমার কাছে যথাযথ মনে হয়নি। রচনার শক্তি ও দুর্বলতা- দুয়ে মিলেই একজন কবির ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে। কামাল চৌধুরীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। কামাল সুদীর্ঘকাল কবিতার সঙ্গে লিপ্ত ও লেখালেখিতে নিয়মিত। কবি হিসেবে স্বীকৃতি আছে এ রকম যে কোনো লেখকের রচনা খুঁটিয়ে পড়লে তার কিছু না কিছু বৈশিষ্ট্য চোখে পড়বেই। কণ্ঠস্বরের স্বাতন্ত্র্য সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। এক শতাব্দীতে বড়জোর ২-৪ জন কবি তা আয়ত্ত করতে পারেন। কবিতার নানা মাত্রা আবিষ্কার করা যায় এবং পাঠ করে বিশুদ্ধ আনন্দ পাওয়া যায়। এ রকম কবির সংখ্যা সত্তরের প্রজন্মে বেদনাদায়কভাবে কম। কামাল চৌধুরী সেই অতি অল্পসংখ্যক কবির একজন- যার কিছু কবিতা পড়ে পাঠক অনেককাল পরও খুশি হবেন বলে মনে হয়। আমি এও মনে করি, অতিভাষিতা তার কবি-ইমেজকে খানিকটা খাটো করেছে। কবিতা বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট সংযম দেখাতে পারেননি তিনি। কেননা আদৌ স্থান পাওয়া উচিত হয়নি- এ রকম অনেক লেখা এই বইয়ে পত্রস্থ হয়েছে। তারপরও আমি বলব, ‘কবিতা সংগ্রহ’ একজন কবির প্রতিভার উপযোগী সৃজনশীলতার ভালো নিদর্শন। গত ২৮ জানুয়ারি ছিল কবির জন্মদিন। শ্রদ্ধা ভালোবাসা আপনার প্রতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App