×

মুক্তচিন্তা

প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড কেন?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩৩ পিএম

প্রতিযোগিতার সঙ্গে যদি চোখ ফেরানো যায় শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকে চোখে অবশ্যই পড়ে মানের চ‚ড়ান্ত অবনতি। এত ধাপের পরীক্ষার অনুক‚লে প্রধান যুক্তিই হলো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা হয় না, দেশে পয়দা হলো লাখ লাখ নানা মানের নানাপর্যায়ের কোচিং সেন্টার। আর এই কোচিং সেন্টারই হলো যেন ভালো ফল অর্জনের পথে গ্যারান্টি। ভালো ফল মানে জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ প্রভৃতি নামক সোনার হরিণ। আর তার সঙ্গে যেন দৌড়ে পালাচ্ছে শিক্ষার মান।
একটি জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ‘প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড হচ্ছে’। বিষয়টির বিস্তারিত জানতে ক্ষুদ্র একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে কৌত‚হল হলো, এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম পুরো খবরটি। প্রকাশিত ওই খবরটিতে বলা হয়েছে ৩০ লাখেরও বেশি প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার্থীর চাপ আর বহন কারা সম্ভব হচ্ছে না প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পক্ষে। তাই এই বিশাল চাপ সামলাতে দ্রুত প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠনের কাজ শেষ করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইতোমধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড আইনের খসড়া জমা হতে পারে মন্ত্রণালয়ে। খসড়া তৈরি কাজের জন্য জড়িত এক কর্মকর্তা শিক্ষা বোর্ড গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলছিলেন প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়া ৩০ লাখেরও বেশি পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার চাপ সামলাতে পারছে না অধিদপ্তর। এসএসসি ও এইচএসসিতে যেখানে ১৫ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার জন্য বোর্ড আছে ১০টি, সেখানে প্রাথমিকে ৩০ লাখের জন্য বোর্ড একটিও নেই। জানা গেছে, এবার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বোর্ড গঠনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ আসার পরপরই কাজ শুরু হয়। ৩০ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থীর পরীক্ষার জন্য কোনো বোর্ড না থাকা শিক্ষার মানের জন্য সুখকর নয় বলে দ্রুত বিষয়টিতে নজর দেয়ার তাগিদ দেন সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজে গতি না থাকায় জাতীয় শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না বলেও সংসদীয় কমিটি মত দেয়। কমিটি শিক্ষার মান বাড়াতে মন্ত্রণালয়কে তাদের কাজে গতিশীল হওয়ারও সুপারিশ করেছে। তারপরই অধিদপ্তর শিক্ষা বোর্ড গঠনে একটি প্রস্তাব পাঠালে তাতে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। ২০১৩ সালে ২৬ হাজার স্কুল জাতীয়করণ হওয়ায় এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৩,০০০ বাড়লেও অধিদপ্তরের লোকবল আছে আগের মতোই। স্কুল ও শিক্ষকের দেখভাল করাই একটি অধিদপ্তরের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়েছে। সময়মতো অনেক কাজই করা সম্ভব হয় না। এরপরও আবার থাকে পরীক্ষার দায়িত্ব। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক শেখ একরামুল কবীর বলেন, ৩০ থেকে ৩২ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার বোঝা। অধিদপ্তরের ওপর দিলে আসলে তা নেয়া কঠিন। একটি বিকল্প চিন্তা করতেই হবে। বোর্ড হতে দেরি হলে কমপক্ষে বর্তমানের দশ বোর্ডকে এ পরীক্ষার দায়িত্ব দেয়া যায়। তাতেও সুফল পাওয়া সম্ভব বলে মনে করেন এ শিক্ষাবিদ। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় একটি বোর্ড নতুন করে গঠন করা হবে কেন? কেন নতুন নতুন আমলা-কর্মচারীর প্রাধান্য সৃষ্টি করা হবে বোর্ড গঠনের মাধ্যমে? বোর্ডের প্রয়োজনীয়তা, উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে প্রাথমিক সমাপনী ও ইবতেদায়ি মাদ্রাসা পরীক্ষা ও তার বিপুল সংখ্যাধিক্য। এই সংখ্যাধিক্য এমনই যে, তা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক ১০টি বোর্ডের মোট পরীক্ষার্থী সংখ্যার চেয়েও বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা যদি উঠিয়ে দেয়া যায় তা হলে নিশ্চয়ই সব ঝঞ্ঝাট মুক্ত হওয়া সম্ভব। নতুন আর একটি বোর্ড প্রাইমারি এডুকেশন বোর্ড নামে গঠনেরও যৌক্তিক কোনো কারণ থাকে না। এই পরীক্ষা তুলে দেয়া হবে বলে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীও বেশ কয়েকবার উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশের শিশুদের শিক্ষা কোন নিয়মে পরিচালিত হওয়া উচিত, তা নিয়ে সরকারিভাবে যেন একটা ছেলেখেলা চলছে বেশ অনেকদিন ধরে। বহুদিন ধরে শুনলাম, প্রাথমিক সমাপনী হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর। এই ব্যবস্থা বহু দেশে প্রচলিত আছে এবং অষ্টম শ্রেণি সমাপন করার পর কোনো বোর্ড পরীক্ষা গ্রহণেরও দরকার করে না। বেশি বেশি পরীক্ষা নিলেই তার শিক্ষার বা শিক্ষার মানের কোনো উন্নয়ন আদৌ ঘটে না যেমন ঘটে না দ্বিতল-ত্রিতল দালানকোঠায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানান্তর বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিজ নিজ জমিতে বহুতল বিশিষ্ট দালানকোঠা নির্মাণের মধ্যে। আমাদের নিজ নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা কী? প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি কাঁচা ঘরে পড়েছি। শিক্ষকরা ছিলেন উচ্চমানের এবং তারা শিক্ষাদানও করতেন গভীর দরদ ও আন্তরিকতা দিয়ে। তাদের বেতনও ছিল নামমাত্র। প্রাথমিক পর্যায় তখন শেষ হতো চতুর্থ শ্রেণি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। কোনো বোর্ডের অধীনে কোনো সমাপনী ব্যবস্থাও তখন ছিল না। ব্রিটিশ আমলেও ছিল না, পাকিস্তান আমলেও না। ১৯৭২-এ যখন দেশবাসী মরণপণ লড়াই করে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করলেন তখন আমরা সবাই যেন অতিমাত্রায় স্বাধীন ও সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে গেলাম। শুরু হলো আমলাতন্ত্রের দাপট, কম ছিল তা নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি আমলাদের বৃহদংশ বিশেষ ভ‚মিকা পালন করায় তারা যেন সেই ক্ষমতা ও অধিকারবলে সর্বজ্ঞ সেজে গেলেন। এক শ্রেণির হঠাৎ গজে ওঠা রাজনীতিক নানা স্বার্থে ওই আমলাদের পৃষ্ঠপোষক সেজে গেলেন। ধীরে ধীরে প্রকৃত, ত্যাগী, দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের যেন কেলির গুঁতা দিয়ে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া শুরু হলো। আজ তা আরো ফুলে-ফলে বিকশিত হয়েছে। এই ফাঁকে আমলাতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ এবং আমলাতন্ত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া কীভাবে বাংলাদেশে ঠাঁই করে নিল সেই প্রক্রিয়ার দিকে একটু নজর দেয়া যাক। সম্ভবত সামরিক আমলাতন্ত্রের নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমান অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর দেশের মহকুমাগুলো তুলে দিয়ে বা সেগুলোর মান উন্নীত করে জেলায় রূপান্ত করলেন। পাঠনীতিতে আমরা পেলাম ১৭ জন জেলা প্রশাসকের স্থলে ৬৪ জন জেলা প্রশাসক; ১৭ জন পুলিশ সুপারের বদলে ৬৪ জন এসপি এবং ৫ জন করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (আগের একজনের স্থলে) এবং ২-৩ জন করে অ্যাডিশনাল এসপি (একজন ডিএসপির স্থালে)। ফলে অসংখ্য উচ্চপদের আমলা, তাদের মানসম্মত বেতন, অফিস, বাসভবন, যানবাহন প্রভৃতিও হু হু করে বাড়তে থাকল। অপর অবৈধ সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পয়দা করলেন উপজেলা পদ্ধতি প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের নামে। তৈরি হলো উপজেলা কমপ্লেক্স, ভবনাদি এবং যানবাহন। স্বাধীন ভিয়েতনামে (আমাদের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতাপ্রাপ্ত) প্রথমদিকে মন্ত্রীরা চলতেন বাইসাইকেল চড়ে কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে তার দিব্যি এবং চোখ ধাঁধালো ব্যতিক্রম। মন্ত্রীতো দূরের কথা। এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউএনও প্রমুখের গাড়ির (কতটা তাদের দরকার সেটা ভাবার বিষয়) দিকে তাকালেও বোঝা যায় সেসব গাড়ি কত দামের। আর একটি প্রশাসনিক উন্নয়ন ইদানীং ঘটে চলেছে। একের পর বিভাগ সৃষ্টি। অতীতের তিনটি বিভাগের পরিবর্তে ইতোমধ্যেই আমরা পেয়েছি ১০টি বিভাগ। ফলে অন্তত বাড়তি সাতজন বিভাগীয় কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশের ডিআইজি, অ্যাডিশনাল ডিআইজি তাদের অফিস, বাসস্থান যানবাহন প্রভৃতি। শিক্ষাক্ষেত্রেও তার প্রবল ঝাপটা লাগল একের পর এক শিক্ষা বোর্ড গঠন হতে শিক্ষায় প্রতিটি সমাপনী স্তরের জন্য এক একটি বোর্ড এবং সেখানেও বিপুলসংখ্যক আসল কর্মচারী, গাড়ি-ঘোড়ার প্রাচুর্য, প্রাচুর্য তাদের মানসম্মত আবাস স্থলেরও। আমলাদের সংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে যদি চোখ ফেরানো যায় শিক্ষার মান উন্নয়নের দিকে চোখে অবশ্যই পড়ে মান মানের চ‚ড়ান্ত অবনতি। এত ধাপের পরীক্ষার অনুক‚লে প্রধান যুক্তিই হলো শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ায় ব্যস্ত রাখা। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা হয় না, দেশে পয়দা হলো লাখ লাখ নানা মানের নানা পর্যায়ের কোচিং সেন্টার। আর এই কোচিং সেন্টারই হলো যেন ভালো ফল অর্জনের পথে গ্যারান্টি। ভালো ফল মানে জিপিএ ফাইভ, গোল্ডেন ফাইভ প্রভৃতি নামক সোনার হরিণ। আর তার সঙ্গে যেন দৌড়ে পালাচ্ছে শিক্ষার মান। অনেক বলা হলো এবারে শেষ করি। এক. দিবারাত্র পড়ার বোঝা দিয়ে আটকে রাখা নয় ব্যবস্থা করুন মান ও দায়িত্ব বোধসম্পন্ন শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রীর সব পর্যায়ে এবং ক্লাসরুম পড়া (কোচিং সেন্টার নয়)। দুই. পাঠ্যপুস্তকের সংখ্যা হ্রাস। তিন. মাধ্যমিকের আগে কোনো বোর্ড পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। চার. অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ তবে তাদের সমাপনী পরীক্ষা কোন বোর্ড গ্রহণ না করে সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর শিক্ষকদের ওপর ছেড়ে দেয়া হোক। পাঁচ. সব পর্যায়ের শিক্ষার জন্য সঙ্গীত, নৃত্য শিক্ষা (ডিগ্রি পর্যন্ত) বাধ্যতামূলক করুন। ছয়. সব স্তরে শিক্ষার্থীদের ক্রিকেট, ফুটবলসহ নানাবিধ ক্রীড়া শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করুন। এই ছয় দফা বাস্তবায়ন করে ২৫ বছর দেখা হোক তার ফল। আমি নিশ্চিত বর্তমানের চেয়ে অনেক উন্নত মানের ছাত্রছাত্রী দেখা যাবে শিক্ষার্থীর মান উন্নয়নের ফলে। রণেশ মৈত্র : রাজনীতিক ও কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App