×

মুক্তচিন্তা

ওয়াজে ধর্মনাশের আওয়াজ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩০ পিএম

বাংলা ভাষায় যখন ইসলামি বইপুস্তক ব্যাপকভাবে রচিত হয়নি, তখন সাধারণ মুসলমানরা এই ওয়াজিন, পীর ও আওলিয়াদের ওয়াজ-বয়ান থেকেই ধর্মীয় জ্ঞান নিতেন। ধ্যানে-জ্ঞানে ওয়াজে মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ করার বয়ান দিতেন আলেমরা। দিতেন ইহকাল-পরকালের সুন্দর তালিম। সেসব ওয়াজে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানো বা আজকের নমুনা ছিল না। মানুষের মধ্যেও ওয়াজপ্রাপ্ত হয়ে আল্লাহপ্রাপ্তির মোহ ছিল বলে জানা যায় না।
ওয়াজের নামে ধর্ম প্রচার হচ্ছে? না কি ধর্মের সর্বনাশ করে ছাড়া হচ্ছে? সর্বনাশটা ইসলামসহ সব ধর্মেরই। ইসলাম ধর্মের রূপ-সৌন্দর্য ও গুরুত্বকে তারা খেলো করার পাশাপাশি অন্য ধর্মগুলোকে তাচ্ছিল্য শুধু নয়, অবজ্ঞা করছেন নিকৃষ্টমানে। বিদ্বেষও ছড়াচ্ছেন। এই কর্মে চড়া হাদিয়ায় মাঠ দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছেন কয়েক ওয়াজিন। তাদের কারো কারো তোফা বা হাদিয়ার অঙ্ক বিশাল। কয়েকজনকে মাহফিলে নিতে হয় হেলিকপ্টারে। ফেসবুক, ইউটিউবেও তাদের বাজার রমরমা। ধনে-জনে সামর্থ্যবান এই হুজুররা আয়কর কী দেন এ সংক্রান্ত তথ্য কম। তবে কথাবার্তা প্রচুর। কেবল গ্রামগঞ্জে নয়, শহরাঞ্চলেও এবার ওয়াজের আওয়াজ তুঙ্গে। কখনো কখনো তা যাত্রাপালা, সার্কাস, সিনেমার ভাঁড় ও জোকারদের হার মানায়। তাদের অতিকথন, গানের টান, জিকিরের স্টাইল কনসার্ট ধাঁচের। যা বিনষ্ট করে ছাড়ছে ইসলামের মূল সৌন্দর্যকেও। ব্যাপক জনপ্রিয়তা তাদের কয়েকজনের। হাসি-ঠাট্টা, ফাজলামি-ফাতরামি করেন সমানে। ইউটিউব খুললেই তাদের আসর। মিলিয়ন শ্রোতা-দর্শক। জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, মমতাজের বা হিন্দি ও লোকগানের সুরে বাড়তি বিনোদন দেন। সেটা করতে গিয়ে মিথ্যাচার, বানোয়াট গল্প, কিচ্ছা। ভাঁড়ামি, গান, অভিনয়, ব্যঙ্গসহ অসংলগ্ন মন্তব্য, অশালীনতা কিছুই বাদ যাচ্ছে না। মনগড়া মিথ্যাচারকেও সত্য বলে চালিয়ে দিচ্ছেন তারা। কেউ বাদ সাধছেন না। উপরন্তু সমর্থন জোগাচ্ছেন। মিথ্যার নতুন নতুন উদাহরণ তৈরি করছেন। তারেক মনোয়ার নামের এক সবজান্তা কিছিমের ওয়াজিনের রকেটে চড়া, অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় থেকে তিন তিনবার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হওয়া, সেটা আবার কাউকে এমনকি পরিবারকেও না বলে ফট করে ওয়াজে বলে ফেলার ভাইরাল সম্প্রতি ব্যাপক প্রচারিত। ব্যস্ততার কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দাওয়াতে যেতে না পারা, ইংল্যান্ডে থেকে ইংলিশ ফুটবল লিগে খেলা কোনো চাপাবাজিই বাদ দেননি তিনি। এক মাহফিলে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মাওলানা তারেক বলছেন, ‘পৃথিবীতে সবচেয়ে পয়সাওয়ালা বিল গেটস আইফোনের মালিক। দেখা হয়েছে আমার সঙ্গে, আমার কাছে মনে হয়েছে টিকটিকি।’ মনোয়ার সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি বিল গেটসকে বুঝিয়েছেন। যদিও প্রকৃতপক্ষে বিল গেটস আইফোনের উৎপাদনকারী কোম্পানি অ্যাপলের মালিক নন। ভাইরাল হওয়া আরেকটি ভিডিওতে তারেক মনোয়ার নিজেকে নব্বইয়ের দশকে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলার দাবি করে বলেন ‘ভালো খেলতাম.. অনেক ভালো খেলতাম, তিন-চারটা গেম তো খুব ভালো খেলতাম। ঢাকার চ্যাম্পিয়নশিপ পুরস্কারও আছে আমার ব্যাটমিন্টনে।’ তারেক মনোয়ার আরো বলেন, ‘ফুটবল.. ইংল্যান্ডে গিয়ে লিগে (ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ) খেলেছি। ১৯৯০ সাল.. অত্যন্ত কম বয়স। পয়সা দিয়ে নিয়ে যেত খেলার জন্য। ভালোই ইনকাম শেষে দেখি যে পুরাটা হারাম।’ আরেক ওয়াজে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘আমি অক্সফোর্ডে তিনবার শ্রেষ্ঠ টিচার হয়েছি, আজকেই বলে ফেললাম। এটা কেউ জানে না.. আমার পরিবারও জানে না। অক্সফোর্ডের সিলেবাসে ইংল্যান্ড আমেরিকার স্কুলগুলো চলে। ‘আরেক ভিডিওতে দেখা গেছে তিনি দাবি করছেন, ১৯৯০ সালে তিনি ইংল্যান্ডের ব্রাইটন ইসলামিক সেন্টারের খতিব ছিলেন। সে সময়ে তিনি একজন ব্রিটিশ মডেলকে ইসলাম গ্রহণ করান বলেও দাবি করেন। রসিয়ে রসিয়ে মুখ ভেংচিয়ে এসব মিথ্যাচার শুনিয়ে মানুষের মুখ দিয়ে মাশাল্লাহ, সুবহানাল্লাহ আওয়াজ বের করে ছেড়েছেন। মিজানুর রহমান আজহারী নামের স্মার্ট ফ্যাশনেবল ওয়াজকারী চমৎকার বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে ইংরেজি, আরবির ব্যবহারে, গানে গানে, বাগ্মিতায় মানুষকে উত্তেজিত করে ছাড়ছেন। কারাবন্দি জামায়াত নেতা মাওলানা সাঈদীকে সিংহ ও নিজেকে সিংহের বাচ্চা বলে উপমা দেন তিনি। আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরাও তার মাহফিলে যান। তার ভ‚য়সী প্রশংসা করেন। মিজান-তারেকের পরস্পরকে জড়িয়ে আবেগে কেঁদে মঞ্চে ভিন্ন আবহ তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন। মাওলানা আমির হামজাও এ ক্ষেত্রে বেশ আগুয়ান। নিজের গোটা ফ্যামিলি আওয়ামী লীগার বলেও প্রচার করেন তিনি। এই মিজানুর রহমান আজহারী, তারেক মনোয়ার, আমির হামজা, রফিক উল্লাহ আফসারি, গিয়াস উদ্দীন তাহেরী, গোলাম রব্বানী, ইলিয়াছুর রহমান জিহাদী, আবদুল খালেক শরীয়তপুরীরা একা নন। অনেক ফ্যান- ফলোয়ার তাদের। ধর্মের আবেগ অনুভ‚তিকে কাজে লাগিয়ে কুরআন তাফসিরের মাধ্যমে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর উত্থান অনেকটা এই পথেই। জামায়াতে আনুষ্ঠানিক যোগ দেয়ার আগ পর্যন্ত সাঈদীর ওয়াজ-মাহফিলের এন্তেজামে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার ঘটনা বেশিদিন আগের নয়। তারা তার বাগ্মিতায় শুধু মুগ্ধ হতেন না, ভক্তিও করতেন। বাজার গরমের তোড়ে ওয়াজ এখন শুধু রাতে নয়, দিনেও চলছে। সকাল-দুপুর-বিকেল বিভিন্ন বেলায়ই হয়। কিন্তু হেদায়েত অবান্তর হয়ে গেছে। ওয়াজকারীদের কয়েকজন ময়দানে বিনোদন সাপ্লাই করেন। আকথা-কুকথার সময় চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে যান। নানান অঙ্গভঙ্গিও করেন। মানুষ বিনোদিত হয়। স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান ধাঁচে কেউ কেউ মঞ্চে লাফান, নাচেন। নিজে চিল্লান। মানুষকেও জোরে চিক্কুর দেয়ার হুকুম করেন। চোখে পানি না এলেও কান্নার ভান করেন। ঘনঘন চোখ মোছেন। ধর্ম, সম্প্রদায়, নারীসহ বিভিন্ন বিষয়ে হেন বাজে কথা নেই যা তারা রসিয়ে রসিয়ে না বলছেন। এসব হুজুরের কেউ কেউ আবার একজন আরেকজনকে সহ্য করতে পারেন না। বাজার গরম রাখার কৌশল হিসেবে তারা একজন আরেকজনকে কাফের বানানোসহ নানা অপবাদও দেন। নামের আগে আল্লামা, শায়খুল হাদিস, মুফাসসিরে কুরআন, মুফতি, মুহাদ্দিসসহ বহু বিশেষণ তাদের। আর পেছনে মাদানি, আজহারি, আমিনী, আফসারি, আব্বাসি, জেহাদি, নূরানি, যশোরী, চাঁদপুরী, ভৈরবী, শরীয়তপুরী, তাহেরী, জাহেরী, আনসারী ইত্যাদি। নানা নামাবলির এই ধর্মীয় বয়ানশিল্পীরা বাজার বুঝে তামাশার সঙ্গে নানা মন্তব্য ও বিতর্ক ছুড়ে নিজেদের আলোচিত-সমালোচিত করার কৌশলও নিচ্ছেন। প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে তারা ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন তারাই ইসলাম। তারাই সঠিক। তাদের বিরুদ্ধাচরণ করা মস্ত গুনাহ। তাদের ভাঁড়ামি, কমেডিকেও জায়েজ করে ছাড়ছেন ধর্মের অংশ হিসেবে। ওয়াজে কিছু বলার পরই জানতে চায় ‘ঠিক কি-না’? প্যান্ডেল থেকে ‘ঠিক ঠিক’ বলে রব আসে। আস্তে বললে মাইন্ড করেন। হুকুম দেন জোরে, চিৎকার-চিক্কুর দিয়ে ঠিক ঠিক বলে আওয়াজ করতে। চরম হাস্যকর বিনোদন। ওয়াজের ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার কন্ট্রাক্ট আয়ের নতুন খাত। পাশাপাশি মাইক-ডেকোরেটর ব্যবসা জমেছে। ভিডিও প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে কাজ আসছে। ওয়াজ-মাহফিলকে হামদ-নাত ও ধর্মীয় উৎসাহব্যঞ্জক গান পরিবেশনকারী শিল্পীগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এ উছিলায় তাদেরও বেশ আয়-রোজগার। মানুষকে বিভাজিত রাখতে দলাদলি ও তরিকা তৈরিও চলে গেছে ব্যবসার পর্যায়ে। ঠাণ্ডা মাথায় ওহাবি, সুন্নি, দেওবন্দি, মাজারি, বাজারি, খানকাপন্থি, তাবলিগি, কেয়ামি-লাকেয়ামি ইত্যাদি বিভক্তি তৈরি করা হয়েছে। তাদের অনুসারীও অগুনতি। ভক্ত-অনুসারীদের কখনো কখনো মারামারিতেও জড়িয়ে দিচ্ছেন তারা। এ নিয়ে মামলাবাজির ঘটনাও ঘটছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তাদের কয়েকজনকে ‘বিপজ্জনক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। নজরদারিতে রাখার বার্তাও দেয়া হয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনকে। কিন্তু দিন-রাত সমানে ওয়াজের নামে চলমান যথেচ্ছাচারে সেই নির্দেশনার সারবত্তা তথা কার্যকারিতা এখন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। ওয়াজ আরবি শব্দ। এর অর্থ উপদেশ, আবেদন, প্রচার, সতর্কীকরণ ইত্যাদি। এক সময় আল্লাহর পথে ডাকার অন্যতম মাধ্যম ছিল ওয়াজ-নসিহত। বাংলা ভাষায় যখন ইসলামি বইপুস্তক ব্যাপকভাবে রচিত হয়নি, তখন সাধারণ মুসলমানরা এই ওয়াজিন, পীর ও আওলিয়াদের ওয়াজ-বয়ান থেকেই ধর্মীয় জ্ঞান নিতেন। ধ্যানে-জ্ঞানে ওয়াজে মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ করার বয়ান দিতেন আলেমরা। দিতেন ইহকাল-পরকালের সুন্দর তালিম। সেসব ওয়াজে মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানো বা আজকের নমুনা ছিল না। মানুষের মধ্যেও ওয়াজপ্রাপ্ত হয়ে আল্লাহপ্রাপ্তির মোহ ছিল বলে জানা যায় না। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App