×

আন্তর্জাতিক

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে চীনের ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ১০:০১ এএম

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে চীনের ‘সর্বাত্মক যুদ্ধ’
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ ও প্রতাপ দুটোই বাড়ছে চীনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। চীনের স্বাস্থ্য কমিশন বলছে, করোনা ভাইরাস বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ধারণা সীমিত। এর থেকে উদ্ভ‚ত ঝুঁকি বিষয়েও তারা প্রায় অজ্ঞ। দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং পলিট ব্যুরোর বৈঠকে বলেছেন, গুরুতর পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে চীন। এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন তিনি। ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য মাত্র এক সপ্তাহ সময়ের ভেতর এক হাজার শয্যার হাসপাতাল গড়ে তোলা হচ্ছে। রীতিমতো যুদ্ধে নেমে পড়েছেন দেশটির চিকিৎসকরাও। দম ফেলারও সময় পাচ্ছেন না তারা। উহান হাসপাতালের একজন চিকিৎসাকর্মীর দাবি, কর্তৃপক্ষ যাই বলুক, আক্রান্তের সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। এত বেশি মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, চিকিৎসকরা টয়লেটে যাওয়ারও সময় পাচ্ছেন না। বড়দের ডায়াপার পরেই চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। এক নতুন আইনে চীনে সব ধরনের বন্যপ্রাণী কেনাবেচা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-এর আগে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি বলে জানালেও চীনের পক্ষে প্রাদুর্ভাব মোকাবিলা করা সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। চীনের সরকারি ভাষ্যে, সেখানে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়েছে, ৮০ জন মারা গেছেন ইতোমধ্যেই। ভারতের কেরালা ও মহারাষ্ট্রে শতাধিক ব্যক্তিকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। ৭ জনের শরীরে আক্রান্তের লক্ষণ পাওয়া গেছে। ইসরায়েলেও ধরা পড়েছে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি। ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল প্রায় সোয়া কোটি বাসিন্দার শহর উহানে জরুরি যানবাহন ছাড়া সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। গণপরিবহন ও মন্দিরগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ জারি হয়েছে আরো ১০টি শহরে। খবর রয়টার্স। বেইজিং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ সবার মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠিয়ে পরামর্শ দিয়েছে, শুভেচ্ছা ও অভিবাদন বিনিময়ের সময় হাতে হাত না মিলিয়ে অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী ভঙ্গি অনুসরণের জন্য। ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে এ পর্যন্ত দেশটির ১৮টি শহরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ আর জনসমাগম ঘটে এমন সব অনুষ্ঠান বাতিল করার বাইরে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি এখনো। এদিকে উহানের মার্কিন কনস্যুলেট থেকে নিজেদের লোকজন সরিয়ে নিচ্ছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কনসুলেটের কর্মীদের সরিয়ে নেয়ার পর বিমানের অবশিষ্ট সীমিত সংখ্যক আসনে শহরটিতে আটকা পড়া কিছু কিছু সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হতে পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে যারা তাদের অগ্রাধিকার দেয়া হবে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফ্রান্স এবং অস্ট্রেলিয়াও তাদের নাগরিকদের সরিয়ে নেয়ার কথা বিবেচনা করছে। উহান ফেরত এক ব্যক্তির শরীরে গত শনিবার করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করেছে কানাডা। গত ২২ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর শ্বাসকষ্টের জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন পঞ্চাশোর্ধ বয়সের ওই ব্যক্তি। অন্যদিকে, ইসরায়েলে এক ব্যক্তির শরীরে ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে বলে সন্দেহ করছেন দেশটির কর্তৃপক্ষ। এর আগেও দেশটিতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে সন্দেহভাজন কয়েকজনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ছেড়ে দেয়া হয়। গত বছরের শেষদিকে চীনের মধ্যাঞ্চলীয় শহর উহানে একটি সি-ফুড বাজার থেকে করোনা ভাইরাসটি ছড়িয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ওই বাজারে অবৈধ বন্যপ্রাণী কেনাবেচা হয়ে থাকে। উহান থেকে ভাইরাসটি দেশটির বেইজিং ও সাংহাইয়ের পাশাপাশি পৌঁছে গেছে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, তাইওয়ান, যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, ম্যাকাও, জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ইসরায়েল, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায়। ফ্রান্সে অন্তত ৩ জন আক্রান্ত হয়েছেন এ ভাইরাসে। যুক্তরাষ্ট্রের জন হপকিনস সেন্টারের বিজ্ঞানী এরিক টনার বিশ্বজুড়ে এ ধরনের করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ৬ মাস আগে সতর্ক করেছিলেন। তখন তিনি বলেন, এর প্রভাবে ১৮ মাসের মধ্যে বিশ্বে সাড়ে ৬ কোটির বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। প্রাথমিকভাবে বোঝা যাচ্ছে, এটি পূর্ববর্তী ভাইরাস সার্সের চেয়ে একটু দুর্বল। তবে সার্সের চেয়ে দ্রুতগতিতে এটি বিস্তার লাভ করতে পারে। সতর্কবার্তায় বিজ্ঞানীরা আরো বলেছিলেন, নতুন করোনা ভাইরাসটি হবে আধুনিক যেকোনো ভ্যাকসিন প্রতিরোধী। এতে আক্রান্তরা ফ্লু অথবা নিউমোনিয়ায় ভুগতে পারেন। সেখান থেকে ধীরে ধীরে তা মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। দেশগুলোতে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে। ভ্রমণ বাতিল হয়ে যাবে ৪৫ শতাংশ। মানুষ প্রচুর ভুয়া সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেবে। ৬ মাসের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে এই ভাইরাস। টনার বলেন, আমরা যে ধরনের বিশ্বে বসবাস করছি, এটি তারই একটি অংশ। আমরা এখন মহামারীর যুগে বসবাস করছি। করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার এক থেকে ১৪ দিনের মধ্যে এর লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার কথা। এতে আক্রান্ত হলে পশুদের ক্ষেত্রে ডায়রিয়া, পাখিদের ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্ট এবং মানুষের ক্ষেত্রে জ্বর, শুষ্ক কাশি এবং শ্বাসকষ্ট, যা শেষ পর্যন্ত প্রাণঘাতী রূপ নিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব প্রাণীর শরীরে বাসা বাঁধার পর ভাইরাস ছড়াচ্ছে তা নির্ণয় করা গেলে সমস্যার সমাধান অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, বেলুগা তিমির মতো সমুদ্রগামী কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী এই ভাইরাসটি বয়ে এনেছে। তবে বাজারে অহরহ বিচরণ করা মুরগি, বাঁদুর, খরগোশ কিংবা সাপের মতো প্রাণীগুলোও সন্দেহের বাইরে রাখছেন না কর্তৃপক্ষ। এখন পর্যন্ত করোনা ভাইরাসের কোনো ধরনের প্রতিষেধক আবিষ্কার হয়নি। শুধু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া রোধে ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে একটি আবদ্ধ জায়গায় রেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা করা হচ্ছে। তবে করোনা ভাইরাসের আক্রমণের প্রভাব ভালোভাবেই পড়েছে ওষুধশিল্পে। জনসন এন্ড জনসনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পল স্টোফেল বলেছেন, তার দল ইতোমধ্যে নতুন ভাইরাসের প্রতিষেধক উদ্ভাবনের ‘মূল কাজ’ করে ফেলেছেন। আগামী এক বছরের মধ্যেই এটি বাজারে ছাড়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া ভাইরাস আতঙ্কের কারণে মাস্ক, হাতমোজা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, থার্মোমিটার ইত্যাদির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। যেসব কোম্পানি এগুলো তৈরি করে তাদের শেয়ারেরও দামও বেড়েছে। ফিনান্সিয়াল টাইমস জানায়, গত সপ্তাহে মাত্র দুদিনেই প্রায় ৮ কোটি মাস্ক বিক্রি করেছে আলিবাবার মালিকানাধীন তাওবাও। জানুয়ারির ১৯ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে জেডি ডটকম মাস্ক বিক্রি করেছে অন্তত ১২ কোটি ৬০ লাখ পিস। এ ছাড়া তাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ফুরিয়ে গেছে। বিক্রি বেড়েছে থার্মোমিটার, চশমাসহ ঠাণ্ডাজনিত রোগের বিভিন্ন ওষুধপত্রেরও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App