×

মুক্তচিন্তা

আসছে ভাষার মাস, মন তাই ভাবছে...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জানুয়ারি ২০২০, ১০:১৯ পিএম

বর্তমানে আপত্তিকর মিশ্র ভাষার উদ্ভব ঘটছে বাংলায়, যা আবার আধুনিকতার ও বিশেষ ঐতিহ্যের আবরণে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার চেষ্টা চলছে। ইংরেজি-হিন্দি-বাংলার যুক্তিহীন বা জবরদস্তির দূষণে ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হচ্ছে। নতুনত্বের নামে, স্থানিক চেতনার নামে এ মিশ্রণ আসলেই ভাষিক দূষণ।
মাঘ মাসের মাঝামাঝিতেই শুরু হবে ভাষার মাস। ভালোবাসা দিবসে আসবে বসন্ত। ভাষার মাস আসছে যেমন উৎসব আসে বারো মাসে তেরো পার্বণ। ফুল, শাঁখ, মাইক গর্জন চলবে তুমুল তীব্রতায়। আমরা শহীদ স্মরণে আপন গর্জনে রক্তঋণ শোধ করার আয়োজনে মগ্ন হবো। এবারে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সমাগত। তাই ভাষার মাসে বঙ্গবন্ধুকেও স্মরণ করব শ্রদ্ধায়। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির আগে-পরে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ নিয়ে যেমন চিন্তা-চিন্তা হাওয়া ওঠে, এবার তা মুখরিত হবে উৎসবের আগাম আলপনায়। এ বছর ভাষা আন্দোলনের ছেষট্টি বছর। কাজেই বাংলাদেশে খুবই আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে ভাষা দিবস পালন করা হবে। কিন্তু ওপার বাংলার পুণ্যে এপার বাংলার পুণ্য হওয়ার মতলবে আমরাও কোমর বাঁধছি। তবে উৎসবের আয়োজন যাই হোক, বাংলা ভাষার গায়ে বসন্তের ফুরফুরে বাতাস লেগেছে, তা অবশ্য বলা যাবে না। বাংলাদেশে হাল আমলের লিটারেরি মিট-এ ইয়ং জেনারেশনের ভিড় দেখা গেছে ইংরেজি বইয়ের স্টলের দিকে। আসলে যাদের বয়স কম তারা ভবিষ্যতে কোন ভাষা বেশি ব্যবহার করবে তার ওপরই ভিত্তি করে গড়ে ওঠে ভাষার ভবিষ্যৎ। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ তাই নির্ভর করছে পাঁচ থেকে পঁয়তাল্লিশ-এর মধ্যবর্তী বাঙালিরা ভাষা নিয়ে কী ভাবছেন তার ওপর। এই কমবয়সী বাবা-মায়েরা, অর্থাৎ ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭-এর মধ্যে যারা জন্মেছিলেন, তাদের একটা বড় অংশ বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়ে পড়েছিলেন। কারণ তাদের বাবা-মায়েরা এখনকার মুক্ত অর্থনীতির যুগে বড় হয়ে ওঠেননি। সেই পিতামহ-পিতামহীদের স্মৃতিতে স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশভাগ বড় ছিল। শুধু তা-ই নয়, তখন তারা এক রকম বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয় দেখে অভ্যস্ত ছিলেন যেখানে ইংরেজি-অঙ্কের ভিত পোক্ত হতো। বলার ইংরেজিও যে চাইলে রপ্ত করে নেয়া যায়, এমন উদাহরণও বিরল ছিল না। নব্বই দশক থেকে দুই বাংলায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ইংরেজি শেখানোর জন্য যে বই নির্মাণ করা হলো সেই বই ব্যবহারিক ইংরেজি শেখানোর বই, ইংরেজি ভাষার সাহিত্য ও ভাবনামূলক লেখাপত্র আর তেমন করে সে বইতে পাঠ্য হিসেবে থাকার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। সহজ করা হলো ইংরেজি শিক্ষা। ক্রমেই সত্যিকারে ইংরেজি ভাষাশিক্ষাবিহীন সহজ বাংলা মিডিয়াম স্কুলগুলোর প্রতি আস্থা কমে গেল বলে মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তরা এই স্কুলগুলো থেকে মুখ ফেরালেন। আর এই ফাঁক ভরানোর জন্য ক্রমে তৈরি হলো অজস্র নানা কিসিমের ইংলিশ মিডিয়াম। এই স্কুলের প্রাচুর্যে বাংলা ভাষার ব্যবহারযোগ্যতা কমেছে। এখন যাদের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ, সেই অভিভাবকরা কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও এখন ছেলেমেয়েদের বাংলা মাধ্যমে পাঠাতে পারেন না। অর্থনীতির আন্তর্জাতিক অভিমুখ পরিশ্রমী শিক্ষিত বাঙালিকে ক্রমে অন্যত্র প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলা ভাষার সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েদের যোগ কমেছে। দেশে ফিরেও উপযুক্ত বাংলা মাধ্যম স্কুল না থাকায় অন্য রকম স্কুলে পাঠাতে হয়েছে সন্তানদের। একই সঙ্গে তারা তাদের সন্তানদের বাংলা মাধ্যমে ফেরানোর তেমন কারণ ও ব্যবস্থা খুঁজে পাননি। এই কমবয়সী বাবা-মায়ের দল এখন অনেকেই বাংলায় ব্লগ লেখেন, বাংলা বই ভালোবেসে পড়েন, বাংলা সংস্কৃতির নানা পণ্য কেনেন। তারা পড়েন, কিন্তু তাদের ছেলেমেয়েরা কেন বাংলা পড়বে, কীভাবে পড়বে সেই প্রশ্নের সদুত্তর দেয়া মুশকিল। আসলে ইংরেজির প্রতি উষ্মা প্রকাশ নেতিবাচক প্রক্রিয়া, এতে লাভ হয় না। নতুন প্রজন্ম না শিখেছে ইংরেজি, না শিখেছে বাংলা। একটি খিচুড়ি কেজো ভাষা শিখেছে যা দিয়ে গ্রাসাচ্ছাদন হয়তো করা যায়। উনিশ শতকে বাংলা ভাষার পক্ষ নিয়ে যারা কাজ করছিলেন তারা কেউ ভাষার ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভ‚মিকা গ্রহণ করেননি। বাংলা ভাষায় কী করে সুললিতভাবে সমকালীন ভাবনাকেও প্রকাশ করা যায়, বঙ্কিমের মতো ভাষাভাবুক সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আর রবীন্দ্রনাথ ইংরেজি কীভাবে এবং কতটা পড়াতেন তার স্কুলে, সে বৃত্তান্ত তো একটু চেষ্টা করলেই জানা যায়। যেমন ম্যাথু আর্নল্ডের কবিতা পড়াতে গিয়ে কবি কী পরিশ্রম করেছেন তা ভাবলে অবাক লাগে। কবিতার মূল বাক্যগুলোকে নানা রূপের ইংরেজি গদ্যে তর্জমা করে শোনাচ্ছেন লেখাচ্ছেন পড়ুয়াদের। কবি আসলে জানতেন অপর ভাষার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বাংলা বাঁচবে না। বর্তমানে আপত্তিকর মিশ্র ভাষার উদ্ভব ঘটছে বাংলায়, যা আবার আধুনিকতার ও বিশেষ ঐতিহ্যের আবরণে যুক্তিগ্রাহ্য করে তোলার চেষ্টা চলছে। ইংরেজি-হিন্দি-বাংলার যুক্তিহীন বা জবরদস্তির দূষণে ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হচ্ছে। নতুনত্বের নামে, স্থানিক চেতনার নামে এ মিশ্রণ আসলেই ভাষিক দূষণ। এ জাতীয় দূষণে বেশ কিছুকাল থেকে শক্তিমান ভ‚মিকা পালন করছে এফ এম রেডিওর অরুচিকর পাচন, যা আবার বিনোদনের নামে তরুণদের প্রভাবিত করছে। এ দূষণ মূলত শাব্দিক ও ভাষিক। সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। একই রকম উদাহরণ দেখা যায় টিভির টক শো-নামীয় উদ্ভট ভাষিক লড়াইয়ের জায়গাগুলোতে। সেখানে টকের চেয়ে তেতো ঝাঁজই বেশি। রাজপথে বের হলে চোখে পড়বে দোকানের নামপত্রে, সাইনবোর্ডে, বিজ্ঞাপনী বার্তায় বাংলা বানান ভুলের মহোৎসব। কোথাও কোথাও তা মারাত্মক চরিত্রের। এক সরণির বানান যে কত মাত্রায় পরিস্ফুট, তা দেখে চমকে যেতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে অনুষ্ঠানাদিতে, আমন্ত্রণপত্রে ইংরেজির একচেটিয়া আধিপত্য। যে বাঙালি-গৃহকর্তা এক সময় সব রকম নিমন্ত্রণপত্রে, সন্তান বা আবাসন বা বাসস্থানের নামকরণে বাংলা ব্যবহারে গর্ববোধ করতেন, তাদের বা তাদের উত্তরসূরি প্রায় সবারই বর্তমান গর্ব ইংরেজি ভাষার ব্যবহারে। আগে সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ বিভিন্ন উপলক্ষে এক সময় বই উপহার দিয়ে আনন্দ পেতেন তার উত্তরসূরিদের কাছে সে রীতি এখন বৈষয়িক বিবেচনায় মূল্যবান আধুনিক সামগ্রী উপহারে বিকোয়। অলঙ্কার বা দামি পোশাক-পরিচ্ছদ সাংস্কৃতিক মননশীলতার জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। ভাষা বা ভাষিক সংস্কৃতি এমনইভাবে নানা মাত্রায় বিপন্ন অবস্থানে পৌঁছে গেছে। ‘বাংলা আমার গর্ব, বাংলা আমার অহংকার’ এর আবেগ এখন নানা টানে ফেরারি। আমার কন্যার বিয়েতে বাঙালি কবি ও সাহিত্যিকদের হাট বসেছিল। বিশ্বাস করুন প্রীতি উপহার হিসেবে পুস্তক প্রাপ্তি ঘটেছিল মাত্র একটি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভাষার সঙ্গে যত আবেগ জড়ানো থাকুক না কেন, অর্থ ও অর্থনীতি ভাষার চেয়ে অধিকতর নিয়ামক শক্তি। সেখানেই মাতৃভাষা বাংলার অবস্থান নিয়ে আমাদের বড় ঘাটতি। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বলেন, বাংলা টিকে থাকবে বাংলাদেশেই। ব্যাস, দায়িত্ব শেষ। কিন্তু ভাষা যে নিজের পরিচয় আর নিজের পরিচয়টিই যদি লজ্জাজনক হয়, তবে নিজের অস্তিত্বই একটি মস্ত লজ্জা, সেকথা বাঙালি কবে বুঝবেন? তাই ভাষার প্রতি আবেগ ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালির মনে উথলে ওঠে, এ কথা ঠিক। কিন্তু সারা বছর ভাষাটিকে যত্নে আগলানোর দায়িত্ব কার? শুধুই কি বাংলাভাষা চর্চাকারী কবি-সাহিত্যিকদের? না কি নিয়ম নির্মাণী নেতা আমলারাও কিছু ভাববেন? অমিত গোস্বামী : কবি ও লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App