×

মুক্তচিন্তা

আচার্যের সতর্কবাণী আমলে নিতে হবে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২০, ০৯:০৯ পিএম

তিনি তার বক্তৃতায় নিয়মতান্ত্রিক বক্তব্যের পাশাপাশি সাধারণভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু অভিযোগ তুলে তাদের আচরণ সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন। তার অভিযোগ থেকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও রেহাই পাননি। তার বক্তব্য সম্পর্কে একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘উপাচার্যরাই দুর্নীতি করলে কি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের’। তিনি উপাচার্যদের ‘সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।’
কিছু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ থাকেন যাদের কাছে সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ববোধ নিয়মতান্ত্রিকতা ছাড়িয়ে যায়; জনস্বার্থ, নাগরিক স্বার্থ, সর্বোপরি মানবিকবোধ সব কিছুর ওপরে স্থান পায়। ওই যে কথায় আছে না, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’ কথাটা অন্যভাবে বললে, সব বিধিবিধানের বিচারে মানুষ ও মানবিক স্বার্থ সবার ওপরে। রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা সংসদীয় রাজনৈতিক ধারায় চলে, যেখানে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সংসদ এবং তাদের মনোনীত মন্ত্রীমণ্ডলী শাসনযন্ত্রের মূলকেন্দ্র, বলতে হয় নির্বাহী কর্মকাণ্ডের হোতা। সে ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রপতির পদটি আলঙ্কারিক, সম্মানের প্রতীক, যদিও তার অবস্থান সবার ওপরে। নির্বাহী কর্মতৎপরতায় তার কোনো প্রত্যক্ষ ভ‚মিকা নেই, যদিও তিনি সব ক্ষেত্রেই আছেন। যেমন ব্রিটেনসহ ইউরোপের কোনো কোনো রাজতন্ত্রী দেশে রাজা বা রানীর পদটি। বাংলাদেশ বা ভারতসহ অনুরূপ শাসনব্যবস্থার দেশের রাষ্ট্রপতিরা এই নীতি ও ব্যবস্থাকে মান্য করে চলেন। সাংবিধানিক অনিবার্য কারণ ভিন্ন নির্বাহী ব্যবস্থায় তথা কর্মতৎপরতায় হস্তক্ষেপ দূরে থাক কেউ কেউ উপদেশ বচনও বিতরণ করেন না। বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতিকে কিছুটা ব্যতিক্রমী বলতে হবে। নিজস্ব জনপদের প্রতিনিধি হিসেবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তার প্রবেশ, এরপর স্পিকারের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে রাষ্ট্রপতি পদে আসীন। স্পিকার থাকাকালেও তাকে দেখা গেছে নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে জনস্বার্থে কথা বলতে, কখনো সরস মন্তব্যে। এ অভ্যাসটি তিনি বজায় রেখেছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরও। রাজনীতির একটি নিজস্ব শ্রেণিগত চরিত্র আছে যা আমরা ভারতীয় উপমহাদেশে বরাবর লক্ষ করে এসেছি। আধুনিককালে সেটা বিশেষভাবে পরিস্ফুট। অলিখিত নিয়মের মতোই সাধারণত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি রাজনীতিতে আকৃষ্ট আর শাসনতান্ত্রিক রাজনীতিতে তা যেন নিয়মে পরিণত, যেখানে আইনজীবীদের প্রাধান্য। এর একটি বড় কারণ, সংসদীয় কাঠামোর জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে আইনপ্রণেতাও বটে। এবং তা সেই সঙ্গে দেশ ও রাষ্ট্রের সর্বাত্মক স্বার্থে। এ কথার অর্থ এমন নয় যে, অন্য কোনো পেশার মানুষ আইনসভায় নির্বাচিত হতে পারবেন না বা সংসদীয় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। এ নাগরিক অধিকার সবারই আছে। তাৎপর্যপূর্ণ কথাটা হচ্ছে, অন্য পেশার মানুষ তাদের ভিন্নধর্মী পেশাগত দায়িত্ব, জীবিকার দায় ইত্যাদি পুরোপুরি ঠিক রেখে, সেখানে পুরোপুরি সময় ও শ্রম দিয়ে আইনসভার দায়িত্ব পালনে কতটা মন, প্রাণ, সময় ও শ্রম দিতে পারবেন সেটাই বড় প্রশ্ন, স্বদেশ-সমাজ-রাজনীতির প্রসঙ্গ যদি বাদ দেই। সেখানেই মূল সমস্যা। তাছাড়া শ্রেণিগত, পেশাগত স্বার্থের বিষয়টিও বিবেচ্য। সম্ভবত এসব কথা ভেবেই বর্তমান রাষ্ট্রপতি বছর কয় আগে সংসদ সম্পর্কে একটি বিস্ফোরক মন্তব্য করেছিলেন এই বলে যে, সংসদে ব্যবসায়ী শ্রেণির প্রাধান্য বড় বেশি হয়ে যাচ্ছে। তার এই মন্তব্যে দেশের নানা মাত্রিক স্বার্থবিষয়ক তার উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছিল। অর্থাৎ সংসদে ব্যবসায়ী প্রাধান্য ঘটলে সংসদের কর্মকাণ্ডে ব্যবসায়ী স্বার্থই প্রধান হয়ে উঠবে, যা জনস্বার্থের অনুক‚ল নাও হতে পারে। আইনপ্রণয়নাদির ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। মহামান্য রাষ্ট্রপতির হালকা সুরে এই তীর্যক মন্তব্যের কথাটি সংবাদপত্র পড়ে অবাক হয়েছিলাম। তার কারণও আছে। সাধারণত ক্ষমতাসীন দল থেকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত বা নির্বাচিত হয়ে থাকেন। তারা সর্বক্ষেত্রে দলীয় চিন্তাকে গুরুত্ব দেবেন, এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক। অন্যান্য ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির ভ‚মিকা যেমনই হোক এই বিশেষ বক্তব্যটি ছিল দলীয় বিবেচনার বাইরে। আমার কাছে ঘটনাটি অসাধারণ মনে হয়েছে। দুই. ইতোমধ্যে তার কোনো কোনো বক্তব্যে এ জাতীয় বৈশিষ্ট্যের আভাস ফুটে উঠতে দেখেছি। আমরা জানি তিনি ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চলের মানুষ, গণসংশ্লিষ্ট চরিত্রের অভিজ্ঞতা নিয়ে তার রাজনৈতিক জীবনের ক্রমপ্রকাশ। মাটি ও শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক গভীর। দু-একবার বিশেষ সাক্ষাৎ উপলক্ষেও দেখেছি তার গণচেতনার দেহাতিভাষিক চরিত্র, যা মাঝেমধ্যে রাষ্ট্রপতি পদ উপলক্ষে শিক্ষয়তনিক ভুবনে সর্বোচ্চ সম্মানজনক অনুষ্ঠানে বক্তৃতায় প্রকাশ পায়। তাতে তিনি সংকোচ বোধ করেন না। আবার একই সঙ্গে দলীয় বিবেচনার বাইরে কখনো কখনো অপ্রিয় সত্য উচ্চারণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন না। তার এই চরিত্র বৈশিষ্ট্য কমবেশি সবারই জানা। সম্প্রতি তিনি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আচার্যের ভাষণ দিতে গিয়ে আটপৌরে ভাষায় যা বলেছেন আমার বিবেচনায় তা সাংস্কৃতিক বোমা ফাটানোর মতো ঘটনা বলেই মনে হলো। তার বক্তব্য উদ্ধারের আগে আমাদের সর্বোচ্চ শিক্ষায়তনগুলোতে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে সামান্য দু-চারটা কথা বলে নেয়া দরকার মনে করছি। কী সরকারি, কী বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে শিক্ষাদান, প্রশাসন ইত্যাদি নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগ বিস্তর, অভিযোগ অভিভাবকদেরও। এমনকি দেশের সচেতন বোদ্ধা মানুষের। শুধু অব্যবস্থা বা দলীয় পক্ষপাতিত্ব বা পৃষ্ঠপোষকতাই নয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও যথেষ্ট। এর কারণও রয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের উপচার্যরা শাসকশ্রেণি কর্তৃক মনোনীত হয়ে আসেন। স্বভাবতই কারো কারো আচরণে পাল্টা দলীয় পক্ষপাতিত্ব ও পৃষ্ঠপোষকতা যেমন প্রকাশ পায়, তার চেয়ে আপত্তিকর পরিস্থিতি অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রশ্রয়। সেই সঙ্গে একই ধারা পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ যেমন শিক্ষক প্রসঙ্গে তেমনি শিক্ষার্থী প্রসঙ্গে অনস্বীকার্য সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে সর্বাধিক গুরুতর ঘটনা দুর্নীতি। যেমন কখনো প্রশাসনে কখনো কোনো শিক্ষকের ক্ষেত্রে। এ ব্যবস্থার কারণে গত কয়েক মাস ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ (অর্থাৎ সরকার সমর্থকরা বাদে) সেখানকার উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ, মিছিল জারি রেখেছে, মাঝেমধ্যে উপাচার্যকে ঘেরাও। সরকারি হুমকি তারা গ্রাহ্য করছে না। উপাচার্যের অনিয়ম ও দুর্নীতির সাক্ষ্য-প্রমাণ সংবলিত নথিপত্রও তারা প্রকাশ করেছেন। তাদের প্রধান দাবি উপচার্যের অপসারণ। কিন্তু এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনকি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অনড়। যেমন ইতোপূর্বে দেখা গেছে বুয়েটে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা উপলক্ষে উপাচার্যের পদত্যাগ ও অপসারণের জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি আন্দোলন সত্তে¡ও অস্বীকৃত হয়েছে। এ জাতীয় ঘটনার রাজনৈতিক তাৎপর্য না বোঝার মতো নয়। ইতোপূর্বে অনুরূপ ঘটনা অন্যত্র ঘটেছে। অবশ্য ক্ষেত্রবিশেষে উপাচার্য অপসারিত। কিন্তু দুর্বোধ্য কারণে উল্লিখিত দুই ক্ষেত্রে সরকার তাদের সিদ্ধান্তে অটল। অবশ্য বুয়েট এ ব্যাপারে এ মুহূর্তে অশান্ত না হলেও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের অশান্তি বন্ধ হচ্ছে না। দেশের শিক্ষায়তনজুড়ে এবং শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট বোদ্ধারা সমালোচনায় সোচ্চার, সংবাদপত্রে তা প্রকাশ পাচ্ছে নিয়মিত। আমরা এ অস্থির অবস্থার যুক্তিগ্রাহ্য অবসান চাই। তিন. এবার পূর্ব প্রসঙ্গ। ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই মহামান্য রাষ্ট্রপতি তথা বিশ^বিদ্যালয়ের আচার্য লক্ষ করে থাকবেন। সম্ভবত এ ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও তার বিস্ফোরক মন্তব্যের নেপথ্য কারণ রূপে বিবেচনাযোগ্য বলে মনে হয়। তা না হলে পূর্বোক্ত সমাবর্তন বক্তৃতায় আচার্য হিসেবে এত অপ্রিয় কথার প্রকাশ ঘটনাতেন না রাষ্ট্রপতি। তিনি তার বক্তৃতায় নিয়মতান্ত্রিক বক্তব্যের পাশাপাশি সাধারণভাবে বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছু অভিযোগ তুলে তাদের আচরণ সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন। তার অভিযোগ থেকে দেশের বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও রেহাই পাননি। তার বক্তব্য সম্পর্কে একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘উপাচার্যরাই দুর্নীতি করলে কি হবে বিশ^বিদ্যালয়ের’। তিনি উপাচার্যদের ‘সততা, নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।’ তিনি আরো বলেন, ‘এক শ্রেণির শিক্ষক বিশ^বিদ্যালয়ের চাকরিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সান্ধ্যকালীন কোর্স ও প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে সপ্তাহব্যাপী ব্যস্ত সময় কাটান। যত অনীহা নির্ধারিত ক্লাস নেয়ার ক্ষেত্রে।’ অভিভাবকদের নকল সাপ্লাই সম্পর্কে ক্ষুব্ধ আচার্য দুয়েকটি কঠোর কথা, শেষে তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলেন : ‘মনটা চায়, আর কইলাম না... বুইঝা নিয়েন।’ এই হলেন আমাদের রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। সরল, সাদাসিধা, সৎ নীতিবান রাজনীতিবিদ, বয়ানে কখনো কঠোর কঠিন। বাংলাদেশের সমাজ, এমনকি শিক্ষায়তন (ছাত্র-শিক্ষক) যে কতটা দূষণে আক্রান্ত তার বহু প্রমাণ নিত্যদিনের খবরে প্রকাশ। একটি উদাহরণ (১৫-০১-২০২০) : ‘ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস ও জালিয়াতি, অস্ত্র ও মাদকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ঢাবির ৬৭ শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কারের সুপারিশ করেছেন বিশ^বিদ্যালয় শৃঙ্খলা কমিটি।’ লেখা শেষ করতে হবে, তাই শুধু একটি প্রশ্ন : শিক্ষার্থীদের এ অবস্থার জন্য শিক্ষক ও প্রশাসনের কি কোনো দায় বা ভ‚মিকা নেই? স্মর্তব্য আচার্য মহোদয়ের বক্তব্য ও সতর্কবাণী। আহমদ রফিক : লেখক, গবেষক ও ভাষাসংগ্রামী।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App