×

জাতীয়

শোষকের নয়, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষিতের গণতন্ত্র

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জানুয়ারি ২০২০, ০৩:৩১ পিএম

শোষকের নয়, বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন শোষিতের গণতন্ত্র

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: ফাইল।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণ। পুঁজিবাদী শোষকের গণতন্ত্র থেকে সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষিত দিন। এদিন জাতীয় সংসদের বিশেষ অধিবেশনে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থেকে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ নেয়া হয়। সদ্যপ্রসূত দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শোষণহীন বাংলার স্বপ্নবীজ রোপণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল (বাকশাল প্রবর্তন) গৃহীত হওয়ার পরদিন জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু একটি দীর্ঘ ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন,

‘আমি চাই শোষিতের গণতন্ত্র, শোষকের নয়। এখনো মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। যে মানুষের কাপড় নাই, যে মানুষ বন্ধু খুঁজে পায় না, যার বুকের হাড্ডি পর্যন্ত দেখা যায়, আমি জীবনভর এদের সঙ্গে থেকে সংগ্রাম করেছি। এদের পাশাপাশি রয়েছি। কারা নির্যাতন ভোগ করেছি। আমার সহকর্মীরা জীবন দিয়েছে। তাদের দুঃখ দূর করার জন্য আমি একদিন এই হাউজে বলেছি, আমরা শোষিতের গণতন্ত্র চাই।’

‘যারা রাতের অন্ধকারে পয়সা লুট করে, যারা বড় বড় অর্থশালী লোক, যারা ভোট কেনার জন্য পয়সা পায় তাদের গণতন্ত্র নয়, শোষিতের গণতন্ত্র। এটা আজকের কথা নয়, বহুদিনের কথা আমাদের।’

এছাড়া, ওই বছরই অর্থাৎ, ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া ভাষণ ও বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে বঙ্গবন্ধুর দেয়া বক্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য। দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে, কৃষক ও শ্রমিকদের কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু তার দ্বিতীয় বিপ্লবের পরিকল্পনা সফল করতে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠন করেছিলেন। বাকশাল গঠনে বঙ্গবন্ধু দেশের কৃষক শ্রেণিকেই এগিয়ে রেখেছিলেন। এরপর শ্রমিক ও সর্বশেষে আওয়ামী লীগ। বাকশাল গঠন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,

‘আমি স্বজ্ঞানে, বিচার-বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলোকে, আমার দীন-দুঃখী মেহনতি মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছি।’

বাকশালের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু বাংলার দুঃখী, মেহনতি, শোষিত মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যাকে তিনি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বা ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ নামে অভিহিত করেছিলেন। এ জন্য রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শ সমন্বিত রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থার একটি রূপরেখা প্রণয়ন করেন তিনি। দ্বিতীয় বিপ্লবের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক রাজনৈতিক চিন্তাধারা পূর্ণভাবে বিকশিত হয়েছিল। সেই রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের আগেই তাকে হত্যা করা হয়।

শক্ত হাতে প্রশাসন চালাতে প্রশাসককে যে কঠোরতা অবলম্বন করতে হয় কোমল হৃদয়ে ভালোবাসায় পূর্ণ বঙ্গবন্ধু হয়তো সেটি পুরোপুরি করতে পারেননি। জনক কি কখনো ওতোটা কঠোর হতে পারেন! বঙ্গবন্ধু ছিলেন উদার হৃদয়ের মানুষ। ন্যায্য দাবি আদায়ে যতটা সংগ্রামী ছিলেন, কোমল মনে বাঙালির জন্য ভালোবাসাও তার কোনো অংশে কমতি ছিল না। তাইতো মুক্তিযুদ্ধকালিন যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের ছাড়া সবাইকে সাধারণ ক্ষমা করে দেশ গড়ার কাজে সহায়তা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তে তার পরম বন্ধু ফিদেল ক্যাস্ত্রো পরবর্তীকালে বলেছিলেন, এটি তার একটি ভুল সিদ্ধান্ত। এরাই একদিন তার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে। হয়েছেও তাই। রাজাকার, আলবদর আর জামায়াতের সদস্যরা প্রথমে গিয়ে জুটল মওলানা ভাসানীর ন্যাপে। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে যখন জাসদ গঠিত হলো তখন অনেকে সেখানে আশ্রয় নিল। সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি, আবদুল হকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি। জাসদ গঠন করলো তার সশস্ত্র বাহিনী ‘গণবাহিনী’। বিদেশি অর্থে দেশি পত্রিকা প্রকাশ হওয়া শুরু হলো। তারা বানানো সংবাদ পরিবেশন করে দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করা শুরু করলো।

সারা বিশ্বে খাদ্যের দাম তখন চড়া। বিদেশ থেকে খাদ্য কিনে আনার আর্থিক সঙ্গতি বাংলাদেশের ছিল না। এরই মধ্যে ঢালাওভাবে প্রচার শুরু হলো বাংলাদেশের সব খাদ্য ভারতে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশে খাদ্যই নেই, তার আবার পাচার! কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত খাদ্যবাহী জাহাজ মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিল। এসবই পর্দার অন্তরালে বঙ্গবন্ধুকে দেশে-বিদেশে হেয় করার ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। ওই দুর্যোগ অবস্থায় বাংলার মানুষকে বাঁচানোর জন্য বঙ্গবন্ধু পাঁচ হাজার ৭০০ লঙ্গরখানা খুলেছিলেন।

১৯৭৩ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৩১৫টি আসনের মধ্যে ৩০৭টি আসনে জয়লাভ করে। বঙ্গবন্ধু তখন বাকশাল পদ্ধতি চালু করার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, তিনি দেশপ্রেমিক মানুষদের দেশ গড়ার কাজে লাগাতে চান। দেশের মঙ্গল কামনা করেন এমন অনেক মানুষ দলের বাইরে আছেন, তাদের সুযোগ দেয়ার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন। সেটি হতে পারে তার এই নতুন ধারণার ‘বাকশাল’। তাই তিনি বাকশালকে বলতেন জাতীয় দল এবং তাতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ সদস্য হতে পারতেন, যদি তারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন, মঙ্গল চান।

বাকশাল একদলীয় কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের একটি সম্মিলিত প্ল্যাটফর্ম। তাই বাকশাল গঠনে জাতীয় সংসদে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,

‘আজকে আপনারা মনে রাখবেন, নতুন জাতীয় দল বাকশালে আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স, সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি কর্মচারী, পলিটিশিয়ান, শিক্ষাবিদ, ডক্টরস, বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ার্স, যতদূর সম্ভব তাদেরও রাখার চেষ্টা করেছি। লেট আস ওয়ার্ক টুগেদার।’

কিন্তু দেশদ্রোহী কুচক্রীদের চক্রান্তে বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সে স্বপ্নের যবনিকাপাত ঘটে।

পরবর্তীতে মহিউদ্দিন আহম্মদ ও আবদুর রাজ্জাক চেষ্টা করেছিলেন বাকশাল পুনরুজ্জীবিত করতে। কিন্তু সফল হননি, কারণ সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেছে। তারাও এক সময় আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছেন। যে মানুষটি আজীবন লড়াই করেছেন কখনো পরাজিত হননি সেই বঙ্গবন্ধু ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।

বাংলাদেশ হয়তো আর কখনোই বাকশাল ব্যবস্থায় ফিরে যাবে না। কারণ, সময়ের সঙ্গে অনেক কিছু বদলে গেছে। বদলে যাওয়া সমাজের ধর্ম। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাকশাল প্রতিষ্ঠা করে দ্বিতীয় বিপ্লবের যে সূচনা করেছিলেন সেটি চলমান থাকলে হয়তো আজকের বাংলাদেশ অনেক আগেই উন্নত দেশে পরিণত হতো। বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে যে দুর্নীতি আর আর্থিক লুটপাট শুরু হয় এবং যুগের পর যুগ চলে, তা থেকে সহসাই মুক্তি মেলার কথা নয়। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সারের মতো ছেয়ে যাওয়া দুর্নীতি নিমিষেই হাওয়া হয়ে যাবে সেটি ভাবা মোটেও সমীচীন নয়। শাসক শ্রেণি শোষকের ভূমিকায় চলে গেলে তার চেয়ে দুঃখের কিছু নেই।

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যখন বিরোধীদল রাস্তায় গাড়ি পোড়ায়, পেট্রল বোমা মেরে মানুষ মারে, উন্নয়ন কাজে বাধার সৃষ্টি করে- তখন বঙ্গবন্ধুর বাকশাল করার পরের সময়গুলোর কথা মনে পড়ে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের উন্নয়ন কাজের সুষ্ঠু সমাপ্তির জন্য গণমুখী সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত কখনো কখনো একপেশে মনে হলেও আদতে তা জনকল্যাণই বয়ে আনে। সেই কাজ বাস্তবায়নের সময়টুকু সবার দেয়া উচিত।

লেখক: সাংবাদিক

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App