×

সাময়িকী

শীতঋতু বাঙালির সগন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২০, ১০:৩৮ পিএম

শীতঋতু বাঙালির সগন
মানবমনের সঙ্গে প্রকৃতির রয়েছে নিগূঢ় যোগসূত্র। প্রকৃতির বিচিত্র উপাদান ও অনুষঙ্গের মাঝে উল্লেখযোগ্য শীতঋতু। সেই আদিকাল থেকে শীতের সঙ্গে মানুষের গড়ে উঠেছে পরস্পর বিপ্রতীপ দুই সম্পর্ক। শীতের নানা উপহার ও উপাচার মানুষকে দেয় পরম প্রশান্তি; অপরদিকে তীব্র শীত আনে দুঃসহ কষ্ট। প্রশান্তি ও কষ্ট এই দুই ভাব নিয়েই শীত। শীতের অনুষঙ্গ নিয়ে অনেক বাঙালি কবিই কবিতা লিখেছেন। শীত আমাদের কবিদের রচনায় এসেছে বিভিন্ন বোধ ও অভিজ্ঞানের সৃষ্টি-উৎস হিসেবে। শীত বাঙালি কবিদের সৃষ্টিশীল চৈতন্য বিকাশে পালন করেছে দূরসঞ্চারী এবং বহুমাত্রিক ভূমিকা। শীতঋতু নিয়ে এবারের সাময়িকী
শীতঋতু নিয়ে সবার কী অনুভব সে জিজ্ঞাসার গ্রন্থি উন্মোচনের চেষ্টা না করে, আমি বরং নিজের শীতবিষয়ক ভাবনার কথা আগে খোলাশা করি। শৈশবেই আমার শীতানুভূতির যোগ; যখন আমি গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত-বসন্তের সন্ধান পাইনি; বর্ষা হয়তো কিছুটা বুঝি কিন্তু অনুভবের সুযোগ পাইনি। শীতের আমেজ টের পেলাম প্রথম, যখন শেষরাতে ঘুম থেকে জেগে খেতে হতো। আমাদের শৈশবে শীতে রোজা করতে হতো; বালক বয়সে রোজা রাখার আবেগের বিপক্ষে দাঁড়াতো শীত। শেষরাতে লেপের ওম থেকে বেরিয়ে খেতে বসার আবশ্যিকতায় বুঝে যেতাম শীতের প্রকোপ। বর্ষার অবশ্য তখন অন্য আকর্ষণ, বর্ষা আনন্দের ঋতু; বর্ষার প্রথম আনন্দ; অধিক বর্ষণে স্কুল ছুটি, পড়ালেখার জন্য যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না; দ্বিতীয় আনন্দ স্কুলে যেতে না হলেও খেলায় বেঘাত নেই, জল-কাদায় ভিজেও খেলা চলে বন্ধুদের সঙ্গে। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে জ্বর। জ্বর মানে পাউরুটি-দুধ, কালেভদ্রে আঙুর; জ্বর মানে আবার পড়া থেকে ছুটি! অসহ্য পড়ালেখার চাপ থেকে ছুটির আনন্দই যেন বৃষ্টি, প্রিয় বর্ষাঋতু। তা না হলে গ্রীষ্ম-বর্ষার ফারাক করতে জানিনি তখন, বুঝিনি হেমন্ত-শীতের ফারাক; শরৎ-হেমন্ত কেন আলাদা কে জানতো তখন? দীর্ঘ অভিনিবেশনে যখন আবিষ্কার করতে শিখলাম বাংলার ষড়ঋতুর স্বাতন্ত্র্য, তখন থেকেই লক্ষ করছি প্রকৃতির বিপর্যয়। কোনো কোনো বছর যেমন গ্রীষ্মে এসে বর্ষা দাপট দেখাচ্ছে, কখনো হেমন্তেও বৃষ্টি; কখনো বসন্তে গ্রীষ্ম হানা দিচ্ছে, কখনো বসন্তে বর্ষার ফুল কদম এসে করে অনাসৃষ্টি। সব বিপর্যয় ডিঙিয়ে বাংলার শীতঋতু অনেকটাই নিজের অবস্থানে আছে। এখনো সহস্র বিপর্যয়ের মুখে শীতকালে ‘টেলকা’ লাগে, ‘জার’ লাগে; শীতকাতর মানুষ নাড়ায় আগুন জ্বালিয়ে সেঁকে নেয় হাত-পা, শীতে সব্জিক্ষেতে ‘ফইট্টাপরিবার’ খেলা করে, মরিচের টালে লঙ্কা লাল রঙ হলে, ঝাঁক বেঁধে সবুজ টিয়ারা খেয়ে যায় লাল মরিচ; সরিষাক্ষেতে সোনারঙ ফুল ফোটে; নদীতীরে চর জুড়ে মটর-মসুর-মাস-খেসারি কলাই আর মটরশুঁটির ফুলের ডাকে পতঙ্গকুল ভিড় করে, কৃষকের আঙিনার মাচায় শীতলাউ ঝোলে; মুলো-মৌরি ফুলের সুবাস ছুঁয়ে ফোটা মিষ্টি লাউয়ের কাঁচাসোনাবরণ কলকে-ফুলের রূপে অধীর হয়ে ভ্রমরেরা আসে; রাতভর শিশির ঝরে, ভোরে ঘাসে ঘাসে শিশিরের বিন্দু জমে থাকে, সূর্যোদয়ের পর ঘাসের শিশিরে যুক্ত হয় হীরকের দ্যুতি। খেজুরের গাছে ঝুলিয়ে রাখা রসের হাঁড়িগুলো কুয়াশার ভিড় ভেঙে গাছিরা সংগ্রহ করে নেয়ার আগেই শালিকেরা জটলা করে রস খেয়ে যায় শীতে প্রত্যুষ হওয়ার আগে। গ্রামগঞ্জে আজো ঘরে ঘরে পিঠা-পুলি-পায়েশের আসর জমে আর নগরে আবহমান বাংলার আমেজ আনতে উৎসব করে জমে ‘পিঠাপার্বণ’। ধানকাটা হয়ে গেলে কৃষকের ঘরে ঘরে নবান্ন, মাঠে মাঠে মেলা বসে, শুরু হয় যাত্রাপালা-কিসসা পালা-কবির লড়াই-কীর্তন-বাউল গানের আসর। বাংলার মার্জিত-সহনীয় প্রকৃতিতে নিরাপত্তার খোঁজে আমাদের হাওর-বাঁওড়-খাল-বিল-জলাশয়ে শীতের দেশ থেকে পরিযায়ী পাখিরা আসে। বাংলার শীতঋতুর এত আয়োজন যখন আবহমানকাল থেকে চলে আসছে বাংলাদেশে; তারপরও কেন শীতঋতু নিয়ে দুশ্চিন্তা? দুশ্চিন্তার অধ্যায়ে প্রবেশ করার আগে বাংলা সাহিত্যের কবিরা কে কী পঙ্ক্তি রচনা করলেন তার একটু খোঁজ নেয়া যাক। ধারণা করি কবিদের কবিতা পড়ে ‘দুশ্চিন্তা’র কারণ খোঁজার একটা দিশা পাওয়া যেতে পারে; আর সে আশায় হাত বাড়াই কবিতায়। বাংলা কবিতায় প্রকৃতির রূপ বর্ণনার পাশাপাশি মানবজীবনে প্রকৃতির নানামাত্রিক বিস্তৃতির কথাও এসেছে। বাঙালির জীবনে যেমন, কাব্যেও শীতের প্রভাব কম নয়; যদিও কবিতা ও গানে বর্ষা-বসন্তের যতটা বিস্তার শীতের ততটা নয়, তবে শীত এসেছে বহুরৈখিক ব্যঞ্জনায়। সরল উপস্থাপনায় বলতে পারি, শীতঋতু নিয়ে বাংলা কবিতার পঙ্ক্তি নির্মিত হয়েছে প্রধানত দুরকম উপস্থাপন শৈলীতে। প্রথমত, শীতঋতুর প্রাকৃতিক অবয়ব ফুটিয়ে তোলা; যেখানে বর্ণিত হয়েছে রূপ-বর্ণনা; যেখানে চিত্রকল্প হয়েছে প্রকৃতির আনন্দ-বেদনা। দ্বিতীয় ধারায় শীতানুষঙ্গের আশ্রয়ে ব্যক্ত হয়েছে মানবমনের আনন্দ-বেদনা, অথবা নিগূঢ় কোনো দার্শনিক অভিজ্ঞান। দুই ধারার কোনদিকের পাল্লা ভারী হবে নিশ্চিত করে বলা সহজ নয়, কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করা যায়, প্রথম ধারার চেয়ে দ্বিতীয় ধারার পঙ্ক্তিমালাই শীত-বিষয়ক কবিতার মহার্ঘ সম্পদ, প্রাজ্ঞজনের বিবেচনা পেয়েছে, হয়তো তাই আমারও এ কথা স্বীকার করে নেয়াই যৌক্তিক মনে করছি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বিপর্যয়কে ব্যঙ্গ করেছেন তীর্যক-তীক্ষ্ণ উপস্থাপনায় এদিকে কোকিল ডাকছে পউষের মধ্যরাতে; ‘কোনো একদিন বসন্ত আসবে বলে? কোনো একদিন বসন্ত ছিল তারই পিপাসিত প্রচার?’ একই কবিতার শেষটা বড় নির্মোহ কিন্তু শঙ্কাময়, কবি বলছেন, অরণ্য কীভাবে সংকটাপন্ন আর সিংহও, খসে পড়া কোকিলের ভুলে যাওয়া গানে পাহাড় নিস্তব্ধ! উপসংহারে পৃথিবীর উদ্দেশে বলছেন ‘হে পৃথিবী, হে বিপাশামদির নাগপাশ,- তুমি পাশ ফিরে শোও, কোনোদিন কিছু খুঁজে পাবে না আর। শীতের মৃত্যুচুম্বিত রাতগুলো নিয়ে আর কী সত্য আমাদের জানা বাকি রইল, বলুন?’ জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘মাল্যবান’ উপন্যাসে শীতে মানুষের যৈবিক অভিঘাতটি প্রকাশ করেন অনন্য ব্যঞ্জনায়। শীতে মানুষের নিঃসঙ্গতায় কতটা তীব্র অনুভ‚তি জেগে ওঠে সে দিকটি তুলে ধরেছেন তিনি। মাল্যবানে দুই মেরুর দুই মানব-মানবীর ভেতর শীতলতা আর উষ্ণতার আলোড়ন যেন শরীরে আগুন হয়ে জেগে ওঠে। রবীন্দ্রনাথে শীত-সন্ধান তো নিশ্চয়ই জরুরি; কেননা তিনি প্রতিটি ঋতু নিয়ে কবিতা আর গান লিখে বাংলার ঋতুচক্রের সৌন্দর্য উন্মোচন করেছেন পরম নিষ্ঠায়। বিশেষ করে গান; বর্ষা নিয়ে তাঁর গানের সংখ্যা দেড়শ’র মতো, বসন্ত নিয়েও কাছাকাছি; শরৎ বেশ পিছিয়ে, ত্রিশের মতো; শীত তারও নিচে, মাত্র বারোটি; অবশ্য শীতের নিচেও আছে হেমন্তঋতু; মাত্র তিনটি। তাঁর কবিতায় প্রেয়সী এবং দেবী, প্রেম এবং পূজা একাকার হয়ে যায় যখন রবীন্দ্রনাথ লিখেন ডেকেছো আজি, এসেছি সাজি, হে মোর লীলাগুরু শীতের রাতে তোমার সাথে কী খেলা হবে শুরু! ভাবিয়াছিনু গতিবিহীন গোধূলিছায়ে হলো বিলীন পরাণ মম, হিমে মলিন আড়ালে তারে হেরি? উত্তরবায় কারে জাগায়, কে বুঝে তার বাণী অন্ধকারে কুঞ্জদ্বারে বেড়ায় কর খানি। (উদ্বোধন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) অথবা নির্মম শীত তারি আয়োজনে এনেছিল বনপারে, মার্জিয়া দিল শ্রান্তি ক্লান্তি মার্জনা নাহি কারে। জ্ঞান চেতনার আবর্জনায় পান্থের পথে বিঘ্ন ঘনায়, নবযৌবনদূতরূপী শীত দূর করি দিল তারে। (বোধন/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) শীতের অনাকাক্সিক্ষত রূপের ছবি এভাবেও আমরা পেয়ে যাই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়; আবার তাঁর ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতায় রাজরানীর শীত নিবারণ প্রক্রিয়া এবং রাজার বিচারকার্য আমাদের কত সহজেই আমাদের আলোড়িত করে। আমরা একবার স্মরণ করে নিতে পারি বহে মাঘমাসে শীতের বাতাস, স্বচ্ছসলিলা বরুণা। পুরী হতে দূরে গ্রামে নির্জনে শিলাময় ঘাট চম্পকবনে, স্নানে চলেছেন শতসখীসনে কাশীর মহিষী করুণা। এবং তারপরও রবীন্দ্রনাথ আহ্বান করেন পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়। ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে, মরি হায় হায় হায়\ হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে দিগ্?বধূরা ধানের ক্ষেতে রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি হায় হায় হায়\ মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হলো। ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো খোলো দুয়ার খোলো। আলোর হাসি উঠল জেগে ধানের শিষে শিশির লেগে ধরার খুশি ধরে না গো, ওই যে উথলে, মরি হায় হায় হায়।। বাংলা কবিতায় শীতের কথা উচ্চারিত হয়েছে শত শত বর্ষ ধরে। আমরা যদি বাংলা মঙ্গলকাব্য অথবা মধ্যযুগের কবিতা পড়ি, সেখানেও শীত-প্রসঙ্গ পাবো। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘মেঘনাদ বধ কাব্যে’ পুত্রশোকে কাতর চিত্রাঙ্গদা দেবীর আভরণহীন দেহকে পত্র-পুষ্পহীন শীত-প্রকৃতির সাথে উপমিত করে কতটা শিল্পিতভাবে উপস্থাপন করেছেন, নিচের কটি পঙ্ক্তিতে আমরা তাই জেনে নেবো আলু থালু, হায়, তবে কবরীবন্ধন! আভরণহীন দেহ, হিমানীতে যথা কুসুমরতন-হীন বন-সুশোভিনী লতা! (মেঘনাদবধ কাব্য/মাইকেল মধুসূদন দত্ত) নজরুলের কবিতায় শীতঋতুর রূপ উপস্থাপিত হয়েছে শীতের পাতা-ঝরা রিক্ততায়; কিন্তু সেই বিষণ্ণতার মধ্যেও নজরুল যেন আবিষ্কার করেন পরমানন্দের এক নতুনের আবাহনগীত পউষ এলো গো! পউষ এলো অশ্রুপাথার হিম-পারাবার পারায়ে। ঐ যে এলো গো কুজ্ঝটিকার ঘোমটা পরা দিগন্তরে দাঁড়ায়ে। সে এলো আর পাতায় পাতায় হায় বিদায়-ব্যথা যায় গো কেঁদে যায়, অস্ত-বধূ (আ-হা) মলিন চোখে চায়। পথ-চাওয়া দীপ সন্ধ্যা-তারায় হারায়ে পউষ এলো গো এক বছরের শ্রান্তি পথের, কালের আয়ু ক্ষয়, পাকা ধানের বিদায়-ঋতু নতুন আসার ভয়। (পউষ/কাজী নজরুল ইসলাম)। কবি-সম্পাদক-সমালোচক বুদ্ধদেব বসুর শীত বিষয়ক কবিতার কথা আমরা সহজেই স্মরণ করতে পারি। বুদ্ধদেব বসু শীত-অনুষঙ্গটিকে দার্শনিক উপলব্ধি দিয়ে উচ্চারণ করেছেন তাঁর কবিতায়। আমরা এখানে তাঁর দুটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধার করছি। আমি যদি মরে যেতে পারতুম এই শীতে, গাছ যেমন মরে যায়, সাপ যেমন মরে থাকে সমস্ত দীর্ঘ শীত ভ’রে। যদি আমিও মরে থাকতে পারতুম যদি পারতুম একেবারে শূন্য হয়ে যেতে, ডুবে যেতে স্মৃতিহীন, স্বপ্নহীন অতল ঘুমের মধ্যে তবে আমাকে প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে হতো না এই বাঁচার চেষ্টায়, খুশি হবার, খুশি করার, ভালো লেখার, ভালোবাসার চেষ্টায়। (এই শীতে/বুদ্ধদেব বসু) আবার মৃত্যুর নাম অন্ধকার, কিন্তু মাতৃগর্ভ তাও অন্ধকার, ভুলো না, তাই কাল অবগুণ্ঠিত, যা হয়ে উঠছে তা-ই প্রচ্ছন্ন; এসো, শান্ত হও; এই হিম রাতে, যখন বাইরে-ভিতরে কোথাও আলো নেই, তোমার শূন্যতার অজ্ঞাত গহ্বর থেকে নবজন্মের জন্য প্রার্থনা করো, প্রতীক্ষা করো, প্রস্তুত হও। (শীতরাত্রির প্রার্থনা/বুদ্ধদেব বসু) শীতে বৃক্ষেরা তাদের সব আভরণ ঝেরে ফেলে পত্রপুষ্পশূন্য হয়ে যায়। শীতের এই নিরাভরণ-বেশ কবি জসীমউদ্দীনের চোখে ধরা পড়ে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনায়। সে কি ওই চরে দাঁড়ায়ে দেখিবে বরষার তরুগুলি, শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি? হয়তো দেখিবে, হয় দেখিবে না, কাল সে আসিবে চরে, এপারে আমার ভাঙা ঘরখানি, আমি থাকি সেই ঘরে।’ (কাল সে আসিবে/জসীমউদ্দীন)। তপস্যারত ঋষির মতো শীতঋতু যেন ধ্যানে বসেছে তার সব আভরণ খুলে। নাগরিক জীবনে শীতের স্বরূপ রচনা করেছেন শামসুর রাহমান নিষ্ঠার সঙ্গে। ফ্ল্যাট বাড়িটাকে মৃদু চাবকাচ্ছে ঘন ঘন এই শীত, পঞ্চাশোর্র্ধ্ব ত্বকে দাঁত বসায় তাতার হাওয়া...’। (পড়েছে শীতের হাত/শামসুর রাহমান) দীর্ঘ এ কবিতাটি শীতের দীর্ঘ রাতের মতো অনড় যেন। কবিতাটিতে শামসুর রাহমান ফুটপাতে শুয়ে থাকা ‘পশুর ধরনে’র মানুষ, ‘নেশাময় মেথরপট্টির’ কথাও বর্ণনা করেছেন। শীতঋতুতে খেজুর গাছ কেটে রস-সংগ্রহ করা আবহমান বাংলার এক চিরচেনা ছবি। কবি সানাউল হকের ‘দুটি গাছ’ শিরোনামের কবিতায় ‘রস’ নিয়ে রসবোধ নয়, বরং গাছের বেদনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে। পাশেই খেজুরগাছ সতেরটি শীতাতঙ্কের সতেরটি অস্ত্রোপচারের ক্ষতচিহ্ন-ইতিহাস কালো-কালো দীর্ঘশ্বাস বুকে-পিঠে নিয়ে নিরালে ঝিমায় তার দিকে কে তাকায়? (দুটি গাছ/সানাউল হক) আবার দেখি রফিকুল হক দাদুভাই-এর ছড়ায় দেখতে পাই শীতের ভিন্ন ব্যঞ্জনা কাঁপা ঠকটক বকা বকবক/ থুরি!/ তোর নাম আরে/ শীতকাল না-রে বুড়ি?/ আয় বুড়ি ভাই/ আগুন তাপাই/ নেই লেপ নেই কম্বল/ ও বুড়ি আদুরে/ শুবি কি মাদুরে?/ ছেঁড়া কাঁথাটাই সম্বল।/শীতের বুড়ি শীতের বুড়ি কাঁপছো কি বুড়ি ঠকঠক?/ বলবে কি বুড়ি কার সাথে এতো বকবক?/খুব জ্বর বুঝি-সদ্দি?/ ডেকে দিই ভালো বদ্যি?/ এ কপালটা যে রদ্দি,/ ডাক্তার কোথা পাই?/ মেলে কই বুড়ি/ আমরা যেটুকু চাই?/ আবার এসো হ্যাঁ/ আবার/ থাকবে যখন খাবার/ হবে সম্বল/ গরম কাপড় কম্বল/ থাকবে না কিছু চাবার/ ও বুড়ি দোহাই/ আজ যাও ভাই/ উত্তাপ চাই/ রোদ দাও/ আর কর্মের/ বোধ দাও। (শীতবুড়ি/রফিকুল হক দাদুভাই) শীতকাল নিয়ে মুহম্মদ নূরুল হুদার ছোট্ট একটি কবিতার কথাও আমরা স্মরণ করতে পারি আমাকে উষ্ণতা দাও হে নিশীথ শিশির নিশীথ, নিশির গভীরে জ্বলে বর্তমান ভবিষ্যৎ জীবেদের তৃষিত অতীত। (কালশীত/মুহম্মদ নূরুল হুদা) মুহম্মদ নূরুল হুদার মতো সমকালীন আরো অনেকের কবিতায়ই আমরা শীতের দেখা পাই, সেসব পঙ্ক্তি কখনো কখনো আমাদের চমকে দেয়। কয়েকজন কবির রচনায় আসুন আমরা শীতের সন্ধান করি। ‘শীতের ঢেউ নামি আসবে ফের/আমার বুড়ো হাড়ে ঝনাৎকার’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ) ‘সব মরবে এবার শীতে/ কেবল আমার ফুসফুসের পাতাঝরার শব্দ ছাড়া’ (এবার শীতে : আবিদ আজাদ) ‘আমিও সারারাত মৃত মানুষের শীতে শীতার্দ্র হয়েছিলাম’ (নষ্ট অন্ধকারে : রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ) ‘শীতের আকাশ যেন কুড়োতেছে নাক্ষত্রিক বরফের কুচি’ (প্রত্যাবর্তন নিজের দিকে : আসাদ মান্নান) ‘কনকনে শীতের দুপুরে জাদুবাস্তবতা প্রকৃতির রূপরহস্য/আলোর গোলক হয়ে বিষুবরেখার ভেতরে আবর্তিত হতে থাকে’ (শীতের কবিতা : সুহিতা সুলতানা) শীতের এমনি অনেক চিত্রকল্প আমরা পাই, যা কখনো প্রকৃতির রূপবর্ণনা কখনোবা চেতনা অথবা চিৎপ্রকর্ষের দার্শনিক উপস্থাপন। নিচের কবিতাটি পড়ার সাথে সাথে আমাদের মানসচোখে গ্রামবাংলার খুব চেনা ছবি ভেসে আসবে, সেই সাথে সম্প্রীতির বাংলাদেশ। সারারাত গাঢ় কুয়াশার ভেতরে মাতাল জাহাজের মতো আমাদের ঘর গৃহস্থালি; বস্তুত এ রকম অবাঙালি শীত আমরা অনেক অনেক দিন আদৌ দেখিনি; আত্মরক্ষার জন্যে কোনো আশ্রয় নেই। এমনকি ভোর হলেও আকাশ উপচে নামে সোনালী তরল। তাছাড়া, গোল হয়ে বসে একসাথে সহৃদয়, আগুনে হাত সেঁকে নেয়ার মতো সম্প্রীতি কোথায়? (পূর্বপুরুষের মতো/আবু হেনা মোস্তফা কামাল) বাংলার সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ শীতের পিঠা নিয়ে লেখা একটা কবিতা স্মরণ করে শীতে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা শেষ করতে চাই। লোকবাংলার ঘরে ঘরে পৌষের শীত এলে পিঠা-পুলির পার্বণ আসে মাতে বুড়ো ছেলে তেলেরপিঠা-পোয়াপিঠা দুই নামে একজন ‘ম্যারা’ এবং ‘গুডাপিঠা’ অভিন্ন স্বজন; আওলাকেশী চিতইপিঠা দুই দিগন্তে থাকে দুধচিতইয়ের দুগ্ধ গড়ায় দুই আঙুলের ফাঁকে পুুলিপিঠা হরেক স্বাদের মিষ্টি এবং ঝাল নারকেল বা মাংশ পুরে খাচ্ছি কতকাল। তালেরপিঠা ভাদ্রমাসে দুধের নাড়ু মিষ্টি-মোয়া বর্ষজুড়ে পাই ঘনজ্বালে খেজুর রসে ‘চই’ ডুবিয়ে তৃপ্তির অন্ত নাই; কুমড়ো-বেগুন-আলুরপিঠা বারমাসই পাই নুন-মরিচের পিঠার স্বাদে আনন্দগীত গাই। নারকেল-গুড় দিলে ‘ভাপা’ সুস্বাদু কয় তারে সেমুইপিঠা-পাটিসাপটা খাচ্ছি বারে বারে, পিঠার রাজা পাকনপিঠা কারুকার্যময় শিল্পীহাতের স্পর্শ পেয়ে করে বিশ্বজয়। কন্যা-জায়া-জননীরা যত্নে বানায় পিঠা ভগ্নিকুলের ছোঁয়া পেয়েই হচ্ছে পিঠা মিঠা। কবিরা শীত এলে বানায় হরেক স্বাদের পিঠা ব্যর্থ হয়ে যাবে সবই কাব্যধান্য শস্যগুলি হয় যদি সব ‘চিটা’। (শীতের পিঠা/ফরিদ আহমদ দুলাল) বাংলার শীতঋতুর এতো আয়োজন যখন আবহমানকাল থেকে চলে আসছে বাংলাদেশে, আর আমাদের সগন হয়ে আছে। তারপরও কেনো শীতঋতু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা? আমাদের পরিপার্শ্বে প্রকৃতি যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে, যেভাবে নগরায়নের বিস্তৃতি ঘটছে; শঙ্কা হয়, আগামী প্রজন্মকে শীতানুষঙ্গের সন্ধানে জাদুঘরের শরণাপন্ন হয় কি-না? তাই নিবেদন করি, জীবনে আধুনিকতার যোগ হোক, জীবন সহজ হোক, ঋদ্ধি আসুক জীবনে; কিন্তু সেই ঋদ্ধি, সেই আধুনিকতার যোগ ঘটাতে গিয়ে আমরা যেন কখনোই উন্মূল হয়ে না পড়ি। প্রিয় শীতকাল-শীতঋতু বাঙালির সগন হয়ে থাকো। আমাদের বুকের গহীনে শীতের জন্য যে আকুতি উচ্চারিত হয় সুরে সুরে সে আকুতি যেনো বিপন্ন না হয়ে যায়। ‘পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেইদিন...

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App