×

আন্তর্জাতিক

আঞ্চলিক-ভূরাজনীতিতে চীনের ‘গুটি’ মিয়ানমার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জানুয়ারি ২০২০, ১২:১৭ পিএম

আঞ্চলিক-ভূরাজনীতিতে চীনের ‘গুটি’ মিয়ানমার

মিয়ানমার নেত্রী সু কির হাত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের উচ্চাভিলাষ পূরণে কতোটা সহায়ক হবে তাই এখন দেখার বিষয়। ফাইল ছবি। 

গত সপ্তাহে রোহিঙ্গা-সংকটে বিশ্বে একঘরে হয়ে থাকা মিয়ানমার সফর করে গেলেন চীনা নেতা শি জিনপিং। এর আগে ২০০০ সালের দিকে প্রথম চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশটিতে পা রাখেন জিয়াং জেমিন। নিয়মমাফিক কয়েকটি বৌদ্ধমন্দির পরির্দশন করেন শি। আর অঙ্গীকার করে যান, বিপুল চীনা বিনিয়োগের। যদিও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায় মাথায় নিয়ে জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বের কাছে দেশটি তখনো ছিল একঘরে।

প্রায় ২০ বছর পর দ্বিতীয় চীনা প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিয়ানমারে যান শি। এ সময়ে অনেক কিছুই বদলেছে চীনে, ও বাদবাকি বিশ্বে। জাপানকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পর বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে চীন। থাইল্যান্ডকে হটিয়ে মিয়ানমারের বৃহত্তম বিনিয়োগকারী এবং বাণিজ্য অংশীদার হয়েছে দেশটি। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দেশে নিজেদের দূতাবাস প্রতিষ্ঠা করেছে।

অন্যদিকে, প্রায় তেমন কোনো পরিবর্তনই ঘটেনি মিয়ানামরের হালচাল, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির। বছর দশেক ধরে গণতন্ত্রের একটি খোলস কোনোক্রমে গায়ে জড়াতে সক্ষম হলেও সমাজের সর্বস্তরে সেনাশক্তির দাপট চলছে আগের মতোই। পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট শান্তিতে একদা নোবেলজয়ী অং সান সু কি আজ পরিণত হয়েছেন সেনাশাসকের হাতের পুতুলে।

২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ ও দেশছাড়া করার পর থেকে দেশটি ফের একঘরে হয়ে পড়ে বিশ্বে। মাথার ওপর নেমে আসে বিশ্বের মুরুব্বি দেশগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংস্থার অবরোধ। এমনকি কৈফিয়ত তলব করা হয় সর্বোচ্চ শক্তিধর নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকেও। প্রতিবারই তাদের পতনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে শক্তিমান প্রতিবেশী চীন। গত বছর শেষ দিকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে গণহত্যার দায়ে মামলা এবং বিচার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে। আদালত এ বিষয়ে তাদের প্রথম পর্বের নির্দেশনা জানাবে এ সপ্তাহে। এমনই এক কঠিন সময়ে ফের আশা ও ভরসার বাণী নিয়ে দেশটি ঘুরে গেলেন চীনা নেতা শি।

গণমাধ্যম জানাচ্ছে, সফরকালে কয়েক’শ কোটি ডলার চীনা বিনিয়োগ অবমুক্ত হয় কিউয়াকপিউ বন্দরের জন্য। পাশাপাশি ৩৩টি সমঝোতা স্মারক সই করে দুই পক্ষ। এর মধ্যে ১৩টি চুক্তির লক্ষ্যই হচ্ছে অবকাঠামো খাত সম্প্রসারণ, যার মধ্যে আছে ১৩০ কোটি ডলারের কিউয়াকপিউ বন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প, নতুন বাণিজ্যকেন্দ্র ইয়াঙ্গুনের সঙ্গে হাইস্পিড রেল যোগাযোগ, ৮০০ কিলোমিটার দীর্ঘ তেল ও গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইন, শিল্প স্থাপনা ও স্মার্ট পোর্ট সিটিসহ নানাবিধ অবকাঠামো নির্মাণ। রাখাইন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত এ বন্দরের পাশাপাশি সেখানে শিল্পপার্কসহ গড়া হবে পোশাক প্রস্তুত ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাত কারখানা। যদিও প্রস্তাবিত প্রকল্প এলাকায় গেলে এখন অবধি চোখে পড়বে কেবলই আদিগন্ত শস্যক্ষেত আর সবুজ বনভূমি। এসব জায়গা থেকেই গত কয়েক দশকে উচ্ছেদ হয়েছে রোহিঙ্গারা। কর্মকর্তারা বলছেন, চীনা সহায়তায় এসব শিল্প উদ্যোগ চালু হলে অন্তত চার লাখ চাকরির সংস্থান সম্ভব হবে। আর তেমনটি হলে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনেরও।

বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি চীনের আরাধ্য অনেক আগে থেকেই। জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মতো চীনকেও তার প্রয়োজনীয় তেলের ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয় মধ্যপ্রাচ্য আর আফ্রিকার দেশগুলো থেকে। এই তেলের ৮০ শতাংশই ভারত মহাসাগর হয়ে সংকীর্ণ মালাক্কা প্রণালি দিয়ে এসে পৌঁছায় দক্ষিণ চীন সাগর তীরবর্তী বিভিন্ন চীনা বন্দরে।

এদিকে, দক্ষিণ চীন সাগরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেকদিন ধরেই চীনের টানাপড়েন চলছে এর উপক‚লবর্তী মার্কিন মদদপুষ্ট ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে। ফলত দূরত্ব বিবেচনায় মালাক্কা প্রণালি দিয়ে তেল আনয়নে চীনের বিস্তর খরচ, ঝুঁকিও বেশি। ফলে অনেকদিন ধরেই এর বিকল্প খুঁজছিল তারা। এই খোঁজাখুঁজিরই ফসল তার বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগের আওতায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অদূরে কিউয়াকপিউ দ্বীপে একটি গভীর সমুদ্র বন্দর।

দক্ষিণ এশীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় মিয়ানমারের প্রেক্ষিত ভিন্ন। চীনের সঙ্গে রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার পর দীর্ঘতম ২,২০০ কিলোমিটার স্থলসীমান্ত রয়েছে এ দেশটির সঙ্গেই। একুশ শতকের সিল্ক রুট গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৃহীত বেল্ট এন্ড রোড উদ্যোগে মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেয় ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তখন চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণে চুক্তিবদ্ধ হয়। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে যেসব দেশের সঙ্গে চীনের বিরোধ তাদের অধিকাংশই আসিয়ান জোটের সদস্য। ঘটনাচক্রে যার সদস্য মিয়ানমারও। তবে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বিরোধে তেমন কোনো ভ‚মিকা নেই এ দেশটির। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের কারণে এখন কিছুটা হলেও খর্ব হবে এই অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলগত জোটের প্রতিপত্তি।

সাম্প্রতিক সফরে মিয়ানমার প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট এবং ডি-ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু কি ছাড়াও শি বৈঠক করেছেন রোহিঙ্গা গণহত্যায় প্রধান অভিযুক্ত দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, যে কোনো আন্তর্জাতিক মঞ্চে সুজন প্রতিবেশীর পক্ষে বরাবর জোরালো সমর্থন দিয়ে যাবে চীন। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের যে কোনো পদক্ষেপের সমর্থন দেয়া ছাড়াও শরণার্থী পুনর্বাসনেও সহযোগিতা দেবে তারা।

ওয়াশিংটনে চীন-মার্কিন বিশ্লেষক সৌরভ গুপ্ত মনে করেন, চীনের এ জাতীয় তাবৎ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য এতদাঞ্চলের ভ‚-রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রকে আরো কোণঠাসা রাখা। বস্তুত চীনের এসব অবকাঠামো-ক‚টনীতির কোনো যোগ্য প্রতি্যুত্তর নেই মার্কিন প্রতিপক্ষের হাতে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আসিয়ানের সমর্থনে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনকে মোটামুটি চাপে রাখতে পারলেও বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে সে ধরনের মার্কিন বলয় প্রতিষ্ঠার আশা করা আপাতত দূরপরাহত বলেই প্রতীয়মান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App